নাটকের ক্লাস-অন্য রকম ভাষা by আব্দুল্লাহেল মাহমুদ
নির্দেশক ও স্থানীয় দলটির অনুরোধে আরও কয়েক দিনের জন্য নাট্যকার ঢাকার বাইরে থেকে যেতে রাজি হলেন। এ রকম ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ তাঁর খুব একটা হয় না। তাই অনুরোধ করামাত্র আরও কয়েক দিনের জন্য সুযোগটা নিয়ে নিলেন। আজ শুরু থেকেই রিহার্সেলটা বেশ জমে উঠেছে।
তবে দলের সদস্যরা চাইছিলেন নাট্যকারের মুখ থেকে কিছু শুনতে। চা-শিঙাড়ার বিরতিতে দলের একজন কৌতূহলী সদস্য তাঁর কাছে ভাষার বিষয়টি আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে সবাই তাঁকে সমর্থন করলেন।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে নাট্যকার শুরু করলেন গান—‘চোখ যে মনের কথা বলে, চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে চোখের মতো চোখ থাকা চাই’। দুই লাইন গান করে একটু থামলেন। তারপর তাঁর স্বভাবসুলভ মাস্টারি ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন, কণ্ঠনিঃসৃত ভাষাই একমাত্র ভাষা নয়, অন্য রকম ভাষাও আছে। শুধু চোখ নয়, হাত-পা, অঙ্গভঙ্গি—অনেক কিছুই কথা বলে। শুধু মুখ দিয়ে কথা বলে মানুষ পরিতৃপ্ত নয়। মুখের উচ্চারিত শব্দ ছাড়াও নানাভাবে সে তার ভাষার পরিধি বাড়িয়েছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছেন, একটি ভাষায় যত শব্দ আছে, তার খুব অল্প অংশই একজন মানুষ তার সারা জীবনে ব্যবহার করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ইংরেজি ভাষার উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর সমগ্র রচনায় ব্যবহার করেছেন মাত্র ১৫ হাজার শব্দ। অথচ ইংরেজি ভাষায় শব্দসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। সে হিসাব থেকেই তাঁরা অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন যে মাত্র ১৫ হাজার শব্দ থেকে যদি ২০ শব্দের একটি করে বোধগম্য বাক্য তৈরি করা যায়, তাহলে যে বিশাল বাক্যভান্ডার তৈরি হবে, তা উচ্চারণ করতে লেগে যাবে ১৫০ হাজার ট্রিলিয়ন বছর। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ভাষার একটি বিশাল অংশ অব্যবহূত থাকার পরও মানুষ কেন অবাচনিক ভাষা ব্যবহার করে?
শ্রোতাদের কৌতূহল বাড়তে থাকে। তারা একটু নড়েচড়ে বসে। নাট্যকার একটু দম নিয়ে বলতে থাকেন, এর অনেক উত্তর হতে পারে, তবে আমরা ধরে নিতে পারি যে মানুষ শুধু বাচনিক যোগাযোগে তৃপ্ত নয়। আর সে জন্যই এই অবাচনিক যোগাযোগ। বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায় আরও দেখতে পেয়েছেন, প্রতিদিন মানুষ যে পরিমাণ ভাষার ব্যবহার করে, তার প্রায় ৫০ ভাগই (ওয়ার্ডলেস) অবাচনিক।
অবাচনিক যোগাযোগ হলো শব্দহীন (ওয়ার্ডলেস) বার্তা গ্রহণ ও প্রেরণ। এই অবাচনিক যোগাযোগের একটি বড় অংশজুড়ে আছে মানবদেহ। বিশেষ করে মুখের অভিব্যক্তি। এ বিষয়ে প্রথম আলোচনার সূত্রপাত করেন চার্লস ডারউইন। ১৮৭২ সালে তিনি তাঁর লেখা দি এক্সপ্রেশন অব দি ইমোশন ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিমেল গ্রন্থে দেখান, প্রত্যেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবেগই তার মুখমণ্ডলে বিশ্বস্তভাবে ফুটে ওঠে। অবাচনিক যোগাযোগের বিষয়টি আজ আর শুধু যোগাযোগের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। ভাষাতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, সামাজিক মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে আজ বহুল ব্যবহূত। দেহভঙ্গিমা (জেসচার), অভিব্যক্তি (ফেসিয়েল এক্সপ্রেশন), কথা বলার ধরন, ধ্বনির মান, ধ্বনিসাম্য, স্বরাঘাত, তাল-লয়, ছন্দ, বার্তা প্রেরক ও গ্রহণকারীর অবস্থান ও দূরত্ব, এমনকি তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চুলের স্টাইল, গৃহের স্থাপত্য ইত্যাদিও অবাচনিক যোগাযোগের অন্যতম উপাদান। অবাচনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় বক্তা ও শ্রোতার মুখোমুখি প্রতিক্রিয়ার (ফেস টু ফেস ইন্টার্যাকশন) তিনটি প্রধান ক্ষেত্রের ওপর। এগুলো হলো ১. পরিবেশগত অবস্থা, অর্থাৎ যোগাযোগটি কোন স্থানে হচ্ছে; ২. যোগাযাগকারীদের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য ও ৩. যোগাযোগের সময় তাদের আচরণ—এ তিনটি ক্ষেত্রে।
নাট্যকার একটু থেমে আবার বলতে থাকেন, আমরা আমাদের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় যেমন, চোখ, কান, নাক, জিহ্বা— এসবের মাধ্যমেও (দেখা, শোনা, স্পর্শ বা স্বাদ) অবাচনিক যোগাযোগ করে থাকি। আমরা যখন কথা বলি তখন আমাদের মনোযোগ বক্তার দেহভাষার চেয়ে কণ্ঠের দিকেই বেশি থাকে। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় দেহ ও কণ্ঠ দুটোই থাকে। একজন শ্রোতা একই সঙ্গে বক্তার বাচনিক ও অবাচনিক সূত্রগুলো (কিউ) প্রক্রিয়াজাত করে গ্রহণ করে। সাধারণত দেহভঙ্গিমায় ইতিবাচক বা নেতিবাচক চিহ্ন থাকে না; বরং পরিস্থিতি ও বার্তাই তা ঠিক করে দেয়। নির্দেশক মহড়া শুরু করার তাগিদ দিলে আলোচনা এখানেই থেমে যায়।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে নাট্যকার শুরু করলেন গান—‘চোখ যে মনের কথা বলে, চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে চোখের মতো চোখ থাকা চাই’। দুই লাইন গান করে একটু থামলেন। তারপর তাঁর স্বভাবসুলভ মাস্টারি ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন, কণ্ঠনিঃসৃত ভাষাই একমাত্র ভাষা নয়, অন্য রকম ভাষাও আছে। শুধু চোখ নয়, হাত-পা, অঙ্গভঙ্গি—অনেক কিছুই কথা বলে। শুধু মুখ দিয়ে কথা বলে মানুষ পরিতৃপ্ত নয়। মুখের উচ্চারিত শব্দ ছাড়াও নানাভাবে সে তার ভাষার পরিধি বাড়িয়েছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছেন, একটি ভাষায় যত শব্দ আছে, তার খুব অল্প অংশই একজন মানুষ তার সারা জীবনে ব্যবহার করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ইংরেজি ভাষার উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর সমগ্র রচনায় ব্যবহার করেছেন মাত্র ১৫ হাজার শব্দ। অথচ ইংরেজি ভাষায় শব্দসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। সে হিসাব থেকেই তাঁরা অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন যে মাত্র ১৫ হাজার শব্দ থেকে যদি ২০ শব্দের একটি করে বোধগম্য বাক্য তৈরি করা যায়, তাহলে যে বিশাল বাক্যভান্ডার তৈরি হবে, তা উচ্চারণ করতে লেগে যাবে ১৫০ হাজার ট্রিলিয়ন বছর। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ভাষার একটি বিশাল অংশ অব্যবহূত থাকার পরও মানুষ কেন অবাচনিক ভাষা ব্যবহার করে?
শ্রোতাদের কৌতূহল বাড়তে থাকে। তারা একটু নড়েচড়ে বসে। নাট্যকার একটু দম নিয়ে বলতে থাকেন, এর অনেক উত্তর হতে পারে, তবে আমরা ধরে নিতে পারি যে মানুষ শুধু বাচনিক যোগাযোগে তৃপ্ত নয়। আর সে জন্যই এই অবাচনিক যোগাযোগ। বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায় আরও দেখতে পেয়েছেন, প্রতিদিন মানুষ যে পরিমাণ ভাষার ব্যবহার করে, তার প্রায় ৫০ ভাগই (ওয়ার্ডলেস) অবাচনিক।
অবাচনিক যোগাযোগ হলো শব্দহীন (ওয়ার্ডলেস) বার্তা গ্রহণ ও প্রেরণ। এই অবাচনিক যোগাযোগের একটি বড় অংশজুড়ে আছে মানবদেহ। বিশেষ করে মুখের অভিব্যক্তি। এ বিষয়ে প্রথম আলোচনার সূত্রপাত করেন চার্লস ডারউইন। ১৮৭২ সালে তিনি তাঁর লেখা দি এক্সপ্রেশন অব দি ইমোশন ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিমেল গ্রন্থে দেখান, প্রত্যেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবেগই তার মুখমণ্ডলে বিশ্বস্তভাবে ফুটে ওঠে। অবাচনিক যোগাযোগের বিষয়টি আজ আর শুধু যোগাযোগের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। ভাষাতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, সামাজিক মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে আজ বহুল ব্যবহূত। দেহভঙ্গিমা (জেসচার), অভিব্যক্তি (ফেসিয়েল এক্সপ্রেশন), কথা বলার ধরন, ধ্বনির মান, ধ্বনিসাম্য, স্বরাঘাত, তাল-লয়, ছন্দ, বার্তা প্রেরক ও গ্রহণকারীর অবস্থান ও দূরত্ব, এমনকি তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চুলের স্টাইল, গৃহের স্থাপত্য ইত্যাদিও অবাচনিক যোগাযোগের অন্যতম উপাদান। অবাচনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় বক্তা ও শ্রোতার মুখোমুখি প্রতিক্রিয়ার (ফেস টু ফেস ইন্টার্যাকশন) তিনটি প্রধান ক্ষেত্রের ওপর। এগুলো হলো ১. পরিবেশগত অবস্থা, অর্থাৎ যোগাযোগটি কোন স্থানে হচ্ছে; ২. যোগাযাগকারীদের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য ও ৩. যোগাযোগের সময় তাদের আচরণ—এ তিনটি ক্ষেত্রে।
নাট্যকার একটু থেমে আবার বলতে থাকেন, আমরা আমাদের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় যেমন, চোখ, কান, নাক, জিহ্বা— এসবের মাধ্যমেও (দেখা, শোনা, স্পর্শ বা স্বাদ) অবাচনিক যোগাযোগ করে থাকি। আমরা যখন কথা বলি তখন আমাদের মনোযোগ বক্তার দেহভাষার চেয়ে কণ্ঠের দিকেই বেশি থাকে। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় দেহ ও কণ্ঠ দুটোই থাকে। একজন শ্রোতা একই সঙ্গে বক্তার বাচনিক ও অবাচনিক সূত্রগুলো (কিউ) প্রক্রিয়াজাত করে গ্রহণ করে। সাধারণত দেহভঙ্গিমায় ইতিবাচক বা নেতিবাচক চিহ্ন থাকে না; বরং পরিস্থিতি ও বার্তাই তা ঠিক করে দেয়। নির্দেশক মহড়া শুরু করার তাগিদ দিলে আলোচনা এখানেই থেমে যায়।
No comments