কল্পকথার গল্প-আমাদের নাকি কিছু হবে না! by আলী হাবিব
আজকাল অনেক কিছুই ভুল হয়ে যায়। গুছিয়ে কাজ করা হয়ে ওঠে না। যে কাজ সকালে করার কথা ছিল, সেটার কথা মনে হয় বিকেলে গিয়ে। পাঠের অভ্যাস অনেকদিনের। কিন্তু কখন, কোথায়, কী পড়েছি- তা অনেক সময় ভুল হয়ে যায়। মনে পড়ছে একটা ছড়া পড়েছিলাম, 'আমি ভেবে অবাক হই/ আবার, অবাক চেয়ে রই...।'
ছড়াটা কোথায় পড়েছিলাম, কে এই ছড়াটি লিখেছেন, তা আর মনে পড়ছে না। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। দুই লাইন হলেও তো মনে আছে। ওই দুই লাইনই তো নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিল। কিভাবে অবাক হই আমরা? পাঁচ ডাবি্লউ, এক এইচ (5W, 1H) নিয়ে নাকি একটা সূত্র আছে। পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান নাকি মেলে ওই সূত্রে। সেই সূত্রে সুতো গাঁথার চেষ্টা করে দেখেছি। মেলে না। এমন সমস্যা বোধ হয় অনেকেরই। অনেকেই আজকাল যেখানে যা দেখতে চান, দেখতে পান না। যেভাবে দেখতে চান, সেভাবে দেখতে পান না। দেখেন অন্যভাবে। এসব দেখে অনেকে অবাক যে হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।
একটু ভেঙেই বলা যাক। চমকে যাওয়া বলে তো একটা ব্যাপার আছে। সকালবেলা দরজা খুলে এমন কাউকে দেখলেন, যাকে দেখে আপনি চমকে গেলেন। না, পাওনাদারের কথা বলছি না। পাওনাদার এলে তো চমকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন কাউকে দেখলেন, যাকে আপনি একেবারেই আশা করেননি। হ্যাঁ, ভোটের সময় হলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। ভোট যখন আসে, তখন এমন অনেককেই তো দরজায় দেখা যায়, যাদের ভোটের পর পাঁচ বছর আর খুঁজেও পাওয়া যায় না। ভোটের আগে যাঁরা দরজায় দরজায় হন্যে হয়ে ঘোরেন, ভোটের পর তাঁদের অনেকের দরজায় গিয়ে ফিরে আসতে হয়। এটাও স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের ঘাড়ে অনেক বড় বড় দায়িত্ব পড়ে যায়। জনগণের কথা ভাবার সময় অনেক ক্ষেত্রেই করে উঠতে পারেন না তাঁরা। এতে আশাহত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ভোট নয়, অন্য সময় অমন কেউ দরজায় এসে কড়া নাড়লে একটু হলেও চমকে যেতেই হয়।
আবার পত্র-পত্রিকার পাতায় এমন অনেক খবর বের হয়, যেগুলো পড়ে চমকে যেতে হয়। দ্বিতীয়বার পড়তে হয় খবরগুলো। ভাবতে হয়। অনেকের মনেই ভাবনা আসে, কেমন করে এমন হলো? 'কেমন করে এমন হলো' জাতীয় গল্প নিয়ে বাজারে অনেক বই পাওয়া যায়। প্রচলিত রূপকথার বই। হট্টিটি পাখি কেন পা ওপরের দিকে দিয়ে শুয়ে থাকে, কোকিল কেন কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, কাক কেন চিলের শত্রু, চাম্বল গাছ কেন অত লম্বা হয়- এসব নিয়েও অনেক গল্প আছে। এসব গল্পের বাইরে অনেক খবর আছে, যেগুলো পড়লে একটু অবাকই হতে হয়। অবাক না হয়ে তো থাকা যায় না তখন। কোথায় কোন খেজুর গাছের সাতটা মাথা, সেটা বোধ হয় এখন পুরনো খবর। লাউ গাছে যদি কুমড়ো ধরে, তাহলে অবাক না হয়ে উপায় কি? তেঁতুল গাছে বরই ধরেছে, এমন কথা কি শোনা গেছে কখনো? আম গাছে আমই ধরবে। সে আম মিষ্টি না টক, সেটা কোনো খবর নয়। কিন্তু আম গাছে যদি জাম ধরে, জাম গাছে খেজুর- তাহলে কিন্তু সেটা বড় খবর। বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়, বাঘের মাসি বিড়াল কখনো বাঘ হয় না। বাঘ দেখতে গিয়ে বাঘডাঁশ দেখে অনেকে ভিরমি খেলেও খেতে পারেন, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যদি শোনা যায়, বলদ দুধ দিচ্ছে, তাহলে তো অবাক হতেই হবে। কিছুদিন আগে একটি খবর বেরিয়েছিল কাগজে, কুকুরের দুধ খাচ্ছে বানরের বাচ্চা। এসব খবর কাগজের পাতায় আসে, কিছুদিন পর মানুষ তা ভুলেও যায়। কিন্তু কিছু কিছু খবর মনে দাগ কেটে যায়। ঝামেলাটা সেখানেই। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে, চীনের কোনো এক গ্রামে একটি মোরগ ডিম দিচ্ছে। হ্যাঁ, এমন খবরে তো একটু চমকে যেতেই হয়। মোরগটি থাকে চীনের এক মুরগি খামারে। সেখানে সাতটা মুরগির সঙ্গে থাকত মোরগটি। পরিবারের মাংসের চাহিদা পূরণ করতে একে একে সাতটি মুরগি জবাই করে খেয়ে ফেলার পর এক দিন খাঁচায় ডিম দেখে চমকে গিয়েছিলেন মুরগির খামারের মালিক। ভেবেছিলেন, চমকে দেওয়ার জন্য পাড়া-পড়শিরা কেউ অমনটি করেছেন। কিন্তু পরদিন আবার পাওয়া গেল ডিম। তার পরদিন আবারও। খবর কী আর চাপা থাকে! চলে গেল গণমাধ্যমে। বিশেষজ্ঞরা এসে মোরগটি নিয়ে গেছেন। পরীক্ষা হবে। প্রকৃতির এ কোন খেয়াল, সেটা পরীক্ষা করে না দেখলে তো চলে না। এর চেয়েও বড় কথা, ব্যাপার এমন ঘটতে থাকলে তো কিছুদিন পর 'কাঁঠালের আমসত্ত্ব' ব্যাপারটিও আর অসম্ভব থাকবে না। সেটাও হয়তো পেয়ে যাব আমরা।
মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কাগজে আরেকটা খবর পড়ে রীতিমতো চমকে যাওয়ার অবস্থা। এক ভদ্রলোকের গর্ভে বেড়ে উঠছে ভ্রূণ। কিছুদিনের মধ্যেই শিশুর জন্ম হবে। না, কোনো পুরুষের গর্ভে শিশুর ভ্রূণ বেড়ে ওঠার খবর এটাই প্রথম নয়। এর আগেও পুরুষের গর্ভে শিশুর জন্মের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু টমাস বেটি যখন দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভধারণ করেন কিংবা স্কট মুর বা ম্যাট রাইস পুরুষ হয়েও গর্ভধারণ করেন- তখন তো চমকে যেতেই হয়। এতদিন ব্যাকরণে গর্ভবতী বলে একটা শব্দ ছিল। এখন সে শব্দটির বিপরীত লিঙ্গের, অর্থাৎ পুরুষবাচক শব্দ কী হবে, গর্ভবান? নারীর এই একটা গর্বের ব্যাপার ছিল গর্ভধারণ। এখন থেকে পুরুষরা একের পর এক গর্ভধারণ করতে থাকলে নারীর সেই গর্বের জায়গাটি কি আর থাকছে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকৃতির নিয়ম কি শেষ পর্যন্ত বদলে যাবে?
প্রকৃতি তার নিয়ম বদলাবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর এত আগে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে পুরুষের গর্ভধারণের গল্প কিন্তু আমরা পুরাণেও পাই। পুরনো কিছু বোঝাতে আমরা কথায় কথায় বলি 'মান্ধাতার আমল'। কে এই মান্ধাতা? সূর্যবংশীয় রাজা যুবনাশ্বের ছেলে মান্ধাতা। আসুন, বিষ্ণুপুরাণ থেকে জানা যাক তাঁর জন্মবৃত্তান্ত। দীর্ঘদিনেও রাজা যুবনাশ্বের কোনো পুত্রসন্তান না হওয়ায় মনের দুঃখে বনে গিয়ে তিনি মুনিদের আশ্রমে বাস করতে থাকেন। সেবা করতে থাকেন মুনিদের। একসময় মুনিদের মনে দয়ার উদ্রেক হলো। যুবনাশ্বের পুত্র কামনায় তাঁরা যজ্ঞ শুরু করলেন। যজ্ঞ শেষ হলো মাঝরাতে। যজ্ঞ শেষে মুনিগণ মন্ত্রপূত পানির কলস বেদীর ওপর রেখে ঘুমোতে চলে যান। তাঁদের ইচ্ছে ছিল, সকালে ওই কলস তাঁরা যুবনাশ্বকে দেবেন। তাঁর স্ত্রী ওই পানি পান করলে গর্ভবতী হবেন- এমন ভাবনা ছিল মুনিদের মনে। ওদিকে গভীর রাতে রাজা যুবনাশ্বের ঘুম ভেঙে গেল পিপাসায়। অত রাতে তিনি পানি কোথায় পাবেন? মুনিদের না জাগিয়ে তিনি পানি খুঁজতে শুরু করলেন। একসময় বেদীর ওপরে রাখা পানির কলস দেখে সেখান থেকে সব পানি পান করে ফেললেন।
ভোরবেলা মুরিরা ঘুম থেকে জেগে দেখেন, যজ্ঞকলসে একটুও পানি নেই। রাতে যে কলসে জল রাখা ছিল, সে জল গেল কোথায়? মুনিদের মাথায় হাত। খোঁজ করতেই রাজা যুবনাশ্ব জানালেন, গভীর রাতে তাঁর পিপাসা পাওয়ায় তিনি ওই পানি পান করেছেন। এখন কী হবে? যা হওয়ার তাই তা হবে। নিয়মের বাইরে তো আর যাওয়া যাবে না। মন্ত্রপূত পানির প্রভাবে রাজা যুবনাশ্বের গর্ভসঞ্চার হলো। মুনিদের আশীর্বাদে তিনি গর্ভধারণের কষ্ট থেকে রেহাই পেলেন। তবে নারীর মতো ১০ মাস ১০ দিন নয়, তাঁকে গর্ভধারণ করতে হলো পুরো একটা সেঞ্চুরি। শতবর্ষ গর্ভধারণের পর রাজা যুবনাশ্বের গর্ভ ভেদ করে (পৌরাণিক আমলের সিজারিয়ান আর কী!) ভূমিষ্ঠ হলো সূর্যের মতো তেজস্বী এক পুত্র। এই পুত্রের নাম মান্ধাতা। পিতৃরাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে মান্ধাতা বিশ্বজয় করতে বেরিয়েছিলেন। সে আরেক কাহিনী।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কী? চমকে যাওয়ার মতো কিছু নেই। অবাক হওয়ার কিছু নেই। যা কিছু ঘটার ছিল, সেটাই ঘটেছে- এমনটি ভেবে নিলে অবাক হওয়ারই বা কী আছে? চৌকিদার হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কে নগরকোটাল হয়ে গেল, উমেদার হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কে উজির কিংবা নাজির হয়ে গেল- তা নিয়ে ভেবে আমাদের লাভ নেই। কে কোথায় কোন যজ্ঞকলসের পানি পান করে বসে আছে, তা কি আর আমরা জানি?
তার চেয়ে আসুন, নচিকেতার গাওয়া একটি ব্যর্থতা সংগীত সমস্বরে গাই আমরা, 'আমাদের নাকি কিছু হবে না!'
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.comএকটু ভেঙেই বলা যাক। চমকে যাওয়া বলে তো একটা ব্যাপার আছে। সকালবেলা দরজা খুলে এমন কাউকে দেখলেন, যাকে দেখে আপনি চমকে গেলেন। না, পাওনাদারের কথা বলছি না। পাওনাদার এলে তো চমকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন কাউকে দেখলেন, যাকে আপনি একেবারেই আশা করেননি। হ্যাঁ, ভোটের সময় হলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। ভোট যখন আসে, তখন এমন অনেককেই তো দরজায় দেখা যায়, যাদের ভোটের পর পাঁচ বছর আর খুঁজেও পাওয়া যায় না। ভোটের আগে যাঁরা দরজায় দরজায় হন্যে হয়ে ঘোরেন, ভোটের পর তাঁদের অনেকের দরজায় গিয়ে ফিরে আসতে হয়। এটাও স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের ঘাড়ে অনেক বড় বড় দায়িত্ব পড়ে যায়। জনগণের কথা ভাবার সময় অনেক ক্ষেত্রেই করে উঠতে পারেন না তাঁরা। এতে আশাহত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ভোট নয়, অন্য সময় অমন কেউ দরজায় এসে কড়া নাড়লে একটু হলেও চমকে যেতেই হয়।
আবার পত্র-পত্রিকার পাতায় এমন অনেক খবর বের হয়, যেগুলো পড়ে চমকে যেতে হয়। দ্বিতীয়বার পড়তে হয় খবরগুলো। ভাবতে হয়। অনেকের মনেই ভাবনা আসে, কেমন করে এমন হলো? 'কেমন করে এমন হলো' জাতীয় গল্প নিয়ে বাজারে অনেক বই পাওয়া যায়। প্রচলিত রূপকথার বই। হট্টিটি পাখি কেন পা ওপরের দিকে দিয়ে শুয়ে থাকে, কোকিল কেন কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, কাক কেন চিলের শত্রু, চাম্বল গাছ কেন অত লম্বা হয়- এসব নিয়েও অনেক গল্প আছে। এসব গল্পের বাইরে অনেক খবর আছে, যেগুলো পড়লে একটু অবাকই হতে হয়। অবাক না হয়ে তো থাকা যায় না তখন। কোথায় কোন খেজুর গাছের সাতটা মাথা, সেটা বোধ হয় এখন পুরনো খবর। লাউ গাছে যদি কুমড়ো ধরে, তাহলে অবাক না হয়ে উপায় কি? তেঁতুল গাছে বরই ধরেছে, এমন কথা কি শোনা গেছে কখনো? আম গাছে আমই ধরবে। সে আম মিষ্টি না টক, সেটা কোনো খবর নয়। কিন্তু আম গাছে যদি জাম ধরে, জাম গাছে খেজুর- তাহলে কিন্তু সেটা বড় খবর। বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়, বাঘের মাসি বিড়াল কখনো বাঘ হয় না। বাঘ দেখতে গিয়ে বাঘডাঁশ দেখে অনেকে ভিরমি খেলেও খেতে পারেন, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যদি শোনা যায়, বলদ দুধ দিচ্ছে, তাহলে তো অবাক হতেই হবে। কিছুদিন আগে একটি খবর বেরিয়েছিল কাগজে, কুকুরের দুধ খাচ্ছে বানরের বাচ্চা। এসব খবর কাগজের পাতায় আসে, কিছুদিন পর মানুষ তা ভুলেও যায়। কিন্তু কিছু কিছু খবর মনে দাগ কেটে যায়। ঝামেলাটা সেখানেই। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে, চীনের কোনো এক গ্রামে একটি মোরগ ডিম দিচ্ছে। হ্যাঁ, এমন খবরে তো একটু চমকে যেতেই হয়। মোরগটি থাকে চীনের এক মুরগি খামারে। সেখানে সাতটা মুরগির সঙ্গে থাকত মোরগটি। পরিবারের মাংসের চাহিদা পূরণ করতে একে একে সাতটি মুরগি জবাই করে খেয়ে ফেলার পর এক দিন খাঁচায় ডিম দেখে চমকে গিয়েছিলেন মুরগির খামারের মালিক। ভেবেছিলেন, চমকে দেওয়ার জন্য পাড়া-পড়শিরা কেউ অমনটি করেছেন। কিন্তু পরদিন আবার পাওয়া গেল ডিম। তার পরদিন আবারও। খবর কী আর চাপা থাকে! চলে গেল গণমাধ্যমে। বিশেষজ্ঞরা এসে মোরগটি নিয়ে গেছেন। পরীক্ষা হবে। প্রকৃতির এ কোন খেয়াল, সেটা পরীক্ষা করে না দেখলে তো চলে না। এর চেয়েও বড় কথা, ব্যাপার এমন ঘটতে থাকলে তো কিছুদিন পর 'কাঁঠালের আমসত্ত্ব' ব্যাপারটিও আর অসম্ভব থাকবে না। সেটাও হয়তো পেয়ে যাব আমরা।
মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কাগজে আরেকটা খবর পড়ে রীতিমতো চমকে যাওয়ার অবস্থা। এক ভদ্রলোকের গর্ভে বেড়ে উঠছে ভ্রূণ। কিছুদিনের মধ্যেই শিশুর জন্ম হবে। না, কোনো পুরুষের গর্ভে শিশুর ভ্রূণ বেড়ে ওঠার খবর এটাই প্রথম নয়। এর আগেও পুরুষের গর্ভে শিশুর জন্মের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু টমাস বেটি যখন দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভধারণ করেন কিংবা স্কট মুর বা ম্যাট রাইস পুরুষ হয়েও গর্ভধারণ করেন- তখন তো চমকে যেতেই হয়। এতদিন ব্যাকরণে গর্ভবতী বলে একটা শব্দ ছিল। এখন সে শব্দটির বিপরীত লিঙ্গের, অর্থাৎ পুরুষবাচক শব্দ কী হবে, গর্ভবান? নারীর এই একটা গর্বের ব্যাপার ছিল গর্ভধারণ। এখন থেকে পুরুষরা একের পর এক গর্ভধারণ করতে থাকলে নারীর সেই গর্বের জায়গাটি কি আর থাকছে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকৃতির নিয়ম কি শেষ পর্যন্ত বদলে যাবে?
প্রকৃতি তার নিয়ম বদলাবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর এত আগে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে পুরুষের গর্ভধারণের গল্প কিন্তু আমরা পুরাণেও পাই। পুরনো কিছু বোঝাতে আমরা কথায় কথায় বলি 'মান্ধাতার আমল'। কে এই মান্ধাতা? সূর্যবংশীয় রাজা যুবনাশ্বের ছেলে মান্ধাতা। আসুন, বিষ্ণুপুরাণ থেকে জানা যাক তাঁর জন্মবৃত্তান্ত। দীর্ঘদিনেও রাজা যুবনাশ্বের কোনো পুত্রসন্তান না হওয়ায় মনের দুঃখে বনে গিয়ে তিনি মুনিদের আশ্রমে বাস করতে থাকেন। সেবা করতে থাকেন মুনিদের। একসময় মুনিদের মনে দয়ার উদ্রেক হলো। যুবনাশ্বের পুত্র কামনায় তাঁরা যজ্ঞ শুরু করলেন। যজ্ঞ শেষ হলো মাঝরাতে। যজ্ঞ শেষে মুনিগণ মন্ত্রপূত পানির কলস বেদীর ওপর রেখে ঘুমোতে চলে যান। তাঁদের ইচ্ছে ছিল, সকালে ওই কলস তাঁরা যুবনাশ্বকে দেবেন। তাঁর স্ত্রী ওই পানি পান করলে গর্ভবতী হবেন- এমন ভাবনা ছিল মুনিদের মনে। ওদিকে গভীর রাতে রাজা যুবনাশ্বের ঘুম ভেঙে গেল পিপাসায়। অত রাতে তিনি পানি কোথায় পাবেন? মুনিদের না জাগিয়ে তিনি পানি খুঁজতে শুরু করলেন। একসময় বেদীর ওপরে রাখা পানির কলস দেখে সেখান থেকে সব পানি পান করে ফেললেন।
ভোরবেলা মুরিরা ঘুম থেকে জেগে দেখেন, যজ্ঞকলসে একটুও পানি নেই। রাতে যে কলসে জল রাখা ছিল, সে জল গেল কোথায়? মুনিদের মাথায় হাত। খোঁজ করতেই রাজা যুবনাশ্ব জানালেন, গভীর রাতে তাঁর পিপাসা পাওয়ায় তিনি ওই পানি পান করেছেন। এখন কী হবে? যা হওয়ার তাই তা হবে। নিয়মের বাইরে তো আর যাওয়া যাবে না। মন্ত্রপূত পানির প্রভাবে রাজা যুবনাশ্বের গর্ভসঞ্চার হলো। মুনিদের আশীর্বাদে তিনি গর্ভধারণের কষ্ট থেকে রেহাই পেলেন। তবে নারীর মতো ১০ মাস ১০ দিন নয়, তাঁকে গর্ভধারণ করতে হলো পুরো একটা সেঞ্চুরি। শতবর্ষ গর্ভধারণের পর রাজা যুবনাশ্বের গর্ভ ভেদ করে (পৌরাণিক আমলের সিজারিয়ান আর কী!) ভূমিষ্ঠ হলো সূর্যের মতো তেজস্বী এক পুত্র। এই পুত্রের নাম মান্ধাতা। পিতৃরাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে মান্ধাতা বিশ্বজয় করতে বেরিয়েছিলেন। সে আরেক কাহিনী।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কী? চমকে যাওয়ার মতো কিছু নেই। অবাক হওয়ার কিছু নেই। যা কিছু ঘটার ছিল, সেটাই ঘটেছে- এমনটি ভেবে নিলে অবাক হওয়ারই বা কী আছে? চৌকিদার হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কে নগরকোটাল হয়ে গেল, উমেদার হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কে উজির কিংবা নাজির হয়ে গেল- তা নিয়ে ভেবে আমাদের লাভ নেই। কে কোথায় কোন যজ্ঞকলসের পানি পান করে বসে আছে, তা কি আর আমরা জানি?
তার চেয়ে আসুন, নচিকেতার গাওয়া একটি ব্যর্থতা সংগীত সমস্বরে গাই আমরা, 'আমাদের নাকি কিছু হবে না!'
লেখক : সাংবাদিক
No comments