আজ-কাল-পরশু-তত্ত্বাবধায়ক-প্রশ্নে গণভোট হোক by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। এ ব্যাপারে দুটি স্পষ্ট শিবির লক্ষ করা যাচ্ছে। একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট, দ্বিতীয়টি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের নানা ফোরাম, অনেক চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী।
অনেক ফোরাম ও বুদ্ধিজীবী এখনো স্পষ্টভাবে তাঁদের অবস্থান প্রকাশ করেননি। তাঁরা হয়তো সুযোগ বুঝে কথা বলবেন।
যা হোক, এভাবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন ও সমাজ তত্ত্বাবধায়ক-প্রশ্নে দুটি মতামতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আগামী নির্বাচনটি শুধু বড় রাজনৈতিক দলের কাছে নয়, অনেকের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই কাদের অধীনে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালিত হবে, সেটা নিয়ে সবার আগ্রহ থাকা খুব স্বাভাবিক।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা জনগণের রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা একালের ভোটারদের নেই। তাই তারা অনেকেই শঙ্কিত। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার এক-এগারোর সরকারের কথা বলে জনগণকে ভয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এক-এগারোর সরকার একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এসেছিল। সেই পরিস্থিতিও সৃষ্টি করেছিল দেশের দুটি বড় দল। সেই সরকারের পেছনে ছিল সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থন। নানা কারণে এক-এগারোর সরকার দীর্ঘ দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। কেন ছিল, তা ব্যাপক আলোচনার বিষয়। এখানে তা প্রাসঙ্গিকও নয়। তবে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্যবারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো যে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছিল, তা সরকারি নেতারা ভুলেও বলেন না।
সরকারি নেতারা বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি এখন মৃত। এটা এখন সংবিধানে নেই।’ কথাটা সত্য। কিন্তু এই ইস্যুতে সাবেক প্রধান বিচারপতির রায়টি ঠিকমতো অনুসরণ করলে আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাওয়া যেত। আগামী ১০ বছরের মধ্যে প্রধান দুটি দলের নেতৃত্বে গুণগত পরিবর্তনও হতে পারে। বর্তমান নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের রাজনীতি দূষিত হয়েছে, দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে। বড় দুই দলে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। পারস্পরিক সম্পর্কেও গণতন্ত্রের ছায়া নেই। বড় দুই দলে এ রকম পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা আমরা মনে করি না। দুই দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন হলে দলে, সরকারে, সংসদে, সর্বোপরি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে। আসবেই, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। তবে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য যদি পরিবারতন্ত্রের ভিত্তিতে বড় দুই দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে, তাহলে সেই সম্ভাবনা খুব কম। এ রকম হলে বড় দুই দল দলীয় একনায়কতন্ত্রের গর্তেই থেকে যাবে। তবু আমরা আশা করতে চাই, দলের বর্তমান নেতৃত্ব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলেও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হয়তো পারবে। আপাতত আগামী দুই টার্ম সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে হওয়া সব দিক থেকে ভালো হবে, যদিও আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকার তা মানতে রাজি নয়।
এই বিষয় নিষ্পত্তির জন্য কিছুদিন আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছিল। মিডিয়াসহ বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম থেকে এ আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সরকার ও সরকারি দল এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
আমাদের কাছে কিন্তু পরিষ্কার ধারণা নেই, দেশের কত ভাগ লোক তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে যে মতামত শোনা গেছে, তা প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে নেতৃত্বস্থানীয় জনগণ (সবার মতামত শোনা সম্ভব নয়) কী মত পোষণ করে, তা ভালোভাবে জানা যায়নি। আমরা মনে করি, এসব ইস্যুতে মতামত দেওয়া শুধু রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, নানা ফোরাম, এনজিও এ ব্যাপারে মতামত দিতে পারে। তাদের মতামত শোনা উচিত। এটা রাজনৈতিক বা দলীয় মতামত নয়। এটা একটা পদ্ধতির ব্যাপারে মতামত। সরকারি কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে মতামত দিতে পারেন।
সরকার যখন বারবার আহ্বান সত্ত্বেও কোনো সংলাপের আয়োজন করছে না, তখন অন্য কোনো ফোরাম এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে এই সংলাপের আয়োজন করতে পারে। যেমন কয়েকটি সক্রিয় নাগরিক ফোরাম সম্মিলিত একটি কমিটি গঠন করে এই সংলাপের কর্মসূচি নিতে পারে। বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভিতে তার ব্যাপক কভারেজ পেলে তা জনমত গঠনে সহায়ক হবে। প্রথম দফায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। ঢাকার বাইরে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন হবে না। কারণ, রাজনৈতিক দলের মতামত কেন্দ্রনির্ভর। জেলা পর্যায়ে তার প্রতিধ্বনি হয় মাত্র।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। তৃতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। ঢাকায় এই তিন পর্যায়ে সংলাপের আয়োজন করলে প্রধান রাজনৈতিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম ও ব্যক্তিদের (অপিনিয়ন লিডার) মতামত সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। এসব মতামত নির্বাচন-প্রশ্নে বর্তমান সরকারের নীতি-নির্ধারণে সহায়ক হবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে আমরা সাধারণত ঢাকার মতামত শুনি ও ঢাকার মতামতকে প্রাধান্য দিই। এটা দীর্ঘদিনের ট্রাডিশন। এই ট্রাডিশন পাল্টানো দরকার। এই লক্ষ্যে আটটি বিভাগীয় শহরে বিভিন্ন পেশাজীবী ও শহরের গণমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আটটি সভার আয়োজন করা যায়। এই বিভাগীয় সংলাপেরও ব্যাপক কভারেজ দিতে হবে সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিওতে।
আশা করা যায়, এই সিরিজ সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে একটা প্রতিনিধিত্বমূলক জনমত পাওয়া যাবে। আগেই বলেছি, কোনো ইস্যুতেই প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত পাওয়া সম্ভব নয়। অনেক গবেষণা সংস্থা প্রতিনিধিত্বমূলক জরিপের মাধ্যমে জনমত সংগ্রহ করে। এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থা। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতেও এ রকম জনমত সংগ্রহ সম্ভব, তবে তা খুব ব্যয়বহুল পদ্ধতি। হয়তো কোনো দাতা সংস্থা এই কর্মসূচিতে অর্থের জোগান দিতে পারে। কিন্তু আমরা মনে করি, এই কাজে কোনো বিদেশি অর্থসহায়তা নেওয়া উচিত হবে না। এটা আমাদের ঘরোয়া কাজ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এই সিরিজ সংলাপ থেকে যদি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির পক্ষে মতামত বেশি পাওয়া যায়, তাহলে সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। আর যদি বিপক্ষে মতামত বেশি পাওয়া যায়, তাহলে বিএনপি ও অন্যান্য দল তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। এটা হবে জনমতের কাছে আত্মসমর্থন। এটাই গণতন্ত্র।
সরকারি উদ্যোগে সংলাপের আয়োজন না হলে ঈদের পর থেকে ‘বেসরকারি সংলাপ’ শুরু করার জন্য আমরা প্রস্তাব দিচ্ছি। এই ইস্যুতে ‘জনগণের’ মতামত ‘নয়াপল্টন’ ও ‘গুলিস্তান’ এলাকায় পাওয়া গেলেই শুধু হবে না, আনুষ্ঠানিকভাবে অনেকের মতামত পেতে হবে। আর সংসদ নির্বাচন শুধু প্রার্থীদের (রাজনৈতিক দল) বিষয় নয়, এটা প্রধানত ভোটারদের (জনগণ) বিষয়। কাজেই জনগণের নানা ফোরামের মতামতও সরকারকে শুনতে হবে। নির্বাচন পদ্ধতি প্রশ্নে ভোটারদের মতামত খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে মনে হয় ইস্যুটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঘরোয়া বিষয়। এই দুই দল একমত হলেই দেশের ষোলো কোটি লোককে তা মেনে নিতে হবে।
নাগরিক সমাজের উদ্যোগে এত আয়োজন করার পরও সরকার ও রাজনৈতিক দল যদি এই মতামতকে কোনো গুরুত্ব না দেয়, তাহলে আমাদের আর করার কিছু নেই। জনগণই এর বিচার করবে। নাগরিক সমাজ সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বিনা স্বার্থে (তাঁরা কেউ প্রার্থী হবেন না) সহায়তা করতে চায়। রাস্তায় মারামারি ও হরতাল না করে প্রতিনিধিত্বমূলক জনমত সংগ্রহ করাই কি ভালো নয়?
এই সিরিজ আলোচনার ফলাফলে যদি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো প্রভাবিত না হয়, তাহলে শেষ অস্ত্র হলো: গণভোট। এই বিতর্কিত ইস্যুতে গণভোটই শেষ অস্ত্র। যদি এই ইস্যুতে গণভোট হয়, তাহলে আমাদের প্রস্তাব: শুধু দুই টার্মের জন্য নয়, অন্তত চার টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের জন্য জনমত চাওয়া হোক। আমরা চার টার্ম বলছি এ জন্য যে, আশা করা যায়, আগামী কুড়ি বছরে এ দেশের রাজনীতি থেকে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের জীবাণুগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। নতুন ও পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব রাজনীতিতে ঢুকবে। কর্মী স্তরেও একটা গুণগত পরিবর্তন আসবে। এই চার টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সংসদ নির্বাচন হবে ক্যানসারের ‘কেমোর’ মতো। চারটি কড়া ডোজের কেমো, যাতে এই সময়ের মধ্যে আমাদের রাজনীতির বিষাক্ত জীবাণুগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। রাজনীতি যেন নতুন গণতান্ত্রিক জীবন লাভ করে।
আশা করি গণভোটের রায় সরকার, সরকারি দল, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, দেশের সব মানুষ মেনে নিতে দ্বিধা করবে না। তবে গণভোটটি হতে হবে পরিচ্ছন্ন ও ত্রুটিমুক্ত।
শুধু কথা বলে, জনসভা করে, টক শো করে বা কলাম লিখে এই বিতর্কিত ইস্যু নিষ্পন্ন হবে না। আমার প্রস্তাবের বাইরে কোনো পাঠক যদি আরও গঠনমূলক, কার্যকর ও বাস্তবায়নের উপযোগী পথের সন্ধান দিতে পারেন, তাহলে খুশি হব।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: গণমাধ্যম ও উন্নয়নকর্মী।
যা হোক, এভাবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন ও সমাজ তত্ত্বাবধায়ক-প্রশ্নে দুটি মতামতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আগামী নির্বাচনটি শুধু বড় রাজনৈতিক দলের কাছে নয়, অনেকের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই কাদের অধীনে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালিত হবে, সেটা নিয়ে সবার আগ্রহ থাকা খুব স্বাভাবিক।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা জনগণের রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা একালের ভোটারদের নেই। তাই তারা অনেকেই শঙ্কিত। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার এক-এগারোর সরকারের কথা বলে জনগণকে ভয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এক-এগারোর সরকার একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এসেছিল। সেই পরিস্থিতিও সৃষ্টি করেছিল দেশের দুটি বড় দল। সেই সরকারের পেছনে ছিল সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থন। নানা কারণে এক-এগারোর সরকার দীর্ঘ দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। কেন ছিল, তা ব্যাপক আলোচনার বিষয়। এখানে তা প্রাসঙ্গিকও নয়। তবে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্যবারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো যে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছিল, তা সরকারি নেতারা ভুলেও বলেন না।
সরকারি নেতারা বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি এখন মৃত। এটা এখন সংবিধানে নেই।’ কথাটা সত্য। কিন্তু এই ইস্যুতে সাবেক প্রধান বিচারপতির রায়টি ঠিকমতো অনুসরণ করলে আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাওয়া যেত। আগামী ১০ বছরের মধ্যে প্রধান দুটি দলের নেতৃত্বে গুণগত পরিবর্তনও হতে পারে। বর্তমান নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের রাজনীতি দূষিত হয়েছে, দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে। বড় দুই দলে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। পারস্পরিক সম্পর্কেও গণতন্ত্রের ছায়া নেই। বড় দুই দলে এ রকম পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা আমরা মনে করি না। দুই দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন হলে দলে, সরকারে, সংসদে, সর্বোপরি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে। আসবেই, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। তবে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য যদি পরিবারতন্ত্রের ভিত্তিতে বড় দুই দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে, তাহলে সেই সম্ভাবনা খুব কম। এ রকম হলে বড় দুই দল দলীয় একনায়কতন্ত্রের গর্তেই থেকে যাবে। তবু আমরা আশা করতে চাই, দলের বর্তমান নেতৃত্ব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলেও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হয়তো পারবে। আপাতত আগামী দুই টার্ম সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে হওয়া সব দিক থেকে ভালো হবে, যদিও আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকার তা মানতে রাজি নয়।
এই বিষয় নিষ্পত্তির জন্য কিছুদিন আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছিল। মিডিয়াসহ বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম থেকে এ আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সরকার ও সরকারি দল এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
আমাদের কাছে কিন্তু পরিষ্কার ধারণা নেই, দেশের কত ভাগ লোক তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে যে মতামত শোনা গেছে, তা প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে নেতৃত্বস্থানীয় জনগণ (সবার মতামত শোনা সম্ভব নয়) কী মত পোষণ করে, তা ভালোভাবে জানা যায়নি। আমরা মনে করি, এসব ইস্যুতে মতামত দেওয়া শুধু রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, নানা ফোরাম, এনজিও এ ব্যাপারে মতামত দিতে পারে। তাদের মতামত শোনা উচিত। এটা রাজনৈতিক বা দলীয় মতামত নয়। এটা একটা পদ্ধতির ব্যাপারে মতামত। সরকারি কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে মতামত দিতে পারেন।
সরকার যখন বারবার আহ্বান সত্ত্বেও কোনো সংলাপের আয়োজন করছে না, তখন অন্য কোনো ফোরাম এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে এই সংলাপের আয়োজন করতে পারে। যেমন কয়েকটি সক্রিয় নাগরিক ফোরাম সম্মিলিত একটি কমিটি গঠন করে এই সংলাপের কর্মসূচি নিতে পারে। বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভিতে তার ব্যাপক কভারেজ পেলে তা জনমত গঠনে সহায়ক হবে। প্রথম দফায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। ঢাকার বাইরে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন হবে না। কারণ, রাজনৈতিক দলের মতামত কেন্দ্রনির্ভর। জেলা পর্যায়ে তার প্রতিধ্বনি হয় মাত্র।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। তৃতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। ঢাকায় এই তিন পর্যায়ে সংলাপের আয়োজন করলে প্রধান রাজনৈতিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম ও ব্যক্তিদের (অপিনিয়ন লিডার) মতামত সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। এসব মতামত নির্বাচন-প্রশ্নে বর্তমান সরকারের নীতি-নির্ধারণে সহায়ক হবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে আমরা সাধারণত ঢাকার মতামত শুনি ও ঢাকার মতামতকে প্রাধান্য দিই। এটা দীর্ঘদিনের ট্রাডিশন। এই ট্রাডিশন পাল্টানো দরকার। এই লক্ষ্যে আটটি বিভাগীয় শহরে বিভিন্ন পেশাজীবী ও শহরের গণমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আটটি সভার আয়োজন করা যায়। এই বিভাগীয় সংলাপেরও ব্যাপক কভারেজ দিতে হবে সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিওতে।
আশা করা যায়, এই সিরিজ সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে একটা প্রতিনিধিত্বমূলক জনমত পাওয়া যাবে। আগেই বলেছি, কোনো ইস্যুতেই প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত পাওয়া সম্ভব নয়। অনেক গবেষণা সংস্থা প্রতিনিধিত্বমূলক জরিপের মাধ্যমে জনমত সংগ্রহ করে। এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থা। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতেও এ রকম জনমত সংগ্রহ সম্ভব, তবে তা খুব ব্যয়বহুল পদ্ধতি। হয়তো কোনো দাতা সংস্থা এই কর্মসূচিতে অর্থের জোগান দিতে পারে। কিন্তু আমরা মনে করি, এই কাজে কোনো বিদেশি অর্থসহায়তা নেওয়া উচিত হবে না। এটা আমাদের ঘরোয়া কাজ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এই সিরিজ সংলাপ থেকে যদি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির পক্ষে মতামত বেশি পাওয়া যায়, তাহলে সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। আর যদি বিপক্ষে মতামত বেশি পাওয়া যায়, তাহলে বিএনপি ও অন্যান্য দল তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। এটা হবে জনমতের কাছে আত্মসমর্থন। এটাই গণতন্ত্র।
সরকারি উদ্যোগে সংলাপের আয়োজন না হলে ঈদের পর থেকে ‘বেসরকারি সংলাপ’ শুরু করার জন্য আমরা প্রস্তাব দিচ্ছি। এই ইস্যুতে ‘জনগণের’ মতামত ‘নয়াপল্টন’ ও ‘গুলিস্তান’ এলাকায় পাওয়া গেলেই শুধু হবে না, আনুষ্ঠানিকভাবে অনেকের মতামত পেতে হবে। আর সংসদ নির্বাচন শুধু প্রার্থীদের (রাজনৈতিক দল) বিষয় নয়, এটা প্রধানত ভোটারদের (জনগণ) বিষয়। কাজেই জনগণের নানা ফোরামের মতামতও সরকারকে শুনতে হবে। নির্বাচন পদ্ধতি প্রশ্নে ভোটারদের মতামত খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে মনে হয় ইস্যুটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঘরোয়া বিষয়। এই দুই দল একমত হলেই দেশের ষোলো কোটি লোককে তা মেনে নিতে হবে।
নাগরিক সমাজের উদ্যোগে এত আয়োজন করার পরও সরকার ও রাজনৈতিক দল যদি এই মতামতকে কোনো গুরুত্ব না দেয়, তাহলে আমাদের আর করার কিছু নেই। জনগণই এর বিচার করবে। নাগরিক সমাজ সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বিনা স্বার্থে (তাঁরা কেউ প্রার্থী হবেন না) সহায়তা করতে চায়। রাস্তায় মারামারি ও হরতাল না করে প্রতিনিধিত্বমূলক জনমত সংগ্রহ করাই কি ভালো নয়?
এই সিরিজ আলোচনার ফলাফলে যদি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো প্রভাবিত না হয়, তাহলে শেষ অস্ত্র হলো: গণভোট। এই বিতর্কিত ইস্যুতে গণভোটই শেষ অস্ত্র। যদি এই ইস্যুতে গণভোট হয়, তাহলে আমাদের প্রস্তাব: শুধু দুই টার্মের জন্য নয়, অন্তত চার টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের জন্য জনমত চাওয়া হোক। আমরা চার টার্ম বলছি এ জন্য যে, আশা করা যায়, আগামী কুড়ি বছরে এ দেশের রাজনীতি থেকে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের জীবাণুগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। নতুন ও পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব রাজনীতিতে ঢুকবে। কর্মী স্তরেও একটা গুণগত পরিবর্তন আসবে। এই চার টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সংসদ নির্বাচন হবে ক্যানসারের ‘কেমোর’ মতো। চারটি কড়া ডোজের কেমো, যাতে এই সময়ের মধ্যে আমাদের রাজনীতির বিষাক্ত জীবাণুগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। রাজনীতি যেন নতুন গণতান্ত্রিক জীবন লাভ করে।
আশা করি গণভোটের রায় সরকার, সরকারি দল, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, দেশের সব মানুষ মেনে নিতে দ্বিধা করবে না। তবে গণভোটটি হতে হবে পরিচ্ছন্ন ও ত্রুটিমুক্ত।
শুধু কথা বলে, জনসভা করে, টক শো করে বা কলাম লিখে এই বিতর্কিত ইস্যু নিষ্পন্ন হবে না। আমার প্রস্তাবের বাইরে কোনো পাঠক যদি আরও গঠনমূলক, কার্যকর ও বাস্তবায়নের উপযোগী পথের সন্ধান দিতে পারেন, তাহলে খুশি হব।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: গণমাধ্যম ও উন্নয়নকর্মী।
No comments