ইউরোপের চিঠি-ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা রাজনীতির নতুন মাত্রা by পিটার কাস্টার্স
ন্যাটো সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে এবার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেল। ২০ নভেম্বর পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ন্যাটো সামরিক জোটের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে ২৮টি সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা একত্র হন। অবধারিতভাবেই এতে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে চলমান আফগান যুদ্ধ।
আফগান বিদ্রোহীরা (তালেবান) ন্যাটোর সব সদস্যরাষ্ট্রের জন্যই মাথাব্যথার কারণ। আফগানিস্তানে ন্যাটোর উপস্থিতি আপাতত ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যদিকে পারমাণবিক অস্ত্র-নিরোধকব্যবস্থার (নিউক্লিয়ার ডিটারেন্স) ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরিকল্পনা নিয়েও সম্মেলনে বিতর্ক ওঠে। এ ব্যাপারে ইউরোপের বড় দুই শক্তি ফ্রান্স ও জার্মানির অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সম্প্রতি ফ্রান্স ন্যাটোতে ফিরেছে। পারমাণবিক অস্ত্র-নিরোধকব্যবস্থা বিষয়ে তারা জোর দিয়েছে প্রচলিত চিন্তার প্রাসঙ্গিকতার ওপর। আর এ ব্যবস্থা পরিত্যাগ করার মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্ব কমানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে সমর্থন জানাল জার্মানি। কিন্তু লিসবন সম্মেলনের ফলাফল অনেকাংশেই গড়ে দিয়েছে ন্যাটো কর্তৃক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঢাল নির্মাণের বিষয়টি। ন্যাটোর মহাসচিব রাসমুসেন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন। এবার সামরিক জোটের সদস্যরাষ্ট্রগুলো তা অনুমোদন করল। ন্যাটোর নতুন পরিকল্পনা বিষয়ে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ-সমর্থিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঢাল নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করেছে রাশিয়া। কিন্তু এবার এ সম্মেলনে যোগ দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র পরিকল্পনায় তাঁর সহযোগিতার ব্যাপারে সতর্ক আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন।
সম্মেলন শেষে এর সাফল্যে ন্যাটোপ্রধান রাসমুসেন খুব খুশি। তিনি এটিকে ‘ঐতিহাসিক’ সম্মেলন বলে আখ্যায়িত করলেন। যদিও মনে হলো, বিশ্বের গণমাধ্যমের বড় অংশই স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেনি ঠিক কোন অর্থে ন্যাটোর সিদ্ধান্তগুলো নজিরবিহীন, কিংবা সেগুলো কীভাবে বাদবাকি দুনিয়াকে প্রভাবিত করবে, তবু সম্মেলনের ফলাফলের এই চিত্রায়ণ যৌক্তিক। এ ক্ষেত্রে শুরুতেই মনে রাখা দরকার, ওবামার সরকার ন্যাটোর নতুন পরিকল্পনাকে প্রবল উৎসাহে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। রাসমুসেন স্পষ্টত ন্যাটোর প্রবল প্রতাপশালী সদস্যরাষ্ট্রটির কথামতোই চলছেন। অথচ এই পরিকল্পনাটি মাত্র এক বছর আগে বাতিলের কথা বেশ জোরেশোরে বলেছিলেন ওবামা। তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও এমনটাই ছিল। তখন তিনি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার একটু সংযত সংস্করণের দিকেই ধাবিত হতে চেয়েছিলেন। স্থলবাহিনীর প্রতিরক্ষার লক্ষ্যে ‘থিয়েটার মিসাইল সিস্টেম’ (থাড) নামে ন্যাটো যে ক্ষেপণাস্ত্র ঢাল দাঁড় করেছে, এটা অনেকটা তার মতোই। ওবামার এ অবস্থানও এখন অতীত। তাই ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঢালকে যুক্তরাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার মানে ওবামার অবস্থানের নাটকীয় পরিবর্তন। এই পরিকল্পনার কেন্দ্রে এসএম-৩ রকেট। ইতিমধ্যে এই ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন যুদ্ধজাহাজে স্থাপন করা হয়েছে এবং সেখান থেকে হামলা চালানো যাবে। মার্কিন সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত করার এজিস (Aegis) প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এটা করা হয়েছে। যুদ্ধাস্ত্র তৈরির শীর্ষ পাঁচটি মার্কিন করপোরেশনের অন্যতম রেথিয়ন রকেটটি বানিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র সুরক্ষায় ন্যাটোকে একটি সাধারণ পরিকল্পনা গ্রহণে পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার যুদ্ধাস্ত্র তৈরির করপোরেশনের স্বার্থই রক্ষা করছে—এ দাবির পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণও মিলেছে। ন্যাটো সম্প্রসারণের ফলে নতুন যেসব দেশ আত্তীকৃত হয়েছে, তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে মার্কিন করপোরেশনগুলো অনেক লাভবান হওয়ার আশায় আছে।
তবে এই জায়গাতেই দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি নাগালের বাইরে থেকে যাবে। লিসবনে ন্যাটো যে সিদ্ধান্ত নিল, তাতে আটলান্টিকতাবাদের দুই রূপের মিলন হলো। আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পারের শিল্পোন্নত শক্তিগুলোর মধ্যকার সহযোগিতা এখন থেকে সামরিক এবং সামরিক-শিল্পসংক্রান্ত রূপ নিল। এ দিকটি বিবেচনা করতে হলে মার্কিন সামরিক খাতের সাপেক্ষে সরকারের নীতিগত বিবর্তনের ওপর নজর দেওয়া দরকার। নব্বইয়ের দশকে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সময়ে সামরিক খাত পুনর্গঠনের কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে। ওবামার মতো তিনিও ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা। প্রথম পর্যায়ে পুনর্গঠন-প্রক্রিয়াটি ছিল অভ্যন্তরীণ। তখন বেশ কয়েকটি অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হয় তার এত দিনকার প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে একীভূত হয়েছে, নয়তো অন্য কোনো করপোরেশন তাকে কিনে নিয়েছে। পরিণতিতে ১৯৯৮ সাল নাগাদ এ খাতে পাঁচটি বড় করপোরেশনের (মার্টিন-লকহিড, বোয়িং, রেথিয়ন, জেনারেল ডিনামিক্স ও নরথ্রোপ গ্রুম্যান) সুস্পষ্ট প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন আরেক ধরনের পুঁজির কেন্দ্রীভবনে উৎসাহ জোগাচ্ছে মার্কিন সরকার। আটলান্টিকের দুই পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় অস্ত্র প্রস্তুতকারকেরা এবারকার কেন্দ্রীভবনের ফলে একীভূত ও যৌথ উদ্যোগ নিতে পারবে।
এরূপ আটলান্টিকতাবাদ ঐতিহাসিকভাবে অভিনব। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র কখনো অস্ত্র করপোরেশনের দ্বারা আটলান্টিকের দুই পারে সামরিক মৈত্রী গঠন করেনি, কিংবা তাদের সেই আকাঙ্ক্ষাও দেখা যায়নি। তবে নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে মার্কিন সরকার যে কৌশলগত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল, তার নাটকীয় প্রভাব পড়েছিল পশ্চিম ইউরোপের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনেও। প্রধান প্রধান ইউরোপীয় রাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে সযতনে প্রতিরক্ষা খাতকে পাহারা দিয়ে রাখত। সেখানে ক্লিনটনের ট্রান্স-আটলান্টিসিজমের নতুন রূপ ইউরোপভিত্তিক অস্ত্র করপোরেশগুলোকে রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে একীভূত হওয়ার চাপ তৈরি করেছিল অথবা সেই চাপ অনুভব করার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আবারও পরিণতিতে পুঁজির কেন্দ্রীভবন অনেক বাড়ল; অল্পসংখ্যক বড় করপোরেশন তৈরি হলো। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ ইউরোপীয় অস্ত্র করপোরেশন মার্কিন করপোরেশনগুলোর তুলনায় ছোট আকারের (একমাত্র ব্যতিক্রম ব্রিটেনভিত্তিক বিএই সিস্টেমস)। তবে নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকেই প্রধান প্রধান মার্কিন এবং ইউরোপকেন্দ্রিক অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আটলান্টিকের অপর পারের কোনো সামরিক করপোরেশনের সঙ্গে এক বা একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। সুতরাং নতুন আটলান্টিকতাবাদের ধারণা অসার হয়ে ছিল না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণের দিকেই অগ্রসর হয়েছে। সেই লক্ষ্যটি হলো এমন এক বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা শিল্প গঠন, যেখানে সামগ্রিকভাবে মার্কিন করপোরেশনগুলোর কর্তৃত্ব থাকবে।
সবশেষে বলব, সংশয়ী বিশ্লেষকেরা যুক্তি দেখাতে পারেন যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাবিষয়ক আলোচনার সঙ্গে উল্লিখিত নববিন্যাসের তেমন সম্পর্ক নেই। প্রধান প্রধান ইউরোপীয় করপোরেশন তো ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রটিতেই তাদের নিজস্ব ইউরোপীয় সংঘ (কনসোর্টিয়াম) গড়ে তুলেছে। এমবিডিএ কোম্পানিটির ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। সাত বছর আগে তৈরি করা এই কোম্পানির ব্যবসা ২০০৭ সাল নাগাদ প্রায় তিন বিলিয়ন ইউরোতে গিয়ে ঠেকে। পর্তুগালে ন্যাটোর এবারের সিদ্ধান্তের পর নতুন অস্ত্র কেনার যে চাহিদা তৈরি হলো, তার বড় এক অংশ নিশ্চয়ই এমবিডিএ বাগাতে চেষ্টা করবে। তবে একটু আগে যে নতুন ট্রান্স-আটলান্টিসিজমের কথা বলেছি, তা থেকে এমবিডিএ পুরোপুরি বাইরে থাকবে, এমনটা মনে করা ঠিক হবে না। উল্টো খবর প্রকাশিত হয়েছে, পেন্টাগনের সঙ্গে এমবিডিএ বিশেষ নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আর তার আগে মার্কিন করপোরেশন বোয়িংয়ের সঙ্গে একত্রে কাজ করার ব্যাপারে অন্তত দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তি দুটির একটি বৈশ্বিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাবিষয়ক (২০০৪)। তাই এমবিডিএর বিষয়টি কোনো ব্যতিক্রম নয়, বরং লিসবন সম্মেলনের তাৎপর্যের যে ব্যাখ্যা আমি দিলাম, তার প্রতি সংগতিপূর্ণ। লিসবনে আমরা দুই ধরনের আটলান্টিকতাবাদের মিলন দেখলাম: ন্যাটোর প্রচলিত ধরনের (যেখানে আটলান্টিকের দুই পারের রাষ্ট্রগুলোর সামরিক বাহিনী একসঙ্গে মিলে কাজ করে) সঙ্গে নতুন ধরনের আটলান্টিকতাবাদের (যেখানে অস্ত্র প্রস্তুতকারকেরা পরস্পর সম্পর্কিত)। আর তাতে রাশিয়ার শঙ্কিত হওয়ার তেমন কারণ না থাকলেও চীন ও ব্রাজিলের মতো রাষ্ট্রের আশ্বস্ত হওয়ার বিশেষ কারণ নেই। নিজস্ব ঐতিহাসিক আওতা ছাপিয়ে ন্যাটো এখন নতুন সামরিক ভূমিকা গ্রহণের অঙ্গীকার করেছে। আফগান যুদ্ধের দিকে দেখুন, আর ভাবুন আটলান্টিকতাবাদের দুই রূপের মিলনের পরিণতি কেমন হতে পারে!
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ; প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
সম্মেলন শেষে এর সাফল্যে ন্যাটোপ্রধান রাসমুসেন খুব খুশি। তিনি এটিকে ‘ঐতিহাসিক’ সম্মেলন বলে আখ্যায়িত করলেন। যদিও মনে হলো, বিশ্বের গণমাধ্যমের বড় অংশই স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেনি ঠিক কোন অর্থে ন্যাটোর সিদ্ধান্তগুলো নজিরবিহীন, কিংবা সেগুলো কীভাবে বাদবাকি দুনিয়াকে প্রভাবিত করবে, তবু সম্মেলনের ফলাফলের এই চিত্রায়ণ যৌক্তিক। এ ক্ষেত্রে শুরুতেই মনে রাখা দরকার, ওবামার সরকার ন্যাটোর নতুন পরিকল্পনাকে প্রবল উৎসাহে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। রাসমুসেন স্পষ্টত ন্যাটোর প্রবল প্রতাপশালী সদস্যরাষ্ট্রটির কথামতোই চলছেন। অথচ এই পরিকল্পনাটি মাত্র এক বছর আগে বাতিলের কথা বেশ জোরেশোরে বলেছিলেন ওবামা। তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও এমনটাই ছিল। তখন তিনি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার একটু সংযত সংস্করণের দিকেই ধাবিত হতে চেয়েছিলেন। স্থলবাহিনীর প্রতিরক্ষার লক্ষ্যে ‘থিয়েটার মিসাইল সিস্টেম’ (থাড) নামে ন্যাটো যে ক্ষেপণাস্ত্র ঢাল দাঁড় করেছে, এটা অনেকটা তার মতোই। ওবামার এ অবস্থানও এখন অতীত। তাই ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঢালকে যুক্তরাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার মানে ওবামার অবস্থানের নাটকীয় পরিবর্তন। এই পরিকল্পনার কেন্দ্রে এসএম-৩ রকেট। ইতিমধ্যে এই ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন যুদ্ধজাহাজে স্থাপন করা হয়েছে এবং সেখান থেকে হামলা চালানো যাবে। মার্কিন সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত করার এজিস (Aegis) প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এটা করা হয়েছে। যুদ্ধাস্ত্র তৈরির শীর্ষ পাঁচটি মার্কিন করপোরেশনের অন্যতম রেথিয়ন রকেটটি বানিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র সুরক্ষায় ন্যাটোকে একটি সাধারণ পরিকল্পনা গ্রহণে পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার যুদ্ধাস্ত্র তৈরির করপোরেশনের স্বার্থই রক্ষা করছে—এ দাবির পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণও মিলেছে। ন্যাটো সম্প্রসারণের ফলে নতুন যেসব দেশ আত্তীকৃত হয়েছে, তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে মার্কিন করপোরেশনগুলো অনেক লাভবান হওয়ার আশায় আছে।
তবে এই জায়গাতেই দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি নাগালের বাইরে থেকে যাবে। লিসবনে ন্যাটো যে সিদ্ধান্ত নিল, তাতে আটলান্টিকতাবাদের দুই রূপের মিলন হলো। আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পারের শিল্পোন্নত শক্তিগুলোর মধ্যকার সহযোগিতা এখন থেকে সামরিক এবং সামরিক-শিল্পসংক্রান্ত রূপ নিল। এ দিকটি বিবেচনা করতে হলে মার্কিন সামরিক খাতের সাপেক্ষে সরকারের নীতিগত বিবর্তনের ওপর নজর দেওয়া দরকার। নব্বইয়ের দশকে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সময়ে সামরিক খাত পুনর্গঠনের কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে। ওবামার মতো তিনিও ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা। প্রথম পর্যায়ে পুনর্গঠন-প্রক্রিয়াটি ছিল অভ্যন্তরীণ। তখন বেশ কয়েকটি অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হয় তার এত দিনকার প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে একীভূত হয়েছে, নয়তো অন্য কোনো করপোরেশন তাকে কিনে নিয়েছে। পরিণতিতে ১৯৯৮ সাল নাগাদ এ খাতে পাঁচটি বড় করপোরেশনের (মার্টিন-লকহিড, বোয়িং, রেথিয়ন, জেনারেল ডিনামিক্স ও নরথ্রোপ গ্রুম্যান) সুস্পষ্ট প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন আরেক ধরনের পুঁজির কেন্দ্রীভবনে উৎসাহ জোগাচ্ছে মার্কিন সরকার। আটলান্টিকের দুই পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় অস্ত্র প্রস্তুতকারকেরা এবারকার কেন্দ্রীভবনের ফলে একীভূত ও যৌথ উদ্যোগ নিতে পারবে।
এরূপ আটলান্টিকতাবাদ ঐতিহাসিকভাবে অভিনব। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র কখনো অস্ত্র করপোরেশনের দ্বারা আটলান্টিকের দুই পারে সামরিক মৈত্রী গঠন করেনি, কিংবা তাদের সেই আকাঙ্ক্ষাও দেখা যায়নি। তবে নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে মার্কিন সরকার যে কৌশলগত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল, তার নাটকীয় প্রভাব পড়েছিল পশ্চিম ইউরোপের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনেও। প্রধান প্রধান ইউরোপীয় রাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে সযতনে প্রতিরক্ষা খাতকে পাহারা দিয়ে রাখত। সেখানে ক্লিনটনের ট্রান্স-আটলান্টিসিজমের নতুন রূপ ইউরোপভিত্তিক অস্ত্র করপোরেশগুলোকে রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে একীভূত হওয়ার চাপ তৈরি করেছিল অথবা সেই চাপ অনুভব করার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আবারও পরিণতিতে পুঁজির কেন্দ্রীভবন অনেক বাড়ল; অল্পসংখ্যক বড় করপোরেশন তৈরি হলো। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ ইউরোপীয় অস্ত্র করপোরেশন মার্কিন করপোরেশনগুলোর তুলনায় ছোট আকারের (একমাত্র ব্যতিক্রম ব্রিটেনভিত্তিক বিএই সিস্টেমস)। তবে নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকেই প্রধান প্রধান মার্কিন এবং ইউরোপকেন্দ্রিক অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আটলান্টিকের অপর পারের কোনো সামরিক করপোরেশনের সঙ্গে এক বা একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। সুতরাং নতুন আটলান্টিকতাবাদের ধারণা অসার হয়ে ছিল না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণের দিকেই অগ্রসর হয়েছে। সেই লক্ষ্যটি হলো এমন এক বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা শিল্প গঠন, যেখানে সামগ্রিকভাবে মার্কিন করপোরেশনগুলোর কর্তৃত্ব থাকবে।
সবশেষে বলব, সংশয়ী বিশ্লেষকেরা যুক্তি দেখাতে পারেন যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাবিষয়ক আলোচনার সঙ্গে উল্লিখিত নববিন্যাসের তেমন সম্পর্ক নেই। প্রধান প্রধান ইউরোপীয় করপোরেশন তো ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রটিতেই তাদের নিজস্ব ইউরোপীয় সংঘ (কনসোর্টিয়াম) গড়ে তুলেছে। এমবিডিএ কোম্পানিটির ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। সাত বছর আগে তৈরি করা এই কোম্পানির ব্যবসা ২০০৭ সাল নাগাদ প্রায় তিন বিলিয়ন ইউরোতে গিয়ে ঠেকে। পর্তুগালে ন্যাটোর এবারের সিদ্ধান্তের পর নতুন অস্ত্র কেনার যে চাহিদা তৈরি হলো, তার বড় এক অংশ নিশ্চয়ই এমবিডিএ বাগাতে চেষ্টা করবে। তবে একটু আগে যে নতুন ট্রান্স-আটলান্টিসিজমের কথা বলেছি, তা থেকে এমবিডিএ পুরোপুরি বাইরে থাকবে, এমনটা মনে করা ঠিক হবে না। উল্টো খবর প্রকাশিত হয়েছে, পেন্টাগনের সঙ্গে এমবিডিএ বিশেষ নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আর তার আগে মার্কিন করপোরেশন বোয়িংয়ের সঙ্গে একত্রে কাজ করার ব্যাপারে অন্তত দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তি দুটির একটি বৈশ্বিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাবিষয়ক (২০০৪)। তাই এমবিডিএর বিষয়টি কোনো ব্যতিক্রম নয়, বরং লিসবন সম্মেলনের তাৎপর্যের যে ব্যাখ্যা আমি দিলাম, তার প্রতি সংগতিপূর্ণ। লিসবনে আমরা দুই ধরনের আটলান্টিকতাবাদের মিলন দেখলাম: ন্যাটোর প্রচলিত ধরনের (যেখানে আটলান্টিকের দুই পারের রাষ্ট্রগুলোর সামরিক বাহিনী একসঙ্গে মিলে কাজ করে) সঙ্গে নতুন ধরনের আটলান্টিকতাবাদের (যেখানে অস্ত্র প্রস্তুতকারকেরা পরস্পর সম্পর্কিত)। আর তাতে রাশিয়ার শঙ্কিত হওয়ার তেমন কারণ না থাকলেও চীন ও ব্রাজিলের মতো রাষ্ট্রের আশ্বস্ত হওয়ার বিশেষ কারণ নেই। নিজস্ব ঐতিহাসিক আওতা ছাপিয়ে ন্যাটো এখন নতুন সামরিক ভূমিকা গ্রহণের অঙ্গীকার করেছে। আফগান যুদ্ধের দিকে দেখুন, আর ভাবুন আটলান্টিকতাবাদের দুই রূপের মিলনের পরিণতি কেমন হতে পারে!
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ; প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
No comments