বাঘা তেঁতুল-উপদেশের খেসারত by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বেহুদা কথাবার্তা শুনে সাধারণত লোকে হাসে। কখনো কেউ কাঁদেনও। যেমন কেঁদেছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তবে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের যে চরিত্র, তাতে বেহুদা কথা বললে সংবাদের শিরোনাম হওয়া সহজ। সংসদে কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কোন দলের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে, সেই
আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে একটু সময় লাগছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার তর সইছিল না। তিনি বলে বসলেন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ক্ষমতা ছাড়তে চাইছেন না। এই অপবাদে আহত হয়ে পঞ্চম সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে বিচারপতি কেঁদে দিলেন।
প্রধান বিরোধী দলের এক নেতা, যিনি সাহাবুদ্দীন আহমদের চোখে পানি এনেছিলেন, তিনি বেহুদা কথাবার্তা বলার কারণে কয়েক দিন আগে বহিষ্কৃত হয়েছেন। বহিষ্কৃত হওয়ার পরে তিনি এক সাংবাদিককে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ‘কথা বলার জন্য এত বড় শাস্তি হয়, তা আমার জানা ছিল না।’
বাংলাদেশে বেহুদা কথা বলার জন্যই শাস্তি হয়, বেআইনি কাজ করার জন্য নয়। বিশেষত, দলের নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে কথা বললে শাস্তি অবধারিত। কিন্তু কোনো যোগাযোগমন্ত্রী যদি বেআইনিভাবে তাঁর স্ত্রীর সংগঠনকে বাড়িঘর বানানোর জন্য রেলের জমি দান করেন, তাতে কোনো শাস্তির ভয় নেই।
সাহাবুদ্দীন সাহেব কেঁদেছেন একবার, এই নেতার দলের নেত্রীকে কাঁদতে হয়েছে দুবার। একবার বসতবাড়ির ভিটামাটি হারিয়ে, দ্বিতীয়বার দলের নেতার মুখে তাঁর প্রথম কান্না ‘ঠিক হয়নি’ কথাটি শুনে। যখন দল-মতনির্বিশেষে সবার সহানুভূতি তাঁর প্রয়োজন, তখন দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি তাঁকে দিলেন উপদেশ। জীবনের কোনো কোনো মুহূর্তে উপদেশের চেয়ে সান্ত্বনা মূল্যবান। উপদেশ কখনো শরীরে গিয়ে তীরের মতো বিঁধে।
উপদেশ তাঁর কাছে কেউ চায়নি, তিনি আগ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘নেত্রীর “আবেগপ্রবণ হয়ে হতাশ ও ভেঙে পড়া সঠিক হয়নি”। তাঁর “আপসহীন” চরিত্রের সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা বেমানান।’ উপদেশটা নেত্রীর বাড়িতে গিয়ে দিলে বেশ হতো। হাটবাজারের মধ্যে মুখে চোঙা নিয়ে উপদেশ দেওয়াও শোভন নয়।
শুধু উপদেশ নয়, তিনি নেত্রীর পক্ষে আদালতে না গিয়ে তিরস্কার করেছেন তাঁর দলের সেই আইনজীবীদের, যাঁরা কোর্টে দৌড়ঝাঁপ করেছেন; নেত্রীর ভিটামাটি ছাড়ার দায়দায়িত্ব তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন তাঁদের ঘাড়ে। আইনজীবীরা তাঁদের এই অপমানের প্রতিকার চেয়েছিলেন। বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রতিকার ও সান্ত্বনা দুই-ই তাঁরা পেয়েছেন।
দল যদি তাঁকে ভাগিয়ে দেয়, তখন তিনি যাবেন কোথায়? সে পথও তিনি মোটামুটি পাকা করে রেখেছেন। বহুকাল একটি কথা তিনি মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সেটি তিনি সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন। বললেন: ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব আদর করতেন।’
চৌত্রিশ বছর যাঁর নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান, এবার তিনি প্রমোশন পেয়ে হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। আদর করতেন বলেই তিনি হয়তো তাঁকে বলেছিলেন, আমার দল ভালো না। আমি নিহত হওয়ার পর তুই জিয়ার দলে যোগ দিস। আর তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে খবরদার আমার মৃত্যুবার্ষিকীতে বিটিভিতে আমার জন্য কোনো অনুষ্ঠান করতে দিবি না। আদরগ্রহীতা হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নামটিও তিনি বিটিভিতে উচ্চারণ করতে দেননি।
দলীয় রাজনীতি কী জিনিস, তা নেতারা খুব ভালো জানেন। দলীয় শৃঙ্খলা বলেও একটি জিনিস আছে। দলের বৈঠকে কোনো ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ এক কথা, রাস্তাঘাটে লোকজনের মধ্যে বাকস্বাধীনতার থিওরি এস্তেমাল করা অন্য জিনিস। ভলটেয়ারের মতো বাকস্বাধীন হতে চাইলে দলের বন্ধন ছিন্ন করা ভালো। সোনিয়া গান্ধীকে কটাক্ষ করে কংগ্রেস রাজনীতি করা যায় না। দল ছেড়ে অন্য দল গঠন করা যায়।
দুই নেত্রীকে এক ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে পোলাও-কোরমা খাওয়ানোর কামনা যদি কারও হয়ে থাকে, তা খুব ভালো কথা। তাঁর ডাকে তাঁর নেত্রী যদি টেবিলে গিয়ে বসেনও, অপর নেত্রী যে বসবেন সে নিশ্চয়তা তিনি কোথায় পেলেন? তাঁর সঙ্গে কি গোপনে যোগাযোগ হয়েছে? দুই নেত্রীর মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দিতে চাই—এটা মুরব্বির কাজ। মুরব্বি এক জিনিস, আর মুরব্বি না হয়ে মুরব্বিয়ানা আরেক জিনিস। মুরব্বিয়ানার অধিকার সবার নেই।
বাস্তুহারাদের নিয়ে সমিতি গঠন করা যায়, বাস্তুহারা নেত্রীকে নিয়ে পলিটিকস করা এক বিশ্রী খেলা। অভিজ্ঞ আইনজীবী ও রাজনীতিক কি জানেন না, একবার পেয়ে কোনো কিছু হারানোর বেদনা অবর্ণনীয়। তা সেটা সেনানিবাসের বাড়িঘরই হোক বা রেলের নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দ পাওয়া জমিই হোক।
আমাদের রাজনীতির নোংরামি আজ বহুমাত্রিক—এক রকম নয়। আমাদের মিডিয়াও আজকাল রগড় করা পছন্দ করে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের পর ভারতবর্ষের কাগজ যত বড় শিরোনাম করেছিল, আমাদের নেতার বহিষ্কারের সংবাদ তার চেয়ে বড়। দেশের অনেক বড় বড় ঘটনার কাগজে ঠাঁই নেই। দেশের সম্পদ ‘বহিষ্কৃত’ হলে বা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার আয়োজন হলে মাথাব্যথা নেই। এক নেতা দল থেকে বহিষ্কৃত হলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমাদের এই চরিত্রের বদল না হলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
প্রধান বিরোধী দলের এক নেতা, যিনি সাহাবুদ্দীন আহমদের চোখে পানি এনেছিলেন, তিনি বেহুদা কথাবার্তা বলার কারণে কয়েক দিন আগে বহিষ্কৃত হয়েছেন। বহিষ্কৃত হওয়ার পরে তিনি এক সাংবাদিককে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ‘কথা বলার জন্য এত বড় শাস্তি হয়, তা আমার জানা ছিল না।’
বাংলাদেশে বেহুদা কথা বলার জন্যই শাস্তি হয়, বেআইনি কাজ করার জন্য নয়। বিশেষত, দলের নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে কথা বললে শাস্তি অবধারিত। কিন্তু কোনো যোগাযোগমন্ত্রী যদি বেআইনিভাবে তাঁর স্ত্রীর সংগঠনকে বাড়িঘর বানানোর জন্য রেলের জমি দান করেন, তাতে কোনো শাস্তির ভয় নেই।
সাহাবুদ্দীন সাহেব কেঁদেছেন একবার, এই নেতার দলের নেত্রীকে কাঁদতে হয়েছে দুবার। একবার বসতবাড়ির ভিটামাটি হারিয়ে, দ্বিতীয়বার দলের নেতার মুখে তাঁর প্রথম কান্না ‘ঠিক হয়নি’ কথাটি শুনে। যখন দল-মতনির্বিশেষে সবার সহানুভূতি তাঁর প্রয়োজন, তখন দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি তাঁকে দিলেন উপদেশ। জীবনের কোনো কোনো মুহূর্তে উপদেশের চেয়ে সান্ত্বনা মূল্যবান। উপদেশ কখনো শরীরে গিয়ে তীরের মতো বিঁধে।
উপদেশ তাঁর কাছে কেউ চায়নি, তিনি আগ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘নেত্রীর “আবেগপ্রবণ হয়ে হতাশ ও ভেঙে পড়া সঠিক হয়নি”। তাঁর “আপসহীন” চরিত্রের সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা বেমানান।’ উপদেশটা নেত্রীর বাড়িতে গিয়ে দিলে বেশ হতো। হাটবাজারের মধ্যে মুখে চোঙা নিয়ে উপদেশ দেওয়াও শোভন নয়।
শুধু উপদেশ নয়, তিনি নেত্রীর পক্ষে আদালতে না গিয়ে তিরস্কার করেছেন তাঁর দলের সেই আইনজীবীদের, যাঁরা কোর্টে দৌড়ঝাঁপ করেছেন; নেত্রীর ভিটামাটি ছাড়ার দায়দায়িত্ব তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন তাঁদের ঘাড়ে। আইনজীবীরা তাঁদের এই অপমানের প্রতিকার চেয়েছিলেন। বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রতিকার ও সান্ত্বনা দুই-ই তাঁরা পেয়েছেন।
দল যদি তাঁকে ভাগিয়ে দেয়, তখন তিনি যাবেন কোথায়? সে পথও তিনি মোটামুটি পাকা করে রেখেছেন। বহুকাল একটি কথা তিনি মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সেটি তিনি সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন। বললেন: ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব আদর করতেন।’
চৌত্রিশ বছর যাঁর নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান, এবার তিনি প্রমোশন পেয়ে হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। আদর করতেন বলেই তিনি হয়তো তাঁকে বলেছিলেন, আমার দল ভালো না। আমি নিহত হওয়ার পর তুই জিয়ার দলে যোগ দিস। আর তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে খবরদার আমার মৃত্যুবার্ষিকীতে বিটিভিতে আমার জন্য কোনো অনুষ্ঠান করতে দিবি না। আদরগ্রহীতা হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নামটিও তিনি বিটিভিতে উচ্চারণ করতে দেননি।
দলীয় রাজনীতি কী জিনিস, তা নেতারা খুব ভালো জানেন। দলীয় শৃঙ্খলা বলেও একটি জিনিস আছে। দলের বৈঠকে কোনো ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ এক কথা, রাস্তাঘাটে লোকজনের মধ্যে বাকস্বাধীনতার থিওরি এস্তেমাল করা অন্য জিনিস। ভলটেয়ারের মতো বাকস্বাধীন হতে চাইলে দলের বন্ধন ছিন্ন করা ভালো। সোনিয়া গান্ধীকে কটাক্ষ করে কংগ্রেস রাজনীতি করা যায় না। দল ছেড়ে অন্য দল গঠন করা যায়।
দুই নেত্রীকে এক ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে পোলাও-কোরমা খাওয়ানোর কামনা যদি কারও হয়ে থাকে, তা খুব ভালো কথা। তাঁর ডাকে তাঁর নেত্রী যদি টেবিলে গিয়ে বসেনও, অপর নেত্রী যে বসবেন সে নিশ্চয়তা তিনি কোথায় পেলেন? তাঁর সঙ্গে কি গোপনে যোগাযোগ হয়েছে? দুই নেত্রীর মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দিতে চাই—এটা মুরব্বির কাজ। মুরব্বি এক জিনিস, আর মুরব্বি না হয়ে মুরব্বিয়ানা আরেক জিনিস। মুরব্বিয়ানার অধিকার সবার নেই।
বাস্তুহারাদের নিয়ে সমিতি গঠন করা যায়, বাস্তুহারা নেত্রীকে নিয়ে পলিটিকস করা এক বিশ্রী খেলা। অভিজ্ঞ আইনজীবী ও রাজনীতিক কি জানেন না, একবার পেয়ে কোনো কিছু হারানোর বেদনা অবর্ণনীয়। তা সেটা সেনানিবাসের বাড়িঘরই হোক বা রেলের নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দ পাওয়া জমিই হোক।
আমাদের রাজনীতির নোংরামি আজ বহুমাত্রিক—এক রকম নয়। আমাদের মিডিয়াও আজকাল রগড় করা পছন্দ করে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের পর ভারতবর্ষের কাগজ যত বড় শিরোনাম করেছিল, আমাদের নেতার বহিষ্কারের সংবাদ তার চেয়ে বড়। দেশের অনেক বড় বড় ঘটনার কাগজে ঠাঁই নেই। দেশের সম্পদ ‘বহিষ্কৃত’ হলে বা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার আয়োজন হলে মাথাব্যথা নেই। এক নেতা দল থেকে বহিষ্কৃত হলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমাদের এই চরিত্রের বদল না হলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments