হিলারির ঢাকা সফর ও সহযোগিতা চুক্তি by আহমদ রফিক
বাংলাদেশ আর কিছুতে না হোক, একটি বিষয়ে ভাগ্যবান যে বর্তমান বিশ্বের মহাপরাক্রান্ত, বলতে হয় একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ঢাকায় পা রেখেছিলেন। এবার তাঁর স্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের একদিন্কা অতিথি। তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে ঢাকায় সাজ সাজ তৎপরতা।
এ ধরনের আগমন বরাবরই রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে সাবেক ভারতবর্ষীয় উপমহাদেশের ত্রি-রাষ্ট্রের বিবেচনায়। তাঁর আগেকার সফরের তাৎপর্য ছিল ভিন্ন।
দেশ বিভাগের পর পরই ওয়াশিংটনের নজর পড়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল, সদ্য শৃঙ্খলমুক্ত দুই ডোমিনিন ভারত ও পাকিস্তানের দিকে- উদ্দেশ্য সাহায্যের নামে গলায় বন্ধনী (বাক্ল্স) পরিয়ে দেওয়া। ভারত রাজি হয়নি মূলত আধাসমাজবাদী চেতনার রাজনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কারণে। কিন্তু পাকিস্তান এক পায়ে খাড়া। দিব্যি গলায় হাঁসুলি পরে নিল।
এর শুরু কিন্তু আরো আগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছিলেন, যাতে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় ভারতবর্ষকে স্বশাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, স্বশাসিত সাবেক উপনিবেশগুলোতে যাতে সদ্য আবির্ভূত মার্কিন রাষ্ট্রশক্তি তার বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যুদ্ধে ঋণগ্রস্ত, দুর্বল সাম্রাজ্যবাদের স্থান দখল করবে যুক্তরাষ্ট্র, তবে ধীরে-সুস্থে। এমন স্বপ্নই মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেখিয়েছিলেন ব্রিটেনে নিয়োজিত তৎকালীন বিচক্ষণ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ কেনেডি।
কেনেডির দূরদর্শিতার সঙ্গে মার্কিনি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিভা মিলে সেই স্বপ্ন সার্থক করেছে। ঠিকই ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি ভঙ্গুর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এখন নবীন রাজার জুনিয়র পার্টনার। যুদ্ধোত্তর শিবির বিভাজনের মধ্যেও অঢেল সম্পদ ও অস্ত্রভাণ্ডারের অধিকারী যুক্তরাষ্ট্র পঞ্চাশের দশকের একটু আগে থেকেই কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক কায়দায় এক এক করে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার ভূ-রাষ্ট্রনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে তার শিবিরভুক্ত করায় তৎপর হয়ে ওঠে। তাতে ধরা দেয় পাকিস্তান। রাষ্ট্রিক মর্যাদার চেয়ে পাকিস্তানি শাসকদের কাছে দুটো বিষয় বড় হয়ে ওঠে। এক. অর্থ, অস্ত্র ও বিলাসী জীবন। দুই. ভারত নামক শত্রুরাষ্ট্রকে শিক্ষা দেওয়া ও কাশ্মীরের দখল নেওয়া। তাতে সায় ছিল ওয়াশিংটনের। মূলত কাশ্মীরের ভৌগোলিক গুরুত্বের কারণে।
ওয়াশিংটনের রণকৌশল ছিল অর্থ ও রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা জোগানোর নামে 'টার্গেট' দেশগুলোকে সামরিক, বাণিজ্যিক চুক্তিতে আবদ্ধ করা। আর আশ্চর্য, সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই পূর্ববঙ্গের প্রগতিবাদী তরুণদের ও তাদের সমমনা শক্তির স্লোগান ছিল- 'পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল কর।' এ স্লোগান ওঠে চুক্তির অব্যবহিত আগে এবং পরে, যা ষাটের দশকেও ঢাকার রাজপথ উত্তপ্ত করেছে। এ বিশেষ চুক্তি ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টায় নিষ্পন্ন হয় সিয়াটো, সেন্টো, বাগদাদ প্যাক্টের মতো একাধিক চুক্তি। চুক্তি তো নয়, এ সবই ছিল সামরিক বন্ধন।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার মধ্য দিয়েই সোভিয়েত 'ভেটো'র কল্যাণে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব অবশ্যই ভারতীয় সামরিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাত ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত মার্কিন বলয়ের সদস্য হয়ে ওঠে। তত দিনে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ও শিবির বিভাজনের অবসান ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র নিয়ন্ত্রক পরাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
এ কথা সত্য যে বাংলাদেশে মার্কিনি স্বার্থ মূলত বাণিজ্যিক, অংশত রাজনৈতিক। ভারত সম্প্রতি মার্কিন বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ওয়াশিংটনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব কিছুটা কমে গেলেও কমেনি বাণিজ্যিক স্বার্থ। মার্কিন কম্পানিগুলোর এ দেশে অবাধ চুক্তিবদ্ধ বাণিজ্য তার প্রমাণ। সমুদ্রে গ্যাস আহরণ, নৌ-ঘাঁটি স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ের গুরুত্ব হেলাফেলার নয়।
তা ছাড়া রয়েছে বেয়াড়া মিয়ানমারকে সিধাপথে আনার ক্ষেত্রে চীনের বিপরীতে মিয়ানমারের প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কিছুটা গুরুত্ব, যা অনস্বীকার্য। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক নমনীয়তা প্রসঙ্গত বিবেচ্য বিষয়। তবে ইসলামী জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ কঠিন অবস্থান নেবে- এটাও যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। সে কাজ বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থেই করতে হচ্ছে। তবু এ বিষয়ে বাংলাদেশকে কাছে পেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিভীতি প্রবল।
প্রসঙ্গত, একটা বিষয় মানতেই হয় যে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আর্থ-রাজনৈতিক ভিত্তি মজবুত না হলে বিশ্ব-অঙ্গনে তার অবস্থান শক্ত ও মর্যাদাব্যঞ্জক হয় না। বাংলাদেশ এদিক থেকে সন্দেহাতীতভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তার দুর্বলতার বড় একটি কারণ ব্যাপক দুর্নীতি, সর্বস্তরে দুর্নীতি- যা মজবুত জাতীয় পুঁজি বিকাশে সহায়ক নয়। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিবাদ-বিসম্বাদ দীর্ঘসময় ধরে এতটাই চলে আসছে যে তা দেশটির রাষ্ট্রনৈতিক মর্যাদাহানির পক্ষে যথেষ্ট।
কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা তা বুঝতে নারাজ। অথচ এসব কারণে হরহামেশা বিদেশি রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের কাছ থেকে আমাদের সদাচারের বাণী শুনতে হয়, যা কখনো কখনো আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের তুল্য। কিন্তু সে হিসাব রাজনীতিকদের নেই। তারা এসব গায় মাখেন না, প্রতিবাদ দূরের কথা। কারণ একটাই। নানা সূত্রে পরাশক্তির কাছে তাঁদের হাত-পা বাঁধা। তাদের ঋণসাহায্য ছাড়া চলতে অক্ষম বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি। অথচ আত্মশক্তির চর্চা ও সাময়িক কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে নিজ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর নীতিই হতো সঠিক। কিন্তু তাতে তাঁরা অনিচ্ছুক। অঢেল বিত্ত ও বিলাসী জীবন তাঁদের জন্য অপরিহার্য। দেশহিতে কৃচ্ছ্রসাধন তাঁদের জন্য নয়।
তা ছাড়া ক্ষুদ্র বা দুর্বল রাষ্ট্রশক্তি কখনো বড়র মুখের ওপর ন্যায্য কথাও বলতে পারে না, যখন ঋণজালে তার হাত-পা বাঁধা। এই যে বছর কয় আগে বিল ক্লিনটন এবং এখন হিলারি ক্লিনটন আমাদের রাষ্ট্রশাসনের ভুলভ্রান্তি নিয়ে দু কথা শুনিয়ে গেলেন, তা রাজনীতিকদের মর্যাদাবোধে আঘাত করেনি। শ্রমিক নেতা হত্যার সুবিচার চেয়ে ও গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার প্রশ্ন তুলে হিলারি যে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে গেলেন, তার কিছুটা দায় তো প্রশাসনের। কিন্তু এসবের পরও কোনো সরকারই সুশাসনের কথা ভাবে না। না ভাবাটা জাতীয় সমস্যায় পরিণত।
আর বিরোধী দল? তারা ক্ষমতা হারিয়ে সদা তৈরি থাকে জাতীয় মর্যাদার কথা ভুলে অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে বিদেশি পরাশক্তির প্রতিনিধিদের কাছে দফায় দফায় অভিযোগ পেশ করতে। যেন তারা আমাদের অভিভাবক। বাংলাদেশের রাজনীতি সব মর্যাদাবোধ হারিয়ে এখন অদ্ভুত এক হীনম্মন্যতায় ভুগছে। তাই ইউরোপ-মার্কিন পরাশক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করে না। যেমন করে না পাকিস্তানে।
আমরা তাই অবাক হই না, যখন হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশি শ্রমিক নেতা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও সুবিচারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যা নিতান্তই একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ, প্রশাসনিক বিষয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাক সামগ্রীর শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারবিষয়ক ন্যায্য দাবি সম্পর্কে নীরব থাকেন। তাঁর মূল বক্তব্য কেন্দ্রীভূত ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে, দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে নয়। মনে হচ্ছিল যেন এ দেশের একজন বিরোধীদলীয় নেত্রী কথা বলছেন, কোনো বিদেশি কূটনীতিক নন। বাঙালির চিরাচরিত বেতসবৃত্তির প্রকাশ ঘটে, যখন ঢাকার প্রেস ও টিভি মিডিয়া থেকে বুদ্ধিজীবীদের একাংশ হিলারি তোষামোদে বিকিয়ে যায়। নেসার ওসমানের একটি অসাধারণ তথ্যচিত্র 'ঘোড়া'য় বিদেশি দূতের এ দেশের মাটিতে রাজনৈতিক ঝগড়া মেটানোর চেষ্টা সরস যৌতুকে পরিবেশিত হয়েছে। এটাই এখন আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা। এ বাঙালিকে চেনা দায়, যাকে নিয়ে কবি সমর সেনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া স্যাটায়ারে শানিত।
তা ছাড়া কথিত সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে যেসব অতিশয়োক্তি চলেছে, তা-ও ওই একই ধারার। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, শক্তিমান বড় তরফের সঙ্গে সহযোগিতা বা সমঝোতা চুক্তি কদাচিৎ ছোটর স্বার্থ রক্ষা করে চলে। ছোটর হা-পিত্যেশের কাছে কখনো অন্বিষ্ট ধরা দেয় না। যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো শক্তিমান দেশই যে নিজ স্বার্থের বাইরে চুক্তিবদ্ধ হয় না বা তা করলেও সেসব চুক্তি বছরের পর বছর হিমাগারে পড়ে থাকে। তার প্রমাণ, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গত কয়েক দশকের চুক্তিগুলো। বড়র পক্ষে কেবল আশ্বাস আর আশ্বাস। এ নিয়ে যুক্তিবাদী কোনো কোনো ভারতীয় ধীমানের ক্ষোভ লক্ষণীয়।
এ সত্যটা মাথায় রেখেই সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশকে চলতে হবে। সত্যকে আড়ালে রেখে মাথা নোয়ানো চলবে না। সত্যি কথা যে বিশ্ব এখন সব দেশেরই নাগালের মধ্যে, কূটনীতি সেভাবেই চলছে। কিন্তু বিশ্বায়ন সত্ত্বেও আমার প্রশ্ন, পরাশক্তির সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দেশ, এমনকি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের কি খুব উন্নতি ঘটেছে, যে উন্নতি বাংলাদেশের আর্থ-রাষ্ট্রনৈতিক স্বার্থের পক্ষে? যাঁরা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে গলাবাজি করেন, বা চৌকস কলাম লেখেন, তাঁরা একবার বুকে হাত রেখে ভেবেচিন্তে জবাবটা 'দিন বটে'।
আসলে সাবেক উপনিবেশগুলোতে কমপ্রেডর পুঁজি ও পশ্চিমা ভোগবাদী জীবনাদর্শের প্রভাব এত বেশি যে সে ক্ষেত্রে স্বদেশি স্বার্থ বাস্তবিক অনেক পেছনে পড়ে আছে। আমাদের শিক্ষিত এলিট শ্রেণী বিশ্বায়নের সর্বাধিক সুবিধাভোগীগোষ্ঠী। কিছুসংখ্যক শিল্পপতি এবং এনজিও বুদ্ধিজীবী তাদের সঙ্গে এক কাতারে। হিলারি ক্লিনটনের সফর সময়কার দৈনিকের পাতা ও টিভি টক শোর দিকে নজর ফেরালে তা কিছুটা অনুমান করা যায়। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, সংখ্যায় তাঁরা খুব একটা কম নন।
যা-ই হোক, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রিক সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের সরকারকে শুধু সমঝে চলাই নয়, ন্যায়নীতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। তা না হলে বিশ্বায়নমুখী কোনো চুক্তিতে কিছু হবে না। আর হিলারির বাংলাদেশ-সহযোগিতা কতটা বাস্তব, ভবিষ্যৎ সময় তার প্রমাণ দেবে। দেবে তিস্তা নিয়ে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তাঁর সম্ভাব্য সংলাপের ধরন থেকে। আর 'গণতন্ত্র গণতন্ত্র' বলে ইউরো-মার্কিন কূটনীতিকদের চিৎকার সম্পর্কে একটা কথাই বলতে হয়- 'নিজ নিজ দেশের বিদেশনীতির ঝুড়িটা উল্টে দেখুন, তাহলেই বোঝা যাবে গণতন্ত্রের বড় রকমফের।' রবীন্দ্রনাথ একসময় মার্কিন গণতন্ত্র নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় কী নাখোশই না হয়েছিলেন মার্কিনসহ পশ্চিমা প্রধানরা! অবস্থা কিন্তু সেখান থেকে খুব একটা বদলায়নি, আধুনিকতার চেতনা যতই এগিয়ে থাক না কেন। হ্যাঁ, আমাদের সন্দেহই ঠিক। তিস্তা নিয়ে হিলারির কোনো আলাপ হয়নি মমতার সঙ্গে।
লেখক : কবি ও ভাষাসৈনিক
দেশ বিভাগের পর পরই ওয়াশিংটনের নজর পড়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল, সদ্য শৃঙ্খলমুক্ত দুই ডোমিনিন ভারত ও পাকিস্তানের দিকে- উদ্দেশ্য সাহায্যের নামে গলায় বন্ধনী (বাক্ল্স) পরিয়ে দেওয়া। ভারত রাজি হয়নি মূলত আধাসমাজবাদী চেতনার রাজনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কারণে। কিন্তু পাকিস্তান এক পায়ে খাড়া। দিব্যি গলায় হাঁসুলি পরে নিল।
এর শুরু কিন্তু আরো আগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছিলেন, যাতে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় ভারতবর্ষকে স্বশাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, স্বশাসিত সাবেক উপনিবেশগুলোতে যাতে সদ্য আবির্ভূত মার্কিন রাষ্ট্রশক্তি তার বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যুদ্ধে ঋণগ্রস্ত, দুর্বল সাম্রাজ্যবাদের স্থান দখল করবে যুক্তরাষ্ট্র, তবে ধীরে-সুস্থে। এমন স্বপ্নই মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেখিয়েছিলেন ব্রিটেনে নিয়োজিত তৎকালীন বিচক্ষণ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ কেনেডি।
কেনেডির দূরদর্শিতার সঙ্গে মার্কিনি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিভা মিলে সেই স্বপ্ন সার্থক করেছে। ঠিকই ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি ভঙ্গুর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এখন নবীন রাজার জুনিয়র পার্টনার। যুদ্ধোত্তর শিবির বিভাজনের মধ্যেও অঢেল সম্পদ ও অস্ত্রভাণ্ডারের অধিকারী যুক্তরাষ্ট্র পঞ্চাশের দশকের একটু আগে থেকেই কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক কায়দায় এক এক করে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার ভূ-রাষ্ট্রনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে তার শিবিরভুক্ত করায় তৎপর হয়ে ওঠে। তাতে ধরা দেয় পাকিস্তান। রাষ্ট্রিক মর্যাদার চেয়ে পাকিস্তানি শাসকদের কাছে দুটো বিষয় বড় হয়ে ওঠে। এক. অর্থ, অস্ত্র ও বিলাসী জীবন। দুই. ভারত নামক শত্রুরাষ্ট্রকে শিক্ষা দেওয়া ও কাশ্মীরের দখল নেওয়া। তাতে সায় ছিল ওয়াশিংটনের। মূলত কাশ্মীরের ভৌগোলিক গুরুত্বের কারণে।
ওয়াশিংটনের রণকৌশল ছিল অর্থ ও রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা জোগানোর নামে 'টার্গেট' দেশগুলোকে সামরিক, বাণিজ্যিক চুক্তিতে আবদ্ধ করা। আর আশ্চর্য, সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই পূর্ববঙ্গের প্রগতিবাদী তরুণদের ও তাদের সমমনা শক্তির স্লোগান ছিল- 'পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল কর।' এ স্লোগান ওঠে চুক্তির অব্যবহিত আগে এবং পরে, যা ষাটের দশকেও ঢাকার রাজপথ উত্তপ্ত করেছে। এ বিশেষ চুক্তি ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টায় নিষ্পন্ন হয় সিয়াটো, সেন্টো, বাগদাদ প্যাক্টের মতো একাধিক চুক্তি। চুক্তি তো নয়, এ সবই ছিল সামরিক বন্ধন।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার মধ্য দিয়েই সোভিয়েত 'ভেটো'র কল্যাণে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব অবশ্যই ভারতীয় সামরিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাত ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত মার্কিন বলয়ের সদস্য হয়ে ওঠে। তত দিনে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ও শিবির বিভাজনের অবসান ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র নিয়ন্ত্রক পরাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
এ কথা সত্য যে বাংলাদেশে মার্কিনি স্বার্থ মূলত বাণিজ্যিক, অংশত রাজনৈতিক। ভারত সম্প্রতি মার্কিন বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ওয়াশিংটনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব কিছুটা কমে গেলেও কমেনি বাণিজ্যিক স্বার্থ। মার্কিন কম্পানিগুলোর এ দেশে অবাধ চুক্তিবদ্ধ বাণিজ্য তার প্রমাণ। সমুদ্রে গ্যাস আহরণ, নৌ-ঘাঁটি স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ের গুরুত্ব হেলাফেলার নয়।
তা ছাড়া রয়েছে বেয়াড়া মিয়ানমারকে সিধাপথে আনার ক্ষেত্রে চীনের বিপরীতে মিয়ানমারের প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কিছুটা গুরুত্ব, যা অনস্বীকার্য। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক নমনীয়তা প্রসঙ্গত বিবেচ্য বিষয়। তবে ইসলামী জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ কঠিন অবস্থান নেবে- এটাও যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। সে কাজ বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থেই করতে হচ্ছে। তবু এ বিষয়ে বাংলাদেশকে কাছে পেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিভীতি প্রবল।
প্রসঙ্গত, একটা বিষয় মানতেই হয় যে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আর্থ-রাজনৈতিক ভিত্তি মজবুত না হলে বিশ্ব-অঙ্গনে তার অবস্থান শক্ত ও মর্যাদাব্যঞ্জক হয় না। বাংলাদেশ এদিক থেকে সন্দেহাতীতভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তার দুর্বলতার বড় একটি কারণ ব্যাপক দুর্নীতি, সর্বস্তরে দুর্নীতি- যা মজবুত জাতীয় পুঁজি বিকাশে সহায়ক নয়। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিবাদ-বিসম্বাদ দীর্ঘসময় ধরে এতটাই চলে আসছে যে তা দেশটির রাষ্ট্রনৈতিক মর্যাদাহানির পক্ষে যথেষ্ট।
কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা তা বুঝতে নারাজ। অথচ এসব কারণে হরহামেশা বিদেশি রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের কাছ থেকে আমাদের সদাচারের বাণী শুনতে হয়, যা কখনো কখনো আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের তুল্য। কিন্তু সে হিসাব রাজনীতিকদের নেই। তারা এসব গায় মাখেন না, প্রতিবাদ দূরের কথা। কারণ একটাই। নানা সূত্রে পরাশক্তির কাছে তাঁদের হাত-পা বাঁধা। তাদের ঋণসাহায্য ছাড়া চলতে অক্ষম বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি। অথচ আত্মশক্তির চর্চা ও সাময়িক কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে নিজ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর নীতিই হতো সঠিক। কিন্তু তাতে তাঁরা অনিচ্ছুক। অঢেল বিত্ত ও বিলাসী জীবন তাঁদের জন্য অপরিহার্য। দেশহিতে কৃচ্ছ্রসাধন তাঁদের জন্য নয়।
তা ছাড়া ক্ষুদ্র বা দুর্বল রাষ্ট্রশক্তি কখনো বড়র মুখের ওপর ন্যায্য কথাও বলতে পারে না, যখন ঋণজালে তার হাত-পা বাঁধা। এই যে বছর কয় আগে বিল ক্লিনটন এবং এখন হিলারি ক্লিনটন আমাদের রাষ্ট্রশাসনের ভুলভ্রান্তি নিয়ে দু কথা শুনিয়ে গেলেন, তা রাজনীতিকদের মর্যাদাবোধে আঘাত করেনি। শ্রমিক নেতা হত্যার সুবিচার চেয়ে ও গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার প্রশ্ন তুলে হিলারি যে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে গেলেন, তার কিছুটা দায় তো প্রশাসনের। কিন্তু এসবের পরও কোনো সরকারই সুশাসনের কথা ভাবে না। না ভাবাটা জাতীয় সমস্যায় পরিণত।
আর বিরোধী দল? তারা ক্ষমতা হারিয়ে সদা তৈরি থাকে জাতীয় মর্যাদার কথা ভুলে অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে বিদেশি পরাশক্তির প্রতিনিধিদের কাছে দফায় দফায় অভিযোগ পেশ করতে। যেন তারা আমাদের অভিভাবক। বাংলাদেশের রাজনীতি সব মর্যাদাবোধ হারিয়ে এখন অদ্ভুত এক হীনম্মন্যতায় ভুগছে। তাই ইউরোপ-মার্কিন পরাশক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করে না। যেমন করে না পাকিস্তানে।
আমরা তাই অবাক হই না, যখন হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশি শ্রমিক নেতা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও সুবিচারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যা নিতান্তই একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ, প্রশাসনিক বিষয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাক সামগ্রীর শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারবিষয়ক ন্যায্য দাবি সম্পর্কে নীরব থাকেন। তাঁর মূল বক্তব্য কেন্দ্রীভূত ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে, দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে নয়। মনে হচ্ছিল যেন এ দেশের একজন বিরোধীদলীয় নেত্রী কথা বলছেন, কোনো বিদেশি কূটনীতিক নন। বাঙালির চিরাচরিত বেতসবৃত্তির প্রকাশ ঘটে, যখন ঢাকার প্রেস ও টিভি মিডিয়া থেকে বুদ্ধিজীবীদের একাংশ হিলারি তোষামোদে বিকিয়ে যায়। নেসার ওসমানের একটি অসাধারণ তথ্যচিত্র 'ঘোড়া'য় বিদেশি দূতের এ দেশের মাটিতে রাজনৈতিক ঝগড়া মেটানোর চেষ্টা সরস যৌতুকে পরিবেশিত হয়েছে। এটাই এখন আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা। এ বাঙালিকে চেনা দায়, যাকে নিয়ে কবি সমর সেনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া স্যাটায়ারে শানিত।
তা ছাড়া কথিত সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে যেসব অতিশয়োক্তি চলেছে, তা-ও ওই একই ধারার। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, শক্তিমান বড় তরফের সঙ্গে সহযোগিতা বা সমঝোতা চুক্তি কদাচিৎ ছোটর স্বার্থ রক্ষা করে চলে। ছোটর হা-পিত্যেশের কাছে কখনো অন্বিষ্ট ধরা দেয় না। যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো শক্তিমান দেশই যে নিজ স্বার্থের বাইরে চুক্তিবদ্ধ হয় না বা তা করলেও সেসব চুক্তি বছরের পর বছর হিমাগারে পড়ে থাকে। তার প্রমাণ, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গত কয়েক দশকের চুক্তিগুলো। বড়র পক্ষে কেবল আশ্বাস আর আশ্বাস। এ নিয়ে যুক্তিবাদী কোনো কোনো ভারতীয় ধীমানের ক্ষোভ লক্ষণীয়।
এ সত্যটা মাথায় রেখেই সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশকে চলতে হবে। সত্যকে আড়ালে রেখে মাথা নোয়ানো চলবে না। সত্যি কথা যে বিশ্ব এখন সব দেশেরই নাগালের মধ্যে, কূটনীতি সেভাবেই চলছে। কিন্তু বিশ্বায়ন সত্ত্বেও আমার প্রশ্ন, পরাশক্তির সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দেশ, এমনকি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের কি খুব উন্নতি ঘটেছে, যে উন্নতি বাংলাদেশের আর্থ-রাষ্ট্রনৈতিক স্বার্থের পক্ষে? যাঁরা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে গলাবাজি করেন, বা চৌকস কলাম লেখেন, তাঁরা একবার বুকে হাত রেখে ভেবেচিন্তে জবাবটা 'দিন বটে'।
আসলে সাবেক উপনিবেশগুলোতে কমপ্রেডর পুঁজি ও পশ্চিমা ভোগবাদী জীবনাদর্শের প্রভাব এত বেশি যে সে ক্ষেত্রে স্বদেশি স্বার্থ বাস্তবিক অনেক পেছনে পড়ে আছে। আমাদের শিক্ষিত এলিট শ্রেণী বিশ্বায়নের সর্বাধিক সুবিধাভোগীগোষ্ঠী। কিছুসংখ্যক শিল্পপতি এবং এনজিও বুদ্ধিজীবী তাদের সঙ্গে এক কাতারে। হিলারি ক্লিনটনের সফর সময়কার দৈনিকের পাতা ও টিভি টক শোর দিকে নজর ফেরালে তা কিছুটা অনুমান করা যায়। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, সংখ্যায় তাঁরা খুব একটা কম নন।
যা-ই হোক, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রিক সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের সরকারকে শুধু সমঝে চলাই নয়, ন্যায়নীতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। তা না হলে বিশ্বায়নমুখী কোনো চুক্তিতে কিছু হবে না। আর হিলারির বাংলাদেশ-সহযোগিতা কতটা বাস্তব, ভবিষ্যৎ সময় তার প্রমাণ দেবে। দেবে তিস্তা নিয়ে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তাঁর সম্ভাব্য সংলাপের ধরন থেকে। আর 'গণতন্ত্র গণতন্ত্র' বলে ইউরো-মার্কিন কূটনীতিকদের চিৎকার সম্পর্কে একটা কথাই বলতে হয়- 'নিজ নিজ দেশের বিদেশনীতির ঝুড়িটা উল্টে দেখুন, তাহলেই বোঝা যাবে গণতন্ত্রের বড় রকমফের।' রবীন্দ্রনাথ একসময় মার্কিন গণতন্ত্র নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় কী নাখোশই না হয়েছিলেন মার্কিনসহ পশ্চিমা প্রধানরা! অবস্থা কিন্তু সেখান থেকে খুব একটা বদলায়নি, আধুনিকতার চেতনা যতই এগিয়ে থাক না কেন। হ্যাঁ, আমাদের সন্দেহই ঠিক। তিস্তা নিয়ে হিলারির কোনো আলাপ হয়নি মমতার সঙ্গে।
লেখক : কবি ও ভাষাসৈনিক
No comments