রাজনীতি-আইনের ঊধর্ে্ব কেউ নয় by সুভাষ সাহা
আমাদের দেশে আইন অমান্য করাকে এখনও একশ্রেণীর ক্ষমতাশালী স্ট্যাটাসের পরিচয়বাহী বলে মনে করেন। অনেকে রাস্তায় ট্রাফিক আইন অমান্য করে শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারাকে গর্বের বলে মনে করেন। খুন করেও কেউ কেউ আইনের আওতার বাইরে থেকে যান। নারী নির্যাতনকে পৌরুষ ফলানোর হাতিয়ার বলে মনে করেন কেউ কেউ।
খাদ্যে ভেজাল মেশানোকে ব্যবসায়ীদের অনেকেই অনৈতিক ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী বলে মনে করেন না। এভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন অন্যায়-অনিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রকাশের স্মারক। এসব অনিয়ম-অন্যায়কে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশ্রয়দান করে রাষ্ট্র গোটা সমাজকেই অসুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এ কারণেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা বা হামলার ঘটনা নিছক রাজনৈতিক আবরণের জোরে এক প্রকার বৈধতা পেয়ে যায় আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে।
পটুয়াখালী কলেজে বিরোধী সংগঠনের একজনকে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হত্যা করা বা তাদের হাতে লক্ষ্মীপুরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের গাড়িবহরে হামলার মতো ঘটনা এ কারণেই ঘটতে পারে। এর সঙ্গে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর আইনবহির্ভূত কার্যকলাপ তো রয়েছেই। এ বাহিনীগুলোকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার ফলে এর সদস্যরাও কর্তাভজা, ক্ষমতাসীন বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের হুকুমবরদারে পরিণত হয়েছে। তাদের পদোন্নতি-পোস্টিং অনেক সময় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে বলে এদের ভূমিকাও প্রায়ই রাজনৈতিক ক্যাডারদের মতো মনে হয়। এরা কাউকে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে আর কি! প্রশাসনিক নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে এবং কাজের সত্যিকার মূল্যায়নের ভিত্তিতে অনেক ক্ষেত্রে পদোন্নতি-পোস্টিং হয় না বলে এরা কর্মকুশলতা ও সদগুণ প্রদর্শনে কালেভদ্রে উৎসাহী হয়। মোদ্দা কথা, সর্বত্রই সুশাসনের অভাব গোটা সমাজকে আজ নিম্নগামী করেছে।
প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান ফজলুল হক আমিনীর দেশের সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া বা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দেশের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আইনের শাসনের প্রতি আনুগত্যকে বোঝায় কি! আর এ মন্তব্যের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় প্রদানকালে হাইকোর্টে আইনজীবীদের হট্টগোল, হাতাহাতি, বিচারকের প্রতি অশালীন মন্তব্য ও বিচারকদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন বস্তু ছুড়ে মারা কি শীর্ষ আদালতের আইনজীবীদের আইনের পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন নয়! এখানে পেশাদারিত্ব-দক্ষতা প্রমাণের পরিবর্তে কারা কত বেশি দলীয় আদর্শ ও নেতানেত্রীর প্রতি অনুগত তাই প্রাধান্য পেয়েছে। অথচ শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি আদালত অবমাননার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে শীর্ষ আদালতের ক্ষোভ প্রশমন করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে আদালত তাদের এখতিয়ারের পরিধি কতটা প্রশস্ত সেটা প্রশাসনকে ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার নিশ্চয়ই এ ঘটনার কথা স্মরণে থেকে থাকবে। তারপরও তিনি আদালত অবমাননার চেয়েও কঠিন-সার্বভৌম সংবিধান ছুড়ে দেওয়ার মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধতুল্য মন্তব্য করতে পারেন কী ভাবে? বস্তুত দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনও সংবিধানের সার্বভৌমত্ব কী জিনিস তা বুঝে উঠতে পারেননি। বারবার সামরিক শাসকরা সংবিধানের কাটাকুটি করার ফলে এর প্রতি অসম্মান জানানোই যেন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রকাশের উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। অনেক ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন দেশের প্রচলিত সংবিধানকেই মানে না। এসব দল ও নেতৃত্বের বিএনপির ওপর প্রভাব থাকার পরিণাম কী হতে পারে তার প্রমাণ খালেদা জিয়ার সংবিধান সম্পর্কে মন্তব্য।
ক্ষমতাসীনদের আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং আইনকে প্রভাবিত করার অনেক নজির রয়েছে। বঙ্গবল্পুব্দ হত্যাকারীদের কী ভাবে ইনডেমনিটির মাধ্যমে আইনের বাইরে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল এবং খুনিরা কী ভাবে তৎকালীন সরকারগুলোর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বীরদর্পে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছিল তা এখন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাও ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে এতদিন চাপা পড়েছিল। এসব মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টাও কারও অজ্ঞাত নয়। এ দুটি মামলায় দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের দাবিদার তারেক রহমানের নামও জড়িয়ে গেছে। দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন এমন ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম। কেউ কেউ এ নিয়ে দেশে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
প্রধান বিরোধী দলসহ বিরোধী শিবির এখন এ মামলা যাতে না চলতে পারে সে ধরনের একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তৎপর বলে সরকারের মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও অভিযোগ করেছেন। তবে তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি হওয়ায় বিএনপির মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তারেক কেবল বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্ণধারই নন, তিনি খালেদা জিয়ার আদরের জ্যেষ্ঠ সন্তানও বটে। তাই সন্তানের চিন্তায় খালেদা জিয়া মানসিকভাবে মুষড়ে পড়তে পারেন বা দলগতভাবে বিএনপি নেতাকর্মীরা তাদের দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব চিন্তায় আচার-আচরণে খৈ হারাতে পারেন। তবে গণতন্ত্রে আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখলে আখেরে রাজনৈতিক দলগুলোরই লাভ, সে ব্যাপারে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকেই উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
বিএনপির অভিযোগ_ সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই তারেককে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জড়িয়েছে। কিন্তু সে সময় হাওয়া ভবনের অঙ্গুলি হেলন ছাড়া যে কিছু ঘটত না দেশে, এ কথা তো বিএনপি নেতাকর্মীরাও স্বীকার করবেন। তবে তারেক রহমানের মতো মানুষ ২১ আগস্টের রাজনৈতিক ঘৃণ্য হামলার ঘটনায় জড়িত নয় বলেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু তার জড়িত থাকা, না থাকার বিষয়টি এখন আইনের হাতেই ন্যস্ত। বিচারের মাধ্যমে সাব্যস্ত হবে কারা কী ভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে ২১ আগস্টের ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত বিএনপির এ ব্যাপারে অপেক্ষা করা উচিত। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের গোটা নেতৃত্বকে যদি হামলার পরিকল্পনা মতো শেষ করে দেওয়া যেত তাহলে কারা লাভবান হতো? আর তখন বিএনপি এবং দক্ষিণপন্থি শক্তিগুলোকে সহসা চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি কি থাকত দেশে? কেউ যদি বলেন, সপরিবারে বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যা ঘটনার পর যেভাবে জেনারেল জিয়া লাভবান হয়েছিলেন, প্রায় একইভাবে দেশের রাজনীতিকে আবার দীর্ঘকাল প্রতিদ্বন্দ্বীহীন করার উদ্দেশ্যেই ২১ আগস্ট ঘটানো হয়েছিল_ তার জবাব কী?
একইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ তোলা যায়। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এসব বিচার অনুষ্ঠান একান্তভাবেই কাম্য। বঙ্গবল্পুব্দ হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। চার নেতা হত্যার বিচার এখনও ঝুলছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়েছে। জিয়া-সায়েমের শাসন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। এখন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা গেলে সংবিধান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মোটা দাগে অগ্রগতি হবে। ফলে কোনো সেনাশাসক রাতের অন্ধকারে সামরিক আইনের ফরমানবলে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে দেশের সাংবিধানিক শাসনের গণতান্ত্রিক ধারাকে বিকৃত করার সাহস পাবেন না। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখতে হবে। সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের বেআইনি কিছু করে পার পেয়ে যাওয়ার পুরনো নিয়মের ইতি ঘটবে। রাজনৈতিক শীর্ষ নেতা বা মন্ত্রী ক্ষমতায় থাকার সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করার মানসিকতা ত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। আসলে উলি্লখিত বিচারগুলো দেশে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। তবে এ জন্য বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই দেয়ালের লিখন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। খুনি, লুটেরা, আইন অমান্যকারী যেই হোক না কেন, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় ও ক্ষমতার প্রশ্রয়দান বন্ধ করতে হবে। তা না হলে এসব বিচার সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তারা দেশে আইনের শাসনের যে আবহ সৃষ্টি করতে চান তার শিকার তারাও ভবিষ্যতে হতে পারেন। কারণ আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিলে সে কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয় তা নির্ণয় করতে পারে; কে সরকারি দলের নেতা বা কে বিরোধী দলের নেতা তা দেখতে পায় না।
আইনের শাসনের ক্ষেত্রে অগ্রগতিই ক্ষমতাশালীদের আইনকে অবজ্ঞা করা বা নিজের স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতাকে রোধ করতে পারে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com
পটুয়াখালী কলেজে বিরোধী সংগঠনের একজনকে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হত্যা করা বা তাদের হাতে লক্ষ্মীপুরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের গাড়িবহরে হামলার মতো ঘটনা এ কারণেই ঘটতে পারে। এর সঙ্গে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর আইনবহির্ভূত কার্যকলাপ তো রয়েছেই। এ বাহিনীগুলোকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার ফলে এর সদস্যরাও কর্তাভজা, ক্ষমতাসীন বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের হুকুমবরদারে পরিণত হয়েছে। তাদের পদোন্নতি-পোস্টিং অনেক সময় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে বলে এদের ভূমিকাও প্রায়ই রাজনৈতিক ক্যাডারদের মতো মনে হয়। এরা কাউকে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে আর কি! প্রশাসনিক নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে এবং কাজের সত্যিকার মূল্যায়নের ভিত্তিতে অনেক ক্ষেত্রে পদোন্নতি-পোস্টিং হয় না বলে এরা কর্মকুশলতা ও সদগুণ প্রদর্শনে কালেভদ্রে উৎসাহী হয়। মোদ্দা কথা, সর্বত্রই সুশাসনের অভাব গোটা সমাজকে আজ নিম্নগামী করেছে।
প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান ফজলুল হক আমিনীর দেশের সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া বা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দেশের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আইনের শাসনের প্রতি আনুগত্যকে বোঝায় কি! আর এ মন্তব্যের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় প্রদানকালে হাইকোর্টে আইনজীবীদের হট্টগোল, হাতাহাতি, বিচারকের প্রতি অশালীন মন্তব্য ও বিচারকদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন বস্তু ছুড়ে মারা কি শীর্ষ আদালতের আইনজীবীদের আইনের পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন নয়! এখানে পেশাদারিত্ব-দক্ষতা প্রমাণের পরিবর্তে কারা কত বেশি দলীয় আদর্শ ও নেতানেত্রীর প্রতি অনুগত তাই প্রাধান্য পেয়েছে। অথচ শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি আদালত অবমাননার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে শীর্ষ আদালতের ক্ষোভ প্রশমন করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে আদালত তাদের এখতিয়ারের পরিধি কতটা প্রশস্ত সেটা প্রশাসনকে ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার নিশ্চয়ই এ ঘটনার কথা স্মরণে থেকে থাকবে। তারপরও তিনি আদালত অবমাননার চেয়েও কঠিন-সার্বভৌম সংবিধান ছুড়ে দেওয়ার মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধতুল্য মন্তব্য করতে পারেন কী ভাবে? বস্তুত দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনও সংবিধানের সার্বভৌমত্ব কী জিনিস তা বুঝে উঠতে পারেননি। বারবার সামরিক শাসকরা সংবিধানের কাটাকুটি করার ফলে এর প্রতি অসম্মান জানানোই যেন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রকাশের উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। অনেক ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন দেশের প্রচলিত সংবিধানকেই মানে না। এসব দল ও নেতৃত্বের বিএনপির ওপর প্রভাব থাকার পরিণাম কী হতে পারে তার প্রমাণ খালেদা জিয়ার সংবিধান সম্পর্কে মন্তব্য।
ক্ষমতাসীনদের আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং আইনকে প্রভাবিত করার অনেক নজির রয়েছে। বঙ্গবল্পুব্দ হত্যাকারীদের কী ভাবে ইনডেমনিটির মাধ্যমে আইনের বাইরে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল এবং খুনিরা কী ভাবে তৎকালীন সরকারগুলোর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বীরদর্পে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছিল তা এখন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাও ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে এতদিন চাপা পড়েছিল। এসব মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টাও কারও অজ্ঞাত নয়। এ দুটি মামলায় দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের দাবিদার তারেক রহমানের নামও জড়িয়ে গেছে। দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন এমন ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম। কেউ কেউ এ নিয়ে দেশে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
প্রধান বিরোধী দলসহ বিরোধী শিবির এখন এ মামলা যাতে না চলতে পারে সে ধরনের একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তৎপর বলে সরকারের মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও অভিযোগ করেছেন। তবে তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি হওয়ায় বিএনপির মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তারেক কেবল বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্ণধারই নন, তিনি খালেদা জিয়ার আদরের জ্যেষ্ঠ সন্তানও বটে। তাই সন্তানের চিন্তায় খালেদা জিয়া মানসিকভাবে মুষড়ে পড়তে পারেন বা দলগতভাবে বিএনপি নেতাকর্মীরা তাদের দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব চিন্তায় আচার-আচরণে খৈ হারাতে পারেন। তবে গণতন্ত্রে আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখলে আখেরে রাজনৈতিক দলগুলোরই লাভ, সে ব্যাপারে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকেই উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
বিএনপির অভিযোগ_ সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই তারেককে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জড়িয়েছে। কিন্তু সে সময় হাওয়া ভবনের অঙ্গুলি হেলন ছাড়া যে কিছু ঘটত না দেশে, এ কথা তো বিএনপি নেতাকর্মীরাও স্বীকার করবেন। তবে তারেক রহমানের মতো মানুষ ২১ আগস্টের রাজনৈতিক ঘৃণ্য হামলার ঘটনায় জড়িত নয় বলেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু তার জড়িত থাকা, না থাকার বিষয়টি এখন আইনের হাতেই ন্যস্ত। বিচারের মাধ্যমে সাব্যস্ত হবে কারা কী ভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে ২১ আগস্টের ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত বিএনপির এ ব্যাপারে অপেক্ষা করা উচিত। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের গোটা নেতৃত্বকে যদি হামলার পরিকল্পনা মতো শেষ করে দেওয়া যেত তাহলে কারা লাভবান হতো? আর তখন বিএনপি এবং দক্ষিণপন্থি শক্তিগুলোকে সহসা চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি কি থাকত দেশে? কেউ যদি বলেন, সপরিবারে বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যা ঘটনার পর যেভাবে জেনারেল জিয়া লাভবান হয়েছিলেন, প্রায় একইভাবে দেশের রাজনীতিকে আবার দীর্ঘকাল প্রতিদ্বন্দ্বীহীন করার উদ্দেশ্যেই ২১ আগস্ট ঘটানো হয়েছিল_ তার জবাব কী?
একইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ তোলা যায়। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এসব বিচার অনুষ্ঠান একান্তভাবেই কাম্য। বঙ্গবল্পুব্দ হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। চার নেতা হত্যার বিচার এখনও ঝুলছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়েছে। জিয়া-সায়েমের শাসন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। এখন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা গেলে সংবিধান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মোটা দাগে অগ্রগতি হবে। ফলে কোনো সেনাশাসক রাতের অন্ধকারে সামরিক আইনের ফরমানবলে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে দেশের সাংবিধানিক শাসনের গণতান্ত্রিক ধারাকে বিকৃত করার সাহস পাবেন না। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখতে হবে। সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের বেআইনি কিছু করে পার পেয়ে যাওয়ার পুরনো নিয়মের ইতি ঘটবে। রাজনৈতিক শীর্ষ নেতা বা মন্ত্রী ক্ষমতায় থাকার সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করার মানসিকতা ত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। আসলে উলি্লখিত বিচারগুলো দেশে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। তবে এ জন্য বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই দেয়ালের লিখন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। খুনি, লুটেরা, আইন অমান্যকারী যেই হোক না কেন, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় ও ক্ষমতার প্রশ্রয়দান বন্ধ করতে হবে। তা না হলে এসব বিচার সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তারা দেশে আইনের শাসনের যে আবহ সৃষ্টি করতে চান তার শিকার তারাও ভবিষ্যতে হতে পারেন। কারণ আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিলে সে কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয় তা নির্ণয় করতে পারে; কে সরকারি দলের নেতা বা কে বিরোধী দলের নেতা তা দেখতে পায় না।
আইনের শাসনের ক্ষেত্রে অগ্রগতিই ক্ষমতাশালীদের আইনকে অবজ্ঞা করা বা নিজের স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতাকে রোধ করতে পারে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com
No comments