মহড়াকক্ষ থেকে-টার্গেট প্লাটুন by জাহীদ রেজা নূর

মহড়াকক্ষের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। একটু ইতস্তত করি। ঠিক জায়গায় এলাম তো! ভেতর থেকে শুধু নানা তাল-লয়ের গানের সুর ভেসে আসে। এখানেই কি আসতে বলেছিলেন মামুনুর রশীদ, আমাদের মামুন ভাই!
না, ভুল করিনি। ঠিক জায়গাতেই এসেছি আমরা।


দরজা খুলে যখন মামুন ভাইয়ের পাশে বসলাম, তখন না বলে দিলেও আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই, এটি গীতল নাটক। প্রতিটি সংলাপই গানের সুরে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় রিপার্টরির প্রথম নাটকটি লিখেছেন মামুনুর রশীদ। গানের গলা ভালো যাদের, বিভিন্ন দল থেকে তাদের জড়ো করেছেন। ব্যস, তারপর শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা টার্গেট প্লাটুন নাটকটির মহড়া।
মামুন ভাইকে বলি, ‘কেন সুরে সুরে নাটক?’
‘বহুদিন ধরেই ভাবছিলাম, একটি অন্য ধরনের নাটক লিখব। পটভূমি একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ। একটি ছেলে, বাদল ওর নাম, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর ঢাকা থেকে একটি গ্রামে আসে। সেখানে এসে ঢাকার অবস্থা জানায় গ্রামের তরুণ-তরুণীদের। যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়।’
এরপর যে ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে, তার মহড়াই দেখি আমরা। এক বাবুর্চি কীভাবে পাকিস্তানি শিবির থেকে গোপন তথ্য এনে দেয়, মেয়েরা কীভাবে যুদ্ধে যাওয়ার যুক্তি তুলে ধরে, পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়, শঙ্কা আর নৃশংসতাও উঠে আসতে থাকে সংগীতে সংগীতে। নানা ধরনের চেনা সুর ব্যবহার করা হয়েছে নাটকে। আর হ্যাঁ, একটি অসাধারণ সংগীতযন্ত্রের দেখা পাওয়া গেল মহড়াকক্ষে, কাঠ আর বাঁশ দিয়ে বানানো হয়েছে সেটি। নিজেদেরই আবিষ্কার। মামুনুর রশীদ বললেন, ‘এটার নাম দিয়েছি কাষ্ঠতরঙ্গ।’ এই কাষ্ঠতরঙ্গ থেকে যেভাবে আওয়াজ বের হলো, তাতে মনে হলো, সত্যিই ভয়াবহ গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গেছি আমরা!
মধ্যবিরতিতে মোগলাই পরোটা আর রং-চা খাওয়ার পর দীপক সুমন যখন সবাইকে আবার মহড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, তখন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘শুরুর দৃশ্যটা আরেকবার করো।’ অভিনয়শিল্পীরা যখন তৈরি হচ্ছেন, তখন মামুন ভাই ফিসফিস করে বলেন, ‘এটা একাত্তরের এপ্রিল মাসের কথা। বড় বড় প্রতিরোধ ভেঙে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণের চেষ্টা করছেন। অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে গ্রামের মানুষ।’ কথা শেষ হওয়ার আগেই সুরে সুরে ভেসে আসে সংলাপ, ‘এ জায়গা ছাড়তে হবে।’ ‘কেন? কেন? কেন?’ ‘আসছে ধেয়ে মিলিটারি,’ ‘আসুক আসুক আসুক’—এভাবেই গ্রামের মানুষ কথা বলতে থাকে। যুদ্ধে মেয়েদের নিতে অনীহা সেনাবাহিনীর এক সদস্যের। তার কথার উত্তরে মেডিকেল কলেজপড়ুয়া এক মেয়ে বলে, ‘বলে কী! আমি হাফ ডাক্তার, শেষ করেছি থার্ড ইয়ার। নাই কী রোগ-বালাই? লাগবে না ওষুধ-দাওয়াই?’
পাকিস্তানি সেনাদের দৃশ্যে আবদাল নামে এক চরিত্র বলে ওঠে, ‘দোস্ত, কই আদমি নেহি মিলেগা, ইয়ে এই বাঙাল মুলুককে আন্দর। এই মাটির ভেতরে আওর এক বাঙাল মুলুক হ্যায়। শুনো, কান খুলকে শুনো, হাজার হাজার আদমি দেখ, কিন্তু যেই অ্যাটাক করি, সব গায়েব। কাহা মিট্টি কা আন্দর পালা গিয়া।’
অসাধারণ প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর একেকজন অভিনয়শিল্পী। নাচের ভঙ্গিতে, গানের সুরে এরা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। জানা গেল, বহুদিন পর এই নাটকে মঞ্চ ও আলো করছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। সংগীত করছেন পরিমল মজুমদার।
বিদায়কালে মামুনুর রশীদকে বলি, ‘মঞ্চে এলে নাটকটি মাতিয়ে দেবে।’
মামুন ভাই হাসেন। তৃপ্তির হাসি।

No comments

Powered by Blogger.