সংবর্ধনা-বিনয়ী হতে হবে

এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সৌভাগ্যবান অ্যাখ্যায়িত করে গুণীজনেরা বলেছেন, ‘তোমাদের ওপরই নির্ভর করছে আগামীর বাংলাদেশ। তাই শ্রম ও মেধার মাধ্যমে তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে, হতে হবে সৃজনশীল ও বিনয়ী।’


প্রথম আলোর আয়োজনে ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) লিমিটেডের সহযোগিতায় গতকাল বুধবার সিলেট, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও গোপালগঞ্জে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের প্রচার-সহযোগী মাছরাঙা টেলিভিশন, এবিসি রেডিও ও প্রথম আলো ডট কম। সার্বিক সহযোগিতা করেন প্রথম আলো বন্ধুসভার স্থানীয় সদস্যরা।
ঢাকার বাইরে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
সিলেট: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে আট শতাধিক কৃতী শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বেলা সাড়ে তিনটায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তৃতায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দুটি হাতই শক্তিশালী। এই হাত পাতলে হয়ে যায় ভিখারির হাত, আর মুষ্টিবদ্ধ করে তুললে হবে শক্তি ও শ্রমের হাত। তোমাদের হাত পেতে নয়, চলতে হবে মুষ্টিবদ্ধ করে। কারণ, তোমাদের ওপরই নির্ভর করছে আগামীর বাংলাদেশ।’ প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী সিলেটে সেরা ফল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক শফিকুর রহমানের হাতে সমঞ্চাননা ক্রেস্ট তুলে দেন। তিনি তাঁর ছাত্রজীবনের শ্রম-মেধার কথা তুলে ধরে শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
সিলেটের অদম্য মেধাবী নাদিম আহমদের হাতে ক্রেস্ট দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান জনপ্রিয় লেখক শিক্ষাবিদ মুহমঞ্চদ জাফর ইকবাল। তিনি নিজের জীবনে প্রথম রক্ত দান করার ঘটনা উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের দানশীল মনোভাব গড়ে তোলার আহ্বান জানান। জাফর ইকবাল বলেন, ‘তোমাদের সময়ে তোমরাই সবচেয়ে সৌভাগ্যবান। তোমাদের মাথার ভেতর এক কেজির মতো একটা জিনিস আছে। সেটা মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মস্তিষ্ক বাঁচলে চিন্তাশক্তি থাকবে, মানুষ সৃজনশীল হবে। আমাদের সৃজনশীল হতে হবে।’
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক মিজানুর রহমান খান মাদক ও মুখস্থকে ‘না’ বলার শপথ পাঠ করান। প্রথম আলোর বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বলি, বদলে যাও বদলে দাও। এই বদলের কাজটা কিন্তু আগে নিজেদের শুরু করতে হবে।’ অনুষ্ঠানে কৃতী শিক্ষার্থী খন্দকার খাজিতাজুল কিবরিয়া ও আজমা তানজুমও বক্তব্য দেয়।
বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে চলে গান ও আবৃত্তি। বন্ধুসভার কয়েকজন বন্ধু আবৃত্তি করেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার হাল ধরেছি শক্ত করে গীতিনাট্য মঞ্চায়নের পর ক্লোজআপ তারকা কিশোরের গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে ছয়টার দিকে অনুষ্ঠান শেষ হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিলেটে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল মেহেদী। সমাপনী বক্তব্য দেন বন্ধুসভা সিলেটের সভাপতি মিথুন দাশ। পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বন্ধুসভার দেবশ্রী ধর।
মানিকগঞ্জ: সকাল থেকেই কৃতী শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ মিলনায়তন। সকাল সাড়ে ১০টায় বন্ধুসভার সদস্যদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এখানে জেলার দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কৃতীদের উদ্দেশে মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ আবুল ইসলাম শিকদার বলেন, ‘নিজেদের আদর্শ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি সমাজ, দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রাখতে হবে।’ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু আযাহা আহমেঞ্চদ বলেন, ‘তোমাদের নিয়মানুবর্তী ও পরিশ্রমী হতে হবে। তাহলেই এ সাফল্য ধরে রাখতে পারবে।’ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, ‘তোমরাই পারবে দেশকে এগিয়ে নিতে। এ জন্য নিজেদের আত্মপ্রত্যয়ী ও বিবেকবান হতে হবে।’ প্রথম আলোর সহসম্পাদক ইসরাত জাহান বলেন, ‘তোমাদের এই সাফল্যই শেষ নয়, আরও বড় অর্জনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, নিজের স্বপ্ন ধরে রাখবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকার সরকারি বাঙলা কলেজের অধ্যাপক ফজলুল হক, সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের উপাধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক নওরোজ মোহামঞ্চদ সাঈদ, মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজিত কুমার রায়, মানিকগঞ্জ বন্ধুসভার উপদেষ্টা দীপক কুমার ঘোষ, সভাপতি আমিনুর রহমান অঞ্জন, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম ও প্রথম আলোর মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি আবদুল মোমিন। জেলার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমঞ্চাননা পায় মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়। অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেন বন্ধুসভার সদস্যরা। গান পরিবেশন করেন ক্লোজআপ-ওয়ান তারকা পলাশ।
কিশোরগঞ্জ: বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে কিশোরগঞ্জের প্রায় সাড়ে ৫০০ কৃতী শিক্ষার্থী সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে জেলা শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে উপস্থিত হয়। জেলায় এবার সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ পাওয়া মেধাবীদের প্রতিষ্ঠান কিশোরগঞ্জ এসভি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। স্বাগত বক্তব্য দেন কিশোরগঞ্জে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সাইফুল হক মোল্লা। অধ্যাপক প্রাণেশ কুমার চৌধুরী মেধাবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া মানে শিক্ষার বড় জগতে প্রবেশের দ্বার উন্মোচন হওয়া। সেই জগতে নিজেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ধরে রাখতে হবে।’ পৌর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শরীফ সাদি বলেন, ‘ভালো মানুষ হওয়া কঠিন। তোমাদের ভালো মানুষ হতে হবে।’ সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন, ‘মেধাবী সন্তান পেতে হলে সবার আগে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।’ শিক্ষানুরাগী বাদল রহমান শিক্ষার্থীদের সবার আগে বিনয়ী হওয়ার পরামর্শ দেন।
প্রথম আলোর নগর সম্পাদক অরুণ কর্মকার বলেন, ‘প্রথম আলো শুধু মেধাবীদের সংবর্ধনা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে না, অদম্য মেধাবীদের খুঁজে বের করে আনার চেষ্টা করছে। বৃত্তি দিয়ে তাদের কঠিন পথ সহজ করে দিচ্ছে।’ বন্ধুসভার উপদেষ্টা মানস করের পরিকল্পনায় পরিবেশিত ‘বদলে যাও, বদলে দাও’ সংগীতের সঙ্গে দলীয় নৃত্য ও বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে একক অভিনয় দর্শক নন্দিত হয়। পরে ক্লোজআপ-ওয়ান তারকা আতিক গানে গানে সবাইকে মাতিয়ে তোলেন।
জেলার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কিশোরগঞ্জ এসভি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ কবীরের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আ. গনি, সনাক সভাপতি মায়া ভৌমিক, শিক্ষাবিদ আবু খালেক পাঠান, নারীনেত্রী নাযমুন নাহার, চিত্রশিল্পী এম এ কাইয়ুম, কিশোগঞ্জ সরকারি বালক বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক শামসুজ্জামান ভূঁইয়া, কৃতী শিক্ষার্থী বাপ্পি চন্দ্র দাস ও রাইশা বিনতে মোহাম্মদ, কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভার সভাপতি জুলহাস উদ্দিন সরকার, ভৈরবে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমন মোল্লা প্রমুখ।
গোপালগঞ্জ: উদীচীর শিল্পীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বেলা ১১টায় সরকারি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠান শুরু হয়।
প্রথম আলোর গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি সুব্রত সাহা সবাইকে স্বগত জানিয়ে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে অদম্য মেধাবী লিমা আক্তার বলে, ‘আমার বাবা ঠেলাগাড়ি চালান, মা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। এ কথা বলতে আমি আজ গর্ব করি। কারণ, তাদের সন্তান হয়ে আমি দেখিয়ে দিয়েছি একাগ্রতা ও মেধা দিয়ে সব প্রতিকূলতা জয় করা যায়।’ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ এম এ হাই শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এইচএসসিতেও তোমাদের এমন ফল করে দেখিয়ে দিতে হবে, তোমরা ফুরিয়ে যাওনি।’ হাজি লাল মিয়া সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উপাধ্যক্ষ কাজী জুলকার নাইন বলেন, ‘সবকিছুর হাল তোমাদেরই ধরতে হবে। আশা করি, সে জন্য তোমরা নিজেদের প্রস্তুত করে তুলছ।’
কৃতী শিক্ষার্থীরা হাত উঁচিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখার অঙ্গীকার করে। অনুষ্ঠানে বন্ধুসভার পূরবী শেখ কবিতা আবৃত্তি করেন। গান গেয়ে শোনান অর্চনা রায়, অমিতোষ বিশ্বাস। মুনমুন ইসলামের পরিচালনায় কবি গুরুর ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশ করেন বন্ধুসভার খুদে বন্ধুরা। শেষে স্থানীয় ব্যান্ড ‘ল্যাম্পপোস্ট’ সংগীত পরিবেশন করে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে স্থানীয় বন্ধুসভার সভাপতি আ স ম আবদুল হক, শিক্ষক সুকান্তি মণ্ডল, রেশমা আক্তার, উত্তম কুমার সাহা, গোলাম মোস্তফা ও প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি আশীষ-উর-রহমান বক্তব্য দেন। জেলার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয় এস এম মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহার হাতে।

No comments

Powered by Blogger.