প্রতিক্রিয়া-সমুদ্রসীমাবিষয়ক রায়: কতটা জয়? by ম ইনামুল হক

জার্মানির হামবুর্গ শহরে স্থাপিত সমুদ্রসীমাবিষয়ক জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল (আইটিএলওএস) ১৪ মার্চ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমাবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির রায় প্রদান করেন। ১৫১ পৃষ্ঠাব্যাপী ৫০৬টি অনুচ্ছেদের এই রায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাদের হাতে পৌঁছানোর আগেই বাংলাদেশের জয় হয়েছে বলে সংবাদ আসতে থাকে।


এই ট্রাইব্যুনাল বা সালিসি আদালতে আমাদের জয় অবশ্যই কাম্য ছিল, কিন্তু এই রায়ের ফলে প্রতিপক্ষ মিয়ানমারের পরাজয় হয়েছে কি বলা যায়? অবশ্যই নয়। কোনো সালিসি আদালতের রায়ে একপক্ষের জয় এবং অন্যপক্ষের পরাজয় হবে এমন হতে পারে না। উভয়ের সম্মতিতে গঠিত সালিসি আদালত সেই সমাধানই দেবেন, যা দুই পক্ষের মধ্যে আপসে সম্ভব ছিল না। অতঃপর আদালতের রায় উভয় পক্ষ গ্রহণ করতে বাধ্য থাকে। সত্য হলো, সালিসি আদালতের এই রায়ে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে নীতিগত ও অধিকারগতভাবে জয়ী হয়েছে, যেখানে মিয়ানমার পরাজিত হয়েছে; আবার অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরাজিত হয়েছে, যে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের জয় হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের ৫০৬টি ধারাসংবলিত রায়ে সালিসি আদালত গঠন বিষয়ে বিবরণ দেওয়ার পরই রয়েছে উভয় পক্ষের দাবিনামার বিবরণ। আদালত এরপর পূর্বাপর বৈঠকসমূহের উল্লেখ করে যেসব বৈঠকে বিবদমান উভয় পক্ষ নিজেদের দেশের কন্টিনেন্টাল শেলফের (সিএস) সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেনি। বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য সালিসি আদালতের কাছে বাংলাদেশের নিবেদন ছিল যে সমুদ্রসীমাবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন UNCLOS III অনুযায়ী সমুদ্রতট থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে সিএসের সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের (আইটিএলওএস) এখতিয়ারে পড়ে (অনুচ্ছেদ ৪১, ৪২, ৪৩)। মিয়ানমার সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে আইটিএলওএসের এখতিয়ার সম্পর্কে সম্মতি জানালেও বলে, বর্তমান ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা ঠিক হবে না (অনুচ্ছেদ ৪৪, ৪৫)। ট্রাইব্যুনাল উভয় দেশের কথা শুনে প্রথমে সিএসের ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের (ইইজেড) সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন (অনুচ্ছেদ ৪৯, ৫০)। এটি ছিল বাংলাদেশের জয়।
সমুদ্রতটবর্তী দুটি পাশাপাশি দেশের রাষ্ট্রীয় সমুদ্র (Territorial Sea) বিষয়ে বাংলাদেশ বলে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে সাগরসীমা নিয়ে ১৯৭৪ ও ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তি আছে (অনুচ্ছেদ ৫৭, ৫৮)। মিয়ানমার এতে আপত্তি করে বলে (অনুচ্ছেদ ৬৫), ওই সমঝোতাগুলো ছিল জাহাজ চলাচলবিষয়ক, সীমানা নির্ধারণের চুক্তি নয়, বা ওই কাজ যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্বারা হয়নি (অনুচ্ছেদ ৮৩)। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তির প্রতি সমর্থন জানায় (অনুচ্ছেদ ৯২, ৯৩, ৯৮)। বাংলাদেশ ওই চুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে নানা প্রমাণ দেখালেও (অনুচ্ছেদ ১০১, ১০২, ১০৩) মিয়ানমার তা অগ্রাহ্য করে (অনুচ্ছেদ ১০৭, ১০৮, ১০৯)। ট্রাইব্যুনালও বাংলাদেশের দাবি গ্রহণযোগ্য মনে করেননি (অনুচ্ছেদ ১১৫, ১১৮, ১২৫)। মিয়ানমার বলে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তার স্থলসীমানার (নাফ নদ) ভেতরে পড়ে, তাই একে পৃথকভাবে দেখা হোক (অনুচ্ছেদ ১৩১, ১৩২)। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তিকে মেনে নিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ধরে বাংলাদেশকে সর্বাধিক ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫২ কিলোমিটার) রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের অধিকারই প্রদান করেন (অনুচ্ছেদ ৩৩৭)। ফলে বাংলাদেশ সমুদ্রতটের দক্ষিণ সীমানা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ থেকে মূল ভূখণ্ডে টেকনাফের কাছে সরে আসে। এটি ছিল বাংলাদেশের পরাজয়।
UNCLOS III-এর ৭৬.১ ধারা অনুযায়ী, একটি দেশের সমুদ্রতীরবর্তী একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকা (ইইজেড) বলতে তার তটরেখা থেকে ওই এলাকা বোঝায়, যা ওই দেশের পলিপাতনের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে প্রাগ্রসরমান হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সমুদ্র ও সন্নিহিত এলাকাসহ এই এলাকা মহীসোপানের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পলির মাধ্যমে এর সাগরতল গঠিত হয়েছে, যা দক্ষিণমুখী রাখাইন সমুদ্রের দিকে প্রাগ্রসরমান। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের মূল বিষয় ছিল এই যে, মিয়ানমার সমুদ্রতট থেকে সমদূরত্ব নীতির মাধ্যমে (ইইজেড) এলাকা নির্ধারণের কথা বলে। যাতে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। কারণ, তাতে বাংলাদেশ থেকে আসা পলির স্তরের ওপর মিয়ানমারের অধিকার বর্তায়। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালের কাছে উভয় দেশের ইইজেড নির্ধারণের জন্য সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগের বিরোধিতা করে (অনুচ্ছেদ ২১৬)। কিন্তু মিয়ানমার সমদূরত্ব নীতি অবলম্বনের কথা বলে (অনুচ্ছেদ ২১৮, ২২৩)। ট্রাইব্যুনাল নাফ নদের মুখকে সমদূরত্ব রেখা শুরুর বিন্দু সাব্যস্ত করে (অনুচ্ছেদ ২৭২)। বাংলাদেশ UNCLOS II-এর ৭৬.১ ধারার পলিপাতন নীতি দাবি করলেও (অনুচ্ছেদ ২৭৬, ২৭৭) ট্রাইব্যুনাল সমদূরত্বের নীতিই গ্রহণ করেন (অনুচ্ছেদ ২৯৩)। বাংলাদেশ বঙ্গীয় সমুদ্রে পলিপাতনের বিবরণ দিলে (অনুচ্ছেদ ৩২০) মিয়ানমার তার ওপর আপত্তি জানায় (অনুচ্ছেদ ৩২১)। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের দেওয়া আপত্তি গ্রহণ করে বাংলাদেশের যুক্তি অগ্রাহ্য করে (অনুচ্ছেদ ৩২২)। এটি ছিল বাংলাদেশের পরাজয়।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ইইজেড নির্ধারণে সমদূরত্ব রেখা নির্ধারণের পূর্বে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের তটরেখা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ে। ট্রাইব্যুনাল মেঘনা নদীর প্রবাহ বিবেচনা করে বাংলাদেশের জন্য পশ্চিমে মান্দারবাড়ী দ্বীপ থেকে পূর্বে কুতুবদিয়া দ্বীপ পর্যন্ত এবং উত্তরে কুতুবদিয়া থেকে দক্ষিণে টেকনাফ পর্যন্ত মোট দুটি তটরেখা প্রতিষ্ঠা করে (অনুচ্ছেদ ২০২)। মিয়ানমার টেকনাফ থেকে সমুদ্রসীমার সমদূরত্ব রেখাটি মোটামুটি ২৩২০ আজিমুথ (Azimuth) বরাবর টানার দাবি জানায় (অনুচ্ছেদ ২৬৮)। বাংলাদেশ এতে আপত্তি জানিয়ে (অনুচ্ছেদ ২৬৯) বলে, বাংলাদেশের অবতল (Concave) সাগরতটের কারণে এ ধরনের সমদূরত্ব রেখা ভেতরের দিকে টেনে আনবে (অনুচ্ছেদ ২৭৯) এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল দৈর্ঘ্য পেরোতে দেবে না (Cut off Effect)। ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের দাবি বিবেচনায় এনে (অনুচ্ছেদ ২৯৭) সমদূরত্ব রেখাটিকে দক্ষিণে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় (অনুচ্ছেদ ৩২৯)। ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করে যে সমদূরত্ব রেখাটি ২১৫০ আজিমুথ বরাবর প্রলম্বিত হলে বাংলাদেশ কাট অব এফেক্টের সম্মুখীন হবে না (অনুচ্ছেদ ৩৩৪)। অতঃপর ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের অবতল সমুদ্রতটের বিষয়টি বিবেচনায় এনে সমদূরত্ব রেখাটি ২১৫০ আজিমুথ বরাবর সরিয়ে উভয় দেশের তটবর্তী ২০০ নটিক্যাল মাইল ইইজেড এলাকা ভাগ করে দেয় (অনুচ্ছেদ ৩৪০)। এটি ছিল বাংলাদেশের বিজয়।
ট্রাইব্যুনাল সিএস নির্ধারণের ক্ষেত্রে উদ্যোগী হলে মিয়ানমার বলে, ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্বেই উভয় দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হয়ে গেছে (অনুচ্ছেদ ৩৪৩)। বাংলাদেশ এর প্রতি আপত্তি জানায় (অনুচ্ছেদ ৩৫৪)। UNCLOS III-এর ৭৬ ধারার ৫ উপধারা অনুযায়ী, কোনো দেশের মহীসোপানের সীমা ২৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি হতে পারবে না। ৬ উপধারা অনুযায়ী, মহীসোপানের সীমা তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হতে পারবে, তবে পাশের দুই দেশের পলিপাতন বিভাজন রেখার খাঁড়ি অতিক্রম করবে না। বাংলাদেশ UNCLOS III-এর ৭৬.৫ ধারা অনুযায়ী Natural Prolongation-এর যুক্তি দিলে ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করে না (অনুচ্ছেদ ৪৩৫, ৪৩৮, ৪৪৮, ৪৫৫)। ট্রাইব্যুনাল বলে, বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে সিএসের যে দাবি করে তা মিয়ানমারের ২০০ নটিক্যাল মাইল ইইজেড এলাকা। যেহেতু দুই দেশের ইইজেড এলাকা একে অপরের ওপর পড়ছে না, সেহেতু ইইজেড ভাগাভাগির প্রশ্নই ওঠে না (অনুচ্ছেদ ৪৭১)। অতঃপর ট্রাইব্যুনাল সমদূরত্ব রেখাটিই ২১৫০ আজিমুথ বরাবর প্রলম্বিত করে উভয় দেশের সিএস চূড়ান্তভাবে ভাগ করে দেয় (অনুচ্ছেদ ৫০৫)। এটি ছিল বাংলাদেশের পরাজয়।
সমুদ্রসীমাবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে বাংলাদেশ সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর তার ইইজেড এলাকা হারিয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণে Natural Prolongation নীতির বদলে সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগ হওয়ায় বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে ১৫০ নটিক্যাল মাইল সিএসের বিস্তীর্ণ এলাকা হারিয়েছে। এই এলাকায় বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ২০টি গভীর সমুদ্র ব্লকের DS-08-18, DS-08-22, DS-08-23, DS-08-26, DS-08-27, DS-08-28 ব্লক পুরোপুরি এবং DS-08-13, DS-08-17, DS-08-21, DS-08-25 ব্লক আংশিক হাতছাড়া হয়েছে। তা ছাড়া সেন্ট মার্টিনসংলগ্ন অগভীর ১৮ নম্বর ব্লকটির কিছু এলাকাও হাতছাড়া হচ্ছে। এটি হলো বাংলাদেশের পরাজয়।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা বিরোধের সালিসি লড়াইয়ে বাংলাদেশ অনেক যুক্তি দেখিয়েছে, অনেক পরিশ্রম করেছে, যার প্রমাণ ১৫১ পৃষ্ঠাসংবলিত রায়ের পাতায় পাতায় আছে। বাংলাদেশ সমুদ্রসীমাবিষয়ক UNCLOS III-এর আলোকে যে ভূতাত্ত্বিক যুক্তিগুলো দেখিয়েছে তার সবটা মিয়ানমার অস্বীকারও করেনি। কিন্তু মিয়ানমারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল ওই যুক্তিগুলো গ্রহণ করেননি। তাই বাংলাদেশ তার সম্ভাব্য সিএস এলাকার মধ্যে অনেক এলাকা হারিয়েছে, যা মিয়ানমার পেয়েছে। আবার মিয়ানমারও তার সম্ভাব্য ইইজেড এলাকার মধ্যে অনেক এলাকা হারিয়েছে, যা বাংলাদেশ পেয়েছে। তবে সমুদ্রবক্ষে আইনত অধিকার স্থাপনের মাধ্যমে উভয় দেশই জয়ী হয়েছে। বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এ রকম জয়-জয় পরিস্থিতি প্রতিবেশী দুটি দেশের সুসম্পর্ক সম্পন্ন স্থাপনের জন্য অবশ্যই কাম্য।
প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট।
minamul@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.