সরল গরল-মহামান্য আপিল বিভাগের কাছে একটি নিবেদন by মিজানুর রহমান খান
মহামান্য আপিল বিভাগের কাছে অনুরোধ, এই নিবন্ধটি যাতে একটি আবেদন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা উদ্বিগ্ন যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নামের দুটি শক্তি আদালত চত্বরকে, এমনকি আদালতের রায়কে যখন যেমন লাগে, তখন তেমন করে ব্যবহারের মহড়া দেখাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট বারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত।
মন্ত্রিসভা দ্বৈত ভোট-ব্যবস্থা পাস করল। এতে বারের নির্বাচনে চর দখলের লড়াই দেখা যাবে। সুপ্রিম কোর্ট বারের নেতারা ইতিমধ্যে বিভক্ত সভা করছেন। আওয়ামী লীগের সমর্থক নেতারা অবৈধভাবে বারের সভা ডাকছেন। যা হোক, আদালতপাড়ায় অশনিসংকেত।
আজ ২৯ নভেম্বর খালেদা জিয়ার বাড়ির মামলার শুনানির দিন ধার্য আছে। আজ শুনানি হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। তবে শুনানি ও সিদ্ধান্ত যখনই হোক, এর সঙ্গে ২০০৫ সালের ২৩ মে (সুয়োমোটো এক্সপার্টি অর্ডার নম্বর ১) বিচারপতি আবদুল মতিনের দেওয়া একতরফা আদেশের কার্যকারিতার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ওই আদেশে নিষিদ্ধ বিক্ষোভ আজ ২৯ নভেম্বর সারা দেশের বারে বিএনপির আইনজীবীরা করবেন। এর ফলে তাঁরা সন্দেহাতীতভাবে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার হবে না। আমরা দেখব, এক ব্যক্তি জেনেশুনে আদালত অবমাননা করছেন। আবার আদালতে তিনি একই অপরাধের দায়ে অন্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। এটা একটা প্রহসন।
পাঠক ভাবতে পারেন যে, আমাদের এই কথাবার্তা সরকারের প্রতি পক্ষপাতমূলক। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, পুরো ঘটনা জানুন, এই নিবন্ধের পুরোটা পড়ুন, তখন দেখবেন, সরকার আর বিরোধী পক্ষ বলে কিছু নেই। আদালতকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দুই পক্ষই সমান। বিচারপতি আবদুল মতিনের ওই আদেশ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলমের স্ববিরোধিতা দেখার মতো। ২০০৫ সালে তিনি মুখে কালো কাপড় বেঁধে ওই আদেশের প্রতিবাদ করেছিলেন। ২০১০ সালে এসে বিএনপিপন্থীদের বাড়াবাড়ি দেখে অ্যাটর্নি জেনারেল বিরক্ত। ১১ নভেম্বর তিনি সাংবাদিকদের বললেন, আদালত চত্বরে মিছিল না করার বিষয়ে হাইকোর্টের একটি রায় আছে। আওয়ামী আইনজীবী ফরিদুল আলম (কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক) বিচারপতি মতিনের আদেশের কপিতে বার কাউন্সিল বৈঠকে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন। সেই একই জোশ এখন জাতীয়তাবাদীদের পেয়ে বসেছে।
সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে ওই আদেশ দেন। খালেদা জিয়া সেটা অমান্য করবেন। তিনি হুমকি দেবেন। তাঁর সমর্থক আইনজীবীরা ঘোষণা দিয়ে সারা দেশের বারে বিক্ষোভ করবেন। তাঁর নেতৃত্বে ১০৮ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হতে থাকবে, আর ঠিক তখন সুপ্রিম কোর্ট তাঁর অনুকূলে ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রতিকার প্রদানে শুনানি করবেন—সেটা যুক্তিগ্রাহ্য কিংবা প্রীতিপ্রদ মনে হয় না। যদিও আমরা মনে করি, লিভ টু আপিল ও স্থগিতাদেশের শুনানি ঝুলে থাকা অবস্থায় দেশের ছায়া প্রধানমন্ত্রীকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ আইন বা রেওয়াজ সংগত কি না, সেটা বিচারের দাবি রাখে। তবে আমাদের রাজনীতির অনিষ্ট কালচার ক্রমশ আক্ষরিক অর্থে আদালত অঙ্গনে ঢুকে পড়ছে কি না, সেটা আজ এক জ্বলন্ত প্রশ্ন।
আদালত অবমাননা মামলা বনাম অবৈধ নোটিশ
সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৩ নভেম্বর খালেদা জিয়া দুটি আবেদন করেন। একটিতে তিনি নিষেধাজ্ঞা চান। সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় ‘আপিল বিভাগ অবমাননা’ মামলা দায়ের করা হয়েছে। খালেদা জিয়া-সমর্থিত কিংবা নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম লিফলেট প্রচার করেছে। তাতে বলা আছে, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার অবৈধ নোটিশ প্রত্যাহারের দাবিতে’ বাংলাদেশের সকল জেলা বারে ২৯ নভেম্বর বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ হবে। অথচ খালেদা জিয়া বিষয়টিকে ‘সাবজুডিশ’ বিবেচনায় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। এই ‘অবৈধ’ শব্দ যদি বিএনপি বলত, তাহলে একটা সান্ত্বনা ছিল। কিন্তু এটা বলছে আইনজীবী ফোরাম। ৩০ নভেম্বর সারা দেশে হরতাল আহ্বান প্রকারান্তরে আদালতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস। এটা হবে আওয়ামী লীগের আগামীর কর্মসূচি। বিত্তশালী শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কী, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে চলেছি।
খালেদা জিয়া তিন সচিবসহ আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় আদালত অবমাননার মামলা করেছেন। সরকার খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়তে ২৪ মে ২০০৯ চূড়ান্ত নোটিশ দিয়েছিল। এর মূল কথা ছিল, ১৯৮১ সালে তাঁকে যে ইজারা চুক্তির মাধ্যমে বাড়িটি দেওয়া হয়েছিল, সেটি অবৈধ ছিল। গোড়া থেকে বাতিল ছিল। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন খালেদা জিয়া। সরকার নয়, তিনিই বিষয়টিকে আদালতে নিয়ে যান। আদালতে যখন একজন নাগরিক প্রতিকার প্রার্থনা করেন, তখন তিনি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে অঙ্গীকার করেন যে তিনি রায় মানবেন। খালেদা জিয়া হাইকোর্টের কাছ থেকে ১৩ অক্টোবর রায় পেয়েছেন। এই রায় তাঁর পক্ষে যায়নি। ১০ নভেম্বর এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ দেননি। রীতি অনুযায়ী চাওয়াও হয়নি। কিন্তু তাই বলে ১৩ নভেম্বরে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ না করলে আদালত অবমাননা ঘটত না। স্থগিতাদেশ না চেয়ে হয়তো ফাঁদ পাতা হয়েছিল, সেই ফাঁদে সরকারি দল পা দিয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ের পরে বাড়ি ছাড়তে হলে কান্নাপর্ব থাকত অন্তঃপুরে। আপাতত বিএনপির বিরাট স্বার্থসিদ্ধি, সুপ্রিম কোর্ট ও সেনাবাহিনী নতুন বিতর্কের পাদপ্রদীপে। অবশ্য তাতে অতি উৎসাহীদের পুরস্কৃত হতে আটকাবে না। লক্ষণীয় হলো জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আজকের কর্মসূচি। বাড়ি নিয়ে মামলার মূল বিষয় ছিল ২০০৯ সালের নোটিশ। খালেদা জিয়া উক্তরূপ ‘অবৈধ নোটিশ’ উল্লেখ করাজনিত আদালত অবমাননার দায় এড়াতে পারেন না।
আদালতের কাছে চার প্রশ্ন
চারটি প্রশ্ন আমাদের মনে। প্রথমত, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও সম্পাদক মো. বদরুদোজ্জা আদালত অবমাননার আবেদনে তাঁদের পদবি ব্যবহার করেছেন। ১৩ নভেম্বর জারি করা আইনজীবী সনদে বার সভাপতির প্যাড ব্যবহার করেছেন। এ কারণে বার কাউন্সিল অ্যাক্টে বর্ণিত আচরণবিধির লঙ্ঘন ঘটেছে কি না। কারণ খালেদা জিয়া আইনের চোখে তাঁদের কাছে মক্কেল ছাড়া কিছুই নন।
দ্বিতীয়ত, আপিল বিভাগের ১৯৯১ সালের ১০ জুনের একটি রায় অনুযায়ী সরকারি কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল কি না ১৩ নভেম্বরের তথাকথিত আইনজীবী সনদ আমলে নেওয়া।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ’৯১ সালে নিম্ন আদালত সনদ পেয়ে কী করবেন, সে বিষয়ে রায় দেন। রীতিনীতি ঠিক করেন। সেটা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের জন্যও প্রযোজ্য মনে করি। আপিল বিভাগের যুক্তি হলো, যে ক্ষেত্রে সনদের যথার্থতা নিয়ে নিম্ন আদালত প্রশ্ন তুলবেন, সে ক্ষেত্রে তাঁরা আইনজীবীকে হলফনামা দিতে বলবেন। সন্দেহ না থাকলে তা পালন করতে হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে আদেশ আসেনি বলে আইনজীবীকে অবজ্ঞা করতে পারবেন না। ওই রায়ের মূল কথা হলো, ‘আদালতের আদেশ’ আইনজীবী পৌঁছে দিলে তাঁকে অবিশ্বাস করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো, আইনজীবী রফিক-উল হক, মওদুদ আহমদ ও বারের সভাপতি ও সম্পাদক উচ্ছেদের দিন ‘আদালতের আদেশ’ জাহাঙ্গীর গেটে পৌঁছে দিয়েছিলেন কি না। রাষ্ট্রপক্ষকে নোটিশ না দিয়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যাওয়ার কি সুযোগ ছিল? আমরা আরও জানতে চাই, প্রধান বিচারপতির বরাতে যা বলা হয়েছে, তা বলার সুযোগ প্রধান বিচারপতির ছিল কি না। না থাকলে এ রকম সনদ জারি করায় ও তা অমান্য হওয়ায় জনগণের কাছে প্রধান বিচারপতি তথা সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা কোথায় দাঁড়াল?
তৃতীয়ত, ‘আইনজীবী সনদে’ আমরা দুই রকম তথ্য দেখি। ১৩ নভেম্বরে সনদ বলেছে, ‘প্রধান বিচারপতি নির্দিষ্টভাবে আশ্বস্ত করেছেন যে, খালেদা জিয়াকে মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে না।’ আমরা লক্ষ করি, প্রধান বিচারপতির কথিত ওই আশ্বাস ১১ দিনের ব্যবধানে বদলে গেছে। আপিল বিভাগে একই আইনজীবীরা হলফনামা দেন ২৩ নভেম্বর। এতে তাঁরা বলেন, ‘ওই দিন সকাল নয়টায় তাঁরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এবং তাঁকে পরিস্থিতি অবহিত করেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেন, সরকার আবেদনকারীকে তাঁর বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য করতে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। এবং তিনি সে কথা হয়তো সৎ বিশ্বাসে বলেছেন, কারণ ২৯ নভেম্বরে লিভ পিটিশন ও স্থগিতাদেশের আবেদন শুনানির জন্য পেন্ডিং রয়েছে। তখন সরকার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে অবশ্যই কোনো পদক্ষেপ নেবে না।’ প্রধান বিচারপতির বরাতে কথা কিন্তু দুই রকম হলো।
মান্য হচ্ছে না আদালতের আদেশ
এখানে আমরা আরও লক্ষ করি, প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যকে ২৩ নভেম্বরের আবেদনে ‘আদালতের আদেশ’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। সুতরাং আজকের মামলাগুলোর শুনানি নিঃসন্দেহে দারুণ কৌতূহলোদ্দীপক।
বিচারপতি মো. আবদুল মতিন ও বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২৩ মে ২০০৫ লিখেছেন, ‘আমরা সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় একতরফা আদেশ দিচ্ছি যে, বাংলাদেশ লিগেল প্র্যাকটিশনার এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২-এর ২০ ধারার আওতায় তালিকাভুক্ত সকল আইনজীবীর জন্য এটা প্রযোজ্য হবে। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আদালতের চত্বরে কিংবা আদালতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোন প্রকারের সভা, সমাবেশ বা পিকেটিং বা কোন ধরনের ঘেরাও চলবে না। সুপ্রিম কোর্ট বা বাংলাদেশের কোন আদালত চত্বরে কোন আইনজীবী সমিতি বা ফোরামের (আজ সারা দেশে হাইকোর্টের ওই রায় লঙ্ঘন আন্দোলনের অন্যতম হুকুমদাতা হলেন ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এমপি) নামে কোনো ধরনের সভা, মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট করা যাবে না।’ এমনকি আদালতের ওই আদেশের ৪ নম্বর নির্দেশনায় বলা আছে, ‘এ বিষয়ে কোন লিফলেট (আমাদের হাতে লিফলেট আছে) ব্যানার বা এ সম্পর্কিত কোন বিবৃতি প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি গণমাধ্যমেও তা প্রকাশ করতে পারবে না। এ সবকিছুই নিষিদ্ধ করা হল।’
গণমাধ্যমের চেয়ে আইনজীবীদের ওপর বিশেষভাবে ওই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয়েছিল। আদালতের আদেশে আমরা তাই পুনরুক্তি দেখি, ‘আমরা পুনরায় ঘোষণা করছি যে, এই নিষেধাজ্ঞা বিশেষভাবে বাংলাদেশের যে কোন আদালতে কর্মরত আইনজীবীদের ওপর প্রযোজ্য হবে। এর যদি কোন বিচ্যুতি ঘটে তাহলে অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে। অবমাননাকারী থাকা পর্যন্ত বাংলাদেশের যে কোন আদালতে তাঁদের ওকালতি করার অধিকার নিষিদ্ধ থাকবে।’ আদালতের আদেশে আরও বলা হয়েছিল, এই আদেশের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা এই আদেশের বিষয়ে আদালতের কাছে আবেদন করতে পারবে। এবং সে ধরনের কোনো আবেদন করা হলে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল এই আদেশের সমর্থনে এবং নিচের চারজন আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। তাঁরা হলেন ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, মাহমুদুল ইসলাম ও আজমালুল হোসেন কিউসি। আদালতের আদেশে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে দেশের সকল বার অ্যাসোসিয়েশনে এই আদেশের কপি জারি করতে বলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের প্রতি নির্দেশনা ছিল, সকল জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমের কাছে আদেশের কপি পৌঁছে দেওয়া। নিশ্চয় লক্ষ্য ছিল আদালতের আঙিনার মর্যাদা সুরক্ষা। দলীয় রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে আদালতকে রক্ষা করা। কিন্তু বার তা মানছে না। গণমাধ্যমও তা মানছে না। আজ ২৯ নভেম্বর যে সারা দেশের বারে হাইকোর্টের রায়বিরোধী কর্মসূচি হবে, সেটা জনগণ পত্রিকাগুলোর কাছ থেকেই জানতে পারবে। পত্রিকাগুলো এমনভাবে এই খবর প্রকাশ করবে, যাতে মনে হবে তারা বারগুলোর সাংবিধানিক অধিকার অনুশীলনের খবর প্রকাশ করছে। আমাদের সম্মিলিত পলায়নপরতা ও স্ববিরোধিতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, এখন আমরা তার ঈষৎ প্রমাণ হাতেনাতে পেতে সচেষ্ট হব।
তখন আওয়ামী লীগ এখন বিএনপি
২০০৫ সালে আদালতের আদেশে অগ্নিসংযোগকারী ওই আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল। শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের পরামর্শে তিনি তখন নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম ওই সময় সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন। সম্পাদক ছিলেন ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারক)। সেদিন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ছিল আওয়ামী লীগারদের হাতে। এখন যেমন বিএনপির হাতে। তাই ওই রায়ে সেদিন সন্তুষ্ট হয়েছিল বিএনপি। ক্ষুব্ধ হয়েছিল আওয়ামী লীগ। ‘সংবিধান ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত’ রাখতে উচ্চ আদালতের ওই আদেশ তারা অমান্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট বারের ব্যানারে লেখা হয়েছিল, ‘অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার।’ সেদিন যাঁরা আদালতের আদেশ লঙ্ঘনের পক্ষে উচ্চকিত ছিলেন, তাঁরা আজ কে কোথায় সেটা দেখুন, তাহলেই বুঝবেন। পুরোভাগে ছিলেন শফিক আহমেদ, যিনি বর্তমানে আইনমন্ত্রী, ছিলেন সাহারা খাতুন, যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আইনজীবীদের অসদাচরণ দেখার দায়িত্ব বার কাউন্সিলের। এর চেয়ারম্যান অ্যাটর্নি জেনারেল। এর ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাছেত মজুমদার। তিনিও কালো কাপড় বাঁধা আন্দোলনের প্রধান পুরোহিত ছিলেন।
আজ সারা দেশে বিএনপি ও আওয়ামী আইনজীবীরা পাল্টাপাল্টি আদালত অবমাননা-উৎসবে মেতে উঠবেন। পত্রিকাগুলো সেসব উদ্যাপনের খবর ছাপবে। এই হচ্ছে একটি জাতির আয়না। এমন একটি আয়নায় যাতে সত্যিকার অর্থে ‘আমরা’ সবাই একযোগে চেহারা দেখে নিতে পারি। আমরা ওই রায়টি পেয়েছিলাম কোনো মহৎ উপলক্ষে নয়। জাল সনদে বিতর্কিত বিচারপতি ফয়জীকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত আওয়ামী আইনজীবীদের বাগে আনার প্রেক্ষাপটে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ তুলে আমরা ওই রায়কে খাটো করতে পারি না। কারণ বিশ্বের কোনো আদালতে এ রকম দলবাজির নজির নেই। কোনো দেশের সুপ্রিম কোর্ট মানতে পারেন না যে, আদালতের আঙিনায় তথাকথিত কর্মসূচি চলবে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বহু মামলায় চূড়ান্তভাবে সুরাহা দিয়েছেন এবং সে দেশের আইনজীবী সমাজ মেনেছে যে, আদালত গন্ডগোল পাকানোর স্থান নয়।
২০০৫ সালে আমরা দেখেছি, আমাদের আইনজীবী নেতারা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মুখে কালো কাপড় বেঁধেছিলেন। আমরা স্তম্ভিত বিস্ময়ে লক্ষ করি, সেই আইনজীবীরাই এখন ওই রায়ের সুবিধা পেতে চান। দুই বিচারককে শপথ পড়ানোর পর খোদ অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিছিল ও স্লোগান দিয়ে আদালতের নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করা হয়েছে।’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, আদালতের বিরুদ্ধে ৩০ নভেম্বর হরতাল ডাকা হয়েছে।
তাই আমরা ভারাক্রান্ত হূদয়ে নিবেদন রাখি, ২০০৫ সালের সুয়োমোটো এক্সপার্টি অর্ডার নম্বর ১ ফয়সালা না করে আজ খালেদা জিয়ার শুনানি চলতে পারে কি পারে না। আজ এ প্রশ্ন তোলা হলে হয়তো বিএনপি বিব্রত হবে, তবে চূড়ান্তভাবে সবার জন্য এর একটা ফয়সালাও দরকার। কোর্টের ওই আদেশ অচল হলে বদলে নিন। আইন থাকবে আর সবাই তা ভাঙবে, সেটা নৈরাজ্য। এভাবে চলতে দিলে আদালত ভেঙে পড়বে।
যার যা খুশি চলতে পারে না
আমরা অসহায় বোধ করি, যখন আমরা শুনি যে, আদালতের কাছে প্রশ্ন না নিয়ে গেলে আদালত নিজ থেকে তা বিচারের বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন না। কিন্তু আমরা বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, এই প্রশ্ন নেওয়ার কেউ বারে নেই। কারণ তারা বিভক্ত ও দলানুগত।
২০০৫ সালের হাইকোর্টের আদেশ একই সঙ্গে বহাল থাকবে, আবার একই সঙ্গে সারা দেশে বিক্ষোভ দেখানো হবে, অথচ আদালত সেদিকে দৃষ্টি দেবেন না—এটা হতে পারে না। আদালতের ওই আদেশ যদি সত্যি প্রচলিত আইন হয়ে থাকে, তাহলে ওই আইনজীবীদের অনুরোধ জানাব, আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও। ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভাবনীয় আদালত বর্জন ছিল সুপ্রিম কোর্টের নিজের রায়ের পরিপন্থী। সম্প্রতি আমরা এও দেখলাম, অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর ভাঙচুরে অংশগ্রহণকারী আইনজীবী বিচারক হিসেবে শপথ নিলেন। প্রধান বিচারপতি বললেন, এতে ‘সংবিধান সমুন্নত’ থেকেছে।
আমরা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০০৫ সালের আদেশ আকাশ থেকে পড়েনি। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট একাধিক মাইলফলক মামলার রায়ে নিশ্চিত করেছেন যে, আদালত চত্বরে বিক্ষোভ দেখানো অসদাচরণ। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ভয়ভীতি প্রদর্শনপূর্বক হরতালের রাজনীতিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাঁরা হুমকি দিয়ে হরতাল ডেকে ক্ষতি করার দায়ে রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়েরও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন মানলে আমাদের আসলে সেখানেও যেতে হবে। না চাইলে যার যা খুশি চলবে। হরতালবিরোধী আইন না করতে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নিঃশর্ত ঘোষণা দুর্ভাগ্যজনক। ভয় দেখিয়ে হরতাল পালন অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে। তবে শুরুটা হোক আদালত দিয়ে। কারণ মর্যাদাসম্পন্ন বার ও বেঞ্চ গণতন্ত্রের মুকুটস্বরূপ।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আজ ২৯ নভেম্বর খালেদা জিয়ার বাড়ির মামলার শুনানির দিন ধার্য আছে। আজ শুনানি হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। তবে শুনানি ও সিদ্ধান্ত যখনই হোক, এর সঙ্গে ২০০৫ সালের ২৩ মে (সুয়োমোটো এক্সপার্টি অর্ডার নম্বর ১) বিচারপতি আবদুল মতিনের দেওয়া একতরফা আদেশের কার্যকারিতার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ওই আদেশে নিষিদ্ধ বিক্ষোভ আজ ২৯ নভেম্বর সারা দেশের বারে বিএনপির আইনজীবীরা করবেন। এর ফলে তাঁরা সন্দেহাতীতভাবে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার হবে না। আমরা দেখব, এক ব্যক্তি জেনেশুনে আদালত অবমাননা করছেন। আবার আদালতে তিনি একই অপরাধের দায়ে অন্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। এটা একটা প্রহসন।
পাঠক ভাবতে পারেন যে, আমাদের এই কথাবার্তা সরকারের প্রতি পক্ষপাতমূলক। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, পুরো ঘটনা জানুন, এই নিবন্ধের পুরোটা পড়ুন, তখন দেখবেন, সরকার আর বিরোধী পক্ষ বলে কিছু নেই। আদালতকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দুই পক্ষই সমান। বিচারপতি আবদুল মতিনের ওই আদেশ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলমের স্ববিরোধিতা দেখার মতো। ২০০৫ সালে তিনি মুখে কালো কাপড় বেঁধে ওই আদেশের প্রতিবাদ করেছিলেন। ২০১০ সালে এসে বিএনপিপন্থীদের বাড়াবাড়ি দেখে অ্যাটর্নি জেনারেল বিরক্ত। ১১ নভেম্বর তিনি সাংবাদিকদের বললেন, আদালত চত্বরে মিছিল না করার বিষয়ে হাইকোর্টের একটি রায় আছে। আওয়ামী আইনজীবী ফরিদুল আলম (কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক) বিচারপতি মতিনের আদেশের কপিতে বার কাউন্সিল বৈঠকে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন। সেই একই জোশ এখন জাতীয়তাবাদীদের পেয়ে বসেছে।
সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে ওই আদেশ দেন। খালেদা জিয়া সেটা অমান্য করবেন। তিনি হুমকি দেবেন। তাঁর সমর্থক আইনজীবীরা ঘোষণা দিয়ে সারা দেশের বারে বিক্ষোভ করবেন। তাঁর নেতৃত্বে ১০৮ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হতে থাকবে, আর ঠিক তখন সুপ্রিম কোর্ট তাঁর অনুকূলে ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রতিকার প্রদানে শুনানি করবেন—সেটা যুক্তিগ্রাহ্য কিংবা প্রীতিপ্রদ মনে হয় না। যদিও আমরা মনে করি, লিভ টু আপিল ও স্থগিতাদেশের শুনানি ঝুলে থাকা অবস্থায় দেশের ছায়া প্রধানমন্ত্রীকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ আইন বা রেওয়াজ সংগত কি না, সেটা বিচারের দাবি রাখে। তবে আমাদের রাজনীতির অনিষ্ট কালচার ক্রমশ আক্ষরিক অর্থে আদালত অঙ্গনে ঢুকে পড়ছে কি না, সেটা আজ এক জ্বলন্ত প্রশ্ন।
আদালত অবমাননা মামলা বনাম অবৈধ নোটিশ
সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৩ নভেম্বর খালেদা জিয়া দুটি আবেদন করেন। একটিতে তিনি নিষেধাজ্ঞা চান। সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় ‘আপিল বিভাগ অবমাননা’ মামলা দায়ের করা হয়েছে। খালেদা জিয়া-সমর্থিত কিংবা নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম লিফলেট প্রচার করেছে। তাতে বলা আছে, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার অবৈধ নোটিশ প্রত্যাহারের দাবিতে’ বাংলাদেশের সকল জেলা বারে ২৯ নভেম্বর বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ হবে। অথচ খালেদা জিয়া বিষয়টিকে ‘সাবজুডিশ’ বিবেচনায় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। এই ‘অবৈধ’ শব্দ যদি বিএনপি বলত, তাহলে একটা সান্ত্বনা ছিল। কিন্তু এটা বলছে আইনজীবী ফোরাম। ৩০ নভেম্বর সারা দেশে হরতাল আহ্বান প্রকারান্তরে আদালতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস। এটা হবে আওয়ামী লীগের আগামীর কর্মসূচি। বিত্তশালী শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কী, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে চলেছি।
খালেদা জিয়া তিন সচিবসহ আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় আদালত অবমাননার মামলা করেছেন। সরকার খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়তে ২৪ মে ২০০৯ চূড়ান্ত নোটিশ দিয়েছিল। এর মূল কথা ছিল, ১৯৮১ সালে তাঁকে যে ইজারা চুক্তির মাধ্যমে বাড়িটি দেওয়া হয়েছিল, সেটি অবৈধ ছিল। গোড়া থেকে বাতিল ছিল। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন খালেদা জিয়া। সরকার নয়, তিনিই বিষয়টিকে আদালতে নিয়ে যান। আদালতে যখন একজন নাগরিক প্রতিকার প্রার্থনা করেন, তখন তিনি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে অঙ্গীকার করেন যে তিনি রায় মানবেন। খালেদা জিয়া হাইকোর্টের কাছ থেকে ১৩ অক্টোবর রায় পেয়েছেন। এই রায় তাঁর পক্ষে যায়নি। ১০ নভেম্বর এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ দেননি। রীতি অনুযায়ী চাওয়াও হয়নি। কিন্তু তাই বলে ১৩ নভেম্বরে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ না করলে আদালত অবমাননা ঘটত না। স্থগিতাদেশ না চেয়ে হয়তো ফাঁদ পাতা হয়েছিল, সেই ফাঁদে সরকারি দল পা দিয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ের পরে বাড়ি ছাড়তে হলে কান্নাপর্ব থাকত অন্তঃপুরে। আপাতত বিএনপির বিরাট স্বার্থসিদ্ধি, সুপ্রিম কোর্ট ও সেনাবাহিনী নতুন বিতর্কের পাদপ্রদীপে। অবশ্য তাতে অতি উৎসাহীদের পুরস্কৃত হতে আটকাবে না। লক্ষণীয় হলো জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আজকের কর্মসূচি। বাড়ি নিয়ে মামলার মূল বিষয় ছিল ২০০৯ সালের নোটিশ। খালেদা জিয়া উক্তরূপ ‘অবৈধ নোটিশ’ উল্লেখ করাজনিত আদালত অবমাননার দায় এড়াতে পারেন না।
আদালতের কাছে চার প্রশ্ন
চারটি প্রশ্ন আমাদের মনে। প্রথমত, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও সম্পাদক মো. বদরুদোজ্জা আদালত অবমাননার আবেদনে তাঁদের পদবি ব্যবহার করেছেন। ১৩ নভেম্বর জারি করা আইনজীবী সনদে বার সভাপতির প্যাড ব্যবহার করেছেন। এ কারণে বার কাউন্সিল অ্যাক্টে বর্ণিত আচরণবিধির লঙ্ঘন ঘটেছে কি না। কারণ খালেদা জিয়া আইনের চোখে তাঁদের কাছে মক্কেল ছাড়া কিছুই নন।
দ্বিতীয়ত, আপিল বিভাগের ১৯৯১ সালের ১০ জুনের একটি রায় অনুযায়ী সরকারি কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল কি না ১৩ নভেম্বরের তথাকথিত আইনজীবী সনদ আমলে নেওয়া।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ’৯১ সালে নিম্ন আদালত সনদ পেয়ে কী করবেন, সে বিষয়ে রায় দেন। রীতিনীতি ঠিক করেন। সেটা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের জন্যও প্রযোজ্য মনে করি। আপিল বিভাগের যুক্তি হলো, যে ক্ষেত্রে সনদের যথার্থতা নিয়ে নিম্ন আদালত প্রশ্ন তুলবেন, সে ক্ষেত্রে তাঁরা আইনজীবীকে হলফনামা দিতে বলবেন। সন্দেহ না থাকলে তা পালন করতে হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে আদেশ আসেনি বলে আইনজীবীকে অবজ্ঞা করতে পারবেন না। ওই রায়ের মূল কথা হলো, ‘আদালতের আদেশ’ আইনজীবী পৌঁছে দিলে তাঁকে অবিশ্বাস করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো, আইনজীবী রফিক-উল হক, মওদুদ আহমদ ও বারের সভাপতি ও সম্পাদক উচ্ছেদের দিন ‘আদালতের আদেশ’ জাহাঙ্গীর গেটে পৌঁছে দিয়েছিলেন কি না। রাষ্ট্রপক্ষকে নোটিশ না দিয়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যাওয়ার কি সুযোগ ছিল? আমরা আরও জানতে চাই, প্রধান বিচারপতির বরাতে যা বলা হয়েছে, তা বলার সুযোগ প্রধান বিচারপতির ছিল কি না। না থাকলে এ রকম সনদ জারি করায় ও তা অমান্য হওয়ায় জনগণের কাছে প্রধান বিচারপতি তথা সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা কোথায় দাঁড়াল?
তৃতীয়ত, ‘আইনজীবী সনদে’ আমরা দুই রকম তথ্য দেখি। ১৩ নভেম্বরে সনদ বলেছে, ‘প্রধান বিচারপতি নির্দিষ্টভাবে আশ্বস্ত করেছেন যে, খালেদা জিয়াকে মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে না।’ আমরা লক্ষ করি, প্রধান বিচারপতির কথিত ওই আশ্বাস ১১ দিনের ব্যবধানে বদলে গেছে। আপিল বিভাগে একই আইনজীবীরা হলফনামা দেন ২৩ নভেম্বর। এতে তাঁরা বলেন, ‘ওই দিন সকাল নয়টায় তাঁরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এবং তাঁকে পরিস্থিতি অবহিত করেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেন, সরকার আবেদনকারীকে তাঁর বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য করতে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। এবং তিনি সে কথা হয়তো সৎ বিশ্বাসে বলেছেন, কারণ ২৯ নভেম্বরে লিভ পিটিশন ও স্থগিতাদেশের আবেদন শুনানির জন্য পেন্ডিং রয়েছে। তখন সরকার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে অবশ্যই কোনো পদক্ষেপ নেবে না।’ প্রধান বিচারপতির বরাতে কথা কিন্তু দুই রকম হলো।
মান্য হচ্ছে না আদালতের আদেশ
এখানে আমরা আরও লক্ষ করি, প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যকে ২৩ নভেম্বরের আবেদনে ‘আদালতের আদেশ’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। সুতরাং আজকের মামলাগুলোর শুনানি নিঃসন্দেহে দারুণ কৌতূহলোদ্দীপক।
বিচারপতি মো. আবদুল মতিন ও বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২৩ মে ২০০৫ লিখেছেন, ‘আমরা সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের আওতায় একতরফা আদেশ দিচ্ছি যে, বাংলাদেশ লিগেল প্র্যাকটিশনার এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২-এর ২০ ধারার আওতায় তালিকাভুক্ত সকল আইনজীবীর জন্য এটা প্রযোজ্য হবে। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আদালতের চত্বরে কিংবা আদালতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোন প্রকারের সভা, সমাবেশ বা পিকেটিং বা কোন ধরনের ঘেরাও চলবে না। সুপ্রিম কোর্ট বা বাংলাদেশের কোন আদালত চত্বরে কোন আইনজীবী সমিতি বা ফোরামের (আজ সারা দেশে হাইকোর্টের ওই রায় লঙ্ঘন আন্দোলনের অন্যতম হুকুমদাতা হলেন ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এমপি) নামে কোনো ধরনের সভা, মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট করা যাবে না।’ এমনকি আদালতের ওই আদেশের ৪ নম্বর নির্দেশনায় বলা আছে, ‘এ বিষয়ে কোন লিফলেট (আমাদের হাতে লিফলেট আছে) ব্যানার বা এ সম্পর্কিত কোন বিবৃতি প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি গণমাধ্যমেও তা প্রকাশ করতে পারবে না। এ সবকিছুই নিষিদ্ধ করা হল।’
গণমাধ্যমের চেয়ে আইনজীবীদের ওপর বিশেষভাবে ওই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয়েছিল। আদালতের আদেশে আমরা তাই পুনরুক্তি দেখি, ‘আমরা পুনরায় ঘোষণা করছি যে, এই নিষেধাজ্ঞা বিশেষভাবে বাংলাদেশের যে কোন আদালতে কর্মরত আইনজীবীদের ওপর প্রযোজ্য হবে। এর যদি কোন বিচ্যুতি ঘটে তাহলে অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে। অবমাননাকারী থাকা পর্যন্ত বাংলাদেশের যে কোন আদালতে তাঁদের ওকালতি করার অধিকার নিষিদ্ধ থাকবে।’ আদালতের আদেশে আরও বলা হয়েছিল, এই আদেশের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা এই আদেশের বিষয়ে আদালতের কাছে আবেদন করতে পারবে। এবং সে ধরনের কোনো আবেদন করা হলে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল এই আদেশের সমর্থনে এবং নিচের চারজন আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। তাঁরা হলেন ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, মাহমুদুল ইসলাম ও আজমালুল হোসেন কিউসি। আদালতের আদেশে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে দেশের সকল বার অ্যাসোসিয়েশনে এই আদেশের কপি জারি করতে বলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের প্রতি নির্দেশনা ছিল, সকল জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমের কাছে আদেশের কপি পৌঁছে দেওয়া। নিশ্চয় লক্ষ্য ছিল আদালতের আঙিনার মর্যাদা সুরক্ষা। দলীয় রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে আদালতকে রক্ষা করা। কিন্তু বার তা মানছে না। গণমাধ্যমও তা মানছে না। আজ ২৯ নভেম্বর যে সারা দেশের বারে হাইকোর্টের রায়বিরোধী কর্মসূচি হবে, সেটা জনগণ পত্রিকাগুলোর কাছ থেকেই জানতে পারবে। পত্রিকাগুলো এমনভাবে এই খবর প্রকাশ করবে, যাতে মনে হবে তারা বারগুলোর সাংবিধানিক অধিকার অনুশীলনের খবর প্রকাশ করছে। আমাদের সম্মিলিত পলায়নপরতা ও স্ববিরোধিতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, এখন আমরা তার ঈষৎ প্রমাণ হাতেনাতে পেতে সচেষ্ট হব।
তখন আওয়ামী লীগ এখন বিএনপি
২০০৫ সালে আদালতের আদেশে অগ্নিসংযোগকারী ওই আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল। শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের পরামর্শে তিনি তখন নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম ওই সময় সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন। সম্পাদক ছিলেন ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারক)। সেদিন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ছিল আওয়ামী লীগারদের হাতে। এখন যেমন বিএনপির হাতে। তাই ওই রায়ে সেদিন সন্তুষ্ট হয়েছিল বিএনপি। ক্ষুব্ধ হয়েছিল আওয়ামী লীগ। ‘সংবিধান ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত’ রাখতে উচ্চ আদালতের ওই আদেশ তারা অমান্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট বারের ব্যানারে লেখা হয়েছিল, ‘অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার।’ সেদিন যাঁরা আদালতের আদেশ লঙ্ঘনের পক্ষে উচ্চকিত ছিলেন, তাঁরা আজ কে কোথায় সেটা দেখুন, তাহলেই বুঝবেন। পুরোভাগে ছিলেন শফিক আহমেদ, যিনি বর্তমানে আইনমন্ত্রী, ছিলেন সাহারা খাতুন, যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আইনজীবীদের অসদাচরণ দেখার দায়িত্ব বার কাউন্সিলের। এর চেয়ারম্যান অ্যাটর্নি জেনারেল। এর ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাছেত মজুমদার। তিনিও কালো কাপড় বাঁধা আন্দোলনের প্রধান পুরোহিত ছিলেন।
আজ সারা দেশে বিএনপি ও আওয়ামী আইনজীবীরা পাল্টাপাল্টি আদালত অবমাননা-উৎসবে মেতে উঠবেন। পত্রিকাগুলো সেসব উদ্যাপনের খবর ছাপবে। এই হচ্ছে একটি জাতির আয়না। এমন একটি আয়নায় যাতে সত্যিকার অর্থে ‘আমরা’ সবাই একযোগে চেহারা দেখে নিতে পারি। আমরা ওই রায়টি পেয়েছিলাম কোনো মহৎ উপলক্ষে নয়। জাল সনদে বিতর্কিত বিচারপতি ফয়জীকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত আওয়ামী আইনজীবীদের বাগে আনার প্রেক্ষাপটে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ তুলে আমরা ওই রায়কে খাটো করতে পারি না। কারণ বিশ্বের কোনো আদালতে এ রকম দলবাজির নজির নেই। কোনো দেশের সুপ্রিম কোর্ট মানতে পারেন না যে, আদালতের আঙিনায় তথাকথিত কর্মসূচি চলবে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বহু মামলায় চূড়ান্তভাবে সুরাহা দিয়েছেন এবং সে দেশের আইনজীবী সমাজ মেনেছে যে, আদালত গন্ডগোল পাকানোর স্থান নয়।
২০০৫ সালে আমরা দেখেছি, আমাদের আইনজীবী নেতারা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মুখে কালো কাপড় বেঁধেছিলেন। আমরা স্তম্ভিত বিস্ময়ে লক্ষ করি, সেই আইনজীবীরাই এখন ওই রায়ের সুবিধা পেতে চান। দুই বিচারককে শপথ পড়ানোর পর খোদ অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিছিল ও স্লোগান দিয়ে আদালতের নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করা হয়েছে।’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, আদালতের বিরুদ্ধে ৩০ নভেম্বর হরতাল ডাকা হয়েছে।
তাই আমরা ভারাক্রান্ত হূদয়ে নিবেদন রাখি, ২০০৫ সালের সুয়োমোটো এক্সপার্টি অর্ডার নম্বর ১ ফয়সালা না করে আজ খালেদা জিয়ার শুনানি চলতে পারে কি পারে না। আজ এ প্রশ্ন তোলা হলে হয়তো বিএনপি বিব্রত হবে, তবে চূড়ান্তভাবে সবার জন্য এর একটা ফয়সালাও দরকার। কোর্টের ওই আদেশ অচল হলে বদলে নিন। আইন থাকবে আর সবাই তা ভাঙবে, সেটা নৈরাজ্য। এভাবে চলতে দিলে আদালত ভেঙে পড়বে।
যার যা খুশি চলতে পারে না
আমরা অসহায় বোধ করি, যখন আমরা শুনি যে, আদালতের কাছে প্রশ্ন না নিয়ে গেলে আদালত নিজ থেকে তা বিচারের বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন না। কিন্তু আমরা বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, এই প্রশ্ন নেওয়ার কেউ বারে নেই। কারণ তারা বিভক্ত ও দলানুগত।
২০০৫ সালের হাইকোর্টের আদেশ একই সঙ্গে বহাল থাকবে, আবার একই সঙ্গে সারা দেশে বিক্ষোভ দেখানো হবে, অথচ আদালত সেদিকে দৃষ্টি দেবেন না—এটা হতে পারে না। আদালতের ওই আদেশ যদি সত্যি প্রচলিত আইন হয়ে থাকে, তাহলে ওই আইনজীবীদের অনুরোধ জানাব, আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও। ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভাবনীয় আদালত বর্জন ছিল সুপ্রিম কোর্টের নিজের রায়ের পরিপন্থী। সম্প্রতি আমরা এও দেখলাম, অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর ভাঙচুরে অংশগ্রহণকারী আইনজীবী বিচারক হিসেবে শপথ নিলেন। প্রধান বিচারপতি বললেন, এতে ‘সংবিধান সমুন্নত’ থেকেছে।
আমরা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০০৫ সালের আদেশ আকাশ থেকে পড়েনি। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট একাধিক মাইলফলক মামলার রায়ে নিশ্চিত করেছেন যে, আদালত চত্বরে বিক্ষোভ দেখানো অসদাচরণ। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ভয়ভীতি প্রদর্শনপূর্বক হরতালের রাজনীতিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাঁরা হুমকি দিয়ে হরতাল ডেকে ক্ষতি করার দায়ে রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়েরও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন মানলে আমাদের আসলে সেখানেও যেতে হবে। না চাইলে যার যা খুশি চলবে। হরতালবিরোধী আইন না করতে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নিঃশর্ত ঘোষণা দুর্ভাগ্যজনক। ভয় দেখিয়ে হরতাল পালন অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে। তবে শুরুটা হোক আদালত দিয়ে। কারণ মর্যাদাসম্পন্ন বার ও বেঞ্চ গণতন্ত্রের মুকুটস্বরূপ।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments