চরাচর-পদ্মার তীরে গণহত্যা by ওয়ালিউর রহমান বাবু
তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চরমভাবে নাজেহাল হয়ে পাকিস্তানি সেন্যরা তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অবাঙালিদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যার পরিকল্পনা করে। বিজয় অর্জনের ২২ দিন আগে ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের দোসরদের নিয়ে বেশ
কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিভিন্ন কায়দায় চোখ-হাত বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। বর্তমানে রাজশাহীর কেন্দ্রীয় উদ্যানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে টি বাঁধ সংলগ্ন শ্রীরামপুর পদ্মা নদীর তীরে নির্মম নির্যাতনের পর হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায় বালুর মধ্যে জীবন্ত পুঁতে ফেলে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, সংগঠক, সমাজসেবীসহ বেশ কয়েকজন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে বোয়ালিয়া ক্লাবের দক্ষিণে শ্রীরামপুর পদ্মা তীরে বালুর মধ্যে অনেক লাশ আছে। হারানো আপনজনের খোঁজে সেখানে ছুটে গেলেন স্বজনরা, উদ্ধার করলেন তাদের বিকৃত লাশ। স্বজনদের চোখের পানিতে ভিজে গেল শ্রীরামপুরের বধ্যভূমি। জানা গেছে, পাকিস্তানি সেনারা সেখানে ১৭ জনকে হত্যা করে। যাদের লাশ পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন শহীদ আজিজুল হক চৌধুরী, শহীদ মকবুল চৌধুরী, শহীদ আলতাফ হোসেন, শহীদ মীর আব্দুল কাইউম, শহীদ তসলিম উদ্দিন, শহীদ আবুল হোসেন, চেয়ারম্যান শহীদ আলাউদ্দিন, শহীদ তৈয়ব আলী, শহীদ নওরোজ দৌলা খান, শহীদ মির্জা সুলতান ও শহীদ আমিনুল হক চৌধুরী। ১৯৯৫ সালের ২৫ নভেম্বর এসব শহীদের স্মরণে রাজশাহী সিটি করপোরেশন রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যানের দক্ষিণে টি বাঁধ সংলগ্ন স্থানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে। স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করেন শহীদ মীর আবদুল কাইউমের স্ত্রী মাসতুরা খানম। সেদিন ঢাকা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য এখানকার মাটি সংগ্রহ করেন বিশিষ্ট অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। মূল বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণের জন্য এবং শহীদদের নামসংবলিত স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানানো হলেও তা বাস্তবায়নে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ; বরং তা কৌশলে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। বধ্যভূমিটি বেদখল করে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি। শ্রীরামপুর বধ্যভূমিতে শহীদদের লাশ উদ্ধারের সময় অনেকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক আহমেদ শফিউদ্দিন। তাঁর ধারণা, পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য নর-নারীকে নির্যাতনের পর ধরে এনে পদ্মা নদীর অন্যান্য চরে নানা কায়দায় হত্যা করেছে, যা আজও অলক্ষেই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে বন্যা হয়েছিল। বন্যার পানিতে সেসব দেহাবশেষ ভেসে গেছে। এমনও হতে পারে, পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের দোসররা হত্যার পর দেহগুলো ফেলে দেয় পদ্মা নদীতে। সঠিক অনুসন্ধান এবং প্রত্যক্ষদর্শীর অভাবে এ তথ্যগুলো জনসমক্ষে আনা সম্ভব হয়নি। এখনো উদ্যোগ নিলে কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে। বর্তমান সরকার বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ এবং শহীদদের নামসংবলিত স্মৃতিফলক স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। রাজশাহী মহানগরীর শ্রীরামপুর পদ্মা তীরের বধ্যভূমিটির ক্ষেত্রেও এ ঘোষণার প্রতিফলন ঘটবে এবং সর্বজনীন দাবির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে_এ প্রত্যাশা নগরবাসীর। আর রাজশাহীর শ্রীরামপুর পদ্মা নদীর তীরে ২৫ নভেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে গঠিত রাজশাহী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের কাছে প্রত্যাশা, তারা ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে। ইতিহাস সংরক্ষণে তাদের উদ্যোগকে সফল করতে সবার আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্ম অপেক্ষা করছে সেই ইতিহাস জানার জন্য।
ওয়ালিউর রহমান বাবু
ওয়ালিউর রহমান বাবু
No comments