স্বৈরাচারের কারাগারে আর যেতে চাননি মিনার মাহমুদ by ফজলুল বারী
বিচিন্তা নিষিদ্ধ করে তার জীবনের ছন্দে পতন ঘটান স্বৈরাচারী এরশাদ। সেই সময়ের রোদের অক্ষরের একটি দ্রোহের প্রজন্মের পত্রিকাকে ভেঙে তছনছ করে দেন। ১৯৮৮’র ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় স্বৈরাচারের নির্দেশে গুলি, হামলা, গণহত্যা চালানো হয়
‘চট্টগ্রাম গণহত্যা ও নিরোর বাঁশি’ শিরোনামে শহীদুল ইসলাম বাচ্চুর লেখা ওই রিপোর্টসহ একটি প্রচ্ছদ কাহিনী ছাপতেই পত্রিকাটি নিষিদ্ধ, মিনার মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দেওয়া হয় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের লড়াকু আইনজীবী নেতা অ্যাডভোকেট শামসুল হক চৌধুরী (এখন মৃত) অনেকদিন চেষ্টা করে তার জামিন করান। পরে আবার জামিন বাতিল করে তাকে গ্রেফতারের প্রচার হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর স্বৈরাচারের কারাগারে যেতে চাননি। কারণ বিচিন্তা সম্পাদক মিনার মাহমুদকে কারাগারে সাধারণ হাজতিদের সঙ্গে রেখেছিল স্বৈরাচারী এরশাদ।মিনার ভাই একদিন ডাকেন তার কল্যাণপুরের বাসায়। মাকে নিয়ে তখন তিনি থাকতেন সেখানে। কিছু টাকা হাতে দিয়ে বলেন ‘দ্রুত একটা পাসপোর্ট তৈরি করে ইন্ডিয়ান ভিসা লাগিয়ে আনুন’। আমাকে তিনি নাম ধরে ডাকলেও আপনি সম্বোধন করতেন। বিচিন্তার সব কর্মীদের সঙ্গেই তার সমান সম্পর্ক ছিল। পাসপোর্ট-ভিসা রেডির পর বলেন, ‘ওমুক দিন অমুক ফ্লাইটে আপনি কলকাতা পৌঁছে সন্ধ্যায় কফি হাউসে যাবেন। আপনার পরনে থাকবে একটা লাল গেঞ্জি। আপনার লাল গেঞ্জি দেখে একজন দেখা করতে আসবে।’ একটি কাগজের বান্ডিল দিয়ে বলেন, ‘ওই লোকটাকে কাগজগুলো দেবেন। সে আপনার কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করবে।’ কাগজগুলো মূলত মিনার মাহমুদের বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার নথি। তার প্রতি তখন ব্যক্তিগত অন্ধত্বের কারণে, ওই লোকটা না এলে কী করবো সেটি পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা হয়নি।
সেই সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল কলকাতায়। দমদম থেকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসি কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের নিচে। ট্যাক্সি থেকে নামতে নামতে ভিজে যেতে হয়। আমার পরনে নির্দেশিত লাল গেঞ্জি ছিল না। ব্যাগ থেকে লাল গেঞ্জি বের করে পরে নিয়ে চলে আসি ওপরে। খালি একটা টেবিল দেখে বসতে বসতে দেখি মিনার মাহমুদ আসছেন। মুখে সেই চেনা হাসি। আমি তাকে খুব স্বাভাবিকভাবে বলি, এমন নাটক করার দরকার ছিল না। একসঙ্গেই আসা যেত। মিনার মাহমুদ বলেন, তার পাসপোর্ট সরকার জব্দ করেছে। ছাত্রজীবনে মোহাম্মদ আলী খান মিনার নামে (তার প্রকৃত নাম) তার একটি পাসপোর্ট ছিল। সেটি নিয়ে তিনি সড়কপথে এসেছেন। এয়ারপোর্ট দিয়ে তার বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না। তাই তার মামলার কাগজসহ আমাকে আলাদা পাঠিয়েছেন। স্বৈরাচারের জেলে তিনি আর যেতে চান না। কলকাতা থেকে চলে যাবেন আমেরিকা বা ইউরোপের কোন দেশে।
এরপর থেকে মিনার মাহমুদের সঙ্গে কলকাতা ঘুরি কয়েকদিন। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে সাড়া জাগানো সম্পাদক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আর ফিরবেন না কোনদিন স্বৈরাচারের দেশে, এক্সক্লুসিভ রিপোর্টটি করতে ইচ্ছে করে। আমি তার একটা ইন্টারভ্যু করি। ইন্টারভ্যুর নিচে তিনি লিখেন নিজের নাম, ‘মিনার মাহমুদ, পৃথিবীর পথে’। যদিও সে ইন্টারভ্যুটি কোনদিন ছাপা হয়নি। কলকাতা থেকে ফিরতে ফিরতে নতুন চিন্তা ঘুরপাক খায় মাথায়। সরকার তাকে ওই সময় আবার গ্রেফতার করতে পারে তথ্যটি আমার কেন যেন সঠিক মনে হয় না। ঢাকায় ফিরে কাজী জাফরের কাছে তা নিশ্চিত হই। এরপর চুপচাপ মিনার মাহমুদকে ফিরিয়ে আনতে তার বাবাকে কলকাতা পাঠাই। কারণ আমার খুব ভয় হচ্ছিলো, পাছে এটি জানাজানি হয়ে গেলে তাকে আর ফেরানো কঠিন হবে। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার জামিনে থাকা ব্যক্তি। সরকার তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছে। ভিন্ন পাসপোর্টে তিনি দেশের বাইরে গেছেন এটি জানাজানি হলে সমূহ বিপদ হতে পারে। বাবার খুব ভক্ত ছিলেন মিনার মাহমুদ। তাই বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত আনতে তাকেই পাঠানো হয়।
ঢাকায় ফিরে পড়ি আরেক বিপদে। ৪১/২ দিলু রোড ঠিকানাটিতে ছিল বিচিন্তা কর্মীদের ডেরা। আমিনুর রশীদ, আনোয়ার শাহাদাতসহ আমরা কয়েকজন সেখানে থাকতাম। মিনার মাহমুদ দেশ থেকে চলে গেছেন, আমিও নিঁখোজ, সহকর্মীদের কেউ কেউ ধারণা করেছেন, আমার সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই সব হয়েছে! মানিক রহমানসহ সবাই মোটামুটি সালিশে বসেছেন। সবার একটাই প্রশ্ন কেন সবকিছু আগে তাদের জানাইনি। তাহলে তারা এভাবে মিনার মাহমুদকে যেতে দিতেন না। আহসানুল হক টিপু, মাসুক হেলাল, চিত্রা সুলতানা, আমান-উদ-দৌলা, জিল্লুর রহমান, ফরহাদ টিটো, সৈয়দ বোরহান কবীর, আসিফ নজরুল, দীপু হাসানসহ আরও অনেকে প্রথম পর্যায়ের বিচিন্তা পরিবারের সদস্য। আবার এ পরিবারটির ঘনিষ্ঠ ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। মিনার মাহমুদ শহীদ জননীকে আম্মা ডাকতেন। সেই থেকে তিনি আমাদের সবার আম্মা। বাংলা একাডেমীর বইমেলা থেকে মিনার মাহমুদকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার পর বিচিন্তা পরিবারের কর্ত্রীর ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হন আম্মা। তাই আমরা তখনও ভেঙে পড়িনি। কলকাতা থেকে ফেরার পর আমাকে নিয়ে বসানো সালিশ বৈঠকে সবাইকে সবকিছু খুলে বললে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়। সেবার বাবার সঙ্গে ঢাকায় ফেরতও আসেন মিনার মাহমুদ। এরপর এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো মিডিয়া প্রকাশ করতে পারেননি। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি। সারাদেশ পায়ে হেঁটে ঢাকা এসে তার সঙ্গে দেখা হওয়াতেই শুরু হয় মিডিয়া জীবন। তার কারণেই এত সহজে এত দ্রুত উঠে আসা সম্ভব হয়। বিচিন্তায় আমার প্রথম ধারাবাহিক ‘প্রজন্মের পরিভ্রমণ’-এর শিরোণামসহ মিডিয়া ফাউন্ডেশনের অনেক কিছুই তার। আবার আমি প্রিয় প্রজন্ম বের করতে গেলে তার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিও হয়। আমার পারিবারিক ‘বদরুল’ ডাকনামটি ঢাকার মিডিয়ায় ডাকতেন দু’জনে মাত্র। মিনার মাহমুদ আর আবিদ রহমান। মিনার মাহমুদ আর ডাকবেন না কোনোদিন।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
No comments