অরণ্যে রোদন-প্রিয় প্রকাশকগণ, অনেক তো হলো... by আনিসুল হক
বাংলা একাডেমী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী বছর থেকে বইমেলা হবে কেবল প্রকাশকদের মেলা। কোনো সংগঠনের নামে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হবে না। আর বইমেলা সীমিত থাকবে কেবল একাডেমীর সীমানাপ্রাচীরের মধ্যে। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।
বইমেলা অবশ্যই প্রকাশকদের মেলা হওয়া উচিত, স্টলের সংখ্যা হওয়া উচিত কম, বিশেষ করে যখন ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা বাড়ছে, দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে, আর বাংলা একাডেমীর আঙিনা নতুন ভবন নির্মাণের কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। স্টলের সংখ্যা কম হলে হয়তো একটুখানি দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যাবে, জিরোনোর জায়গা যদি না-ও মেলে।
আমাদের দেশে প্রকাশকের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। বইয়ের প্রকাশনার মানও আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে। ঝকঝকে ছাপা, রঙিন প্রচ্ছদ, কোনো কোনো প্রকাশকের বইয়ের বাঁধাইও খুব ভালো, কাগজ ধবধবে সাদা। বইটা দেখলেই হাতে নিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পড়তে আরম্ভ করলেই বুঝবেন, রূপে চমৎকার বইটি আসলে ভুলে ভরা। ভুল বাক্য, ভুল বানান। এ ধরনের একটা বই ছাপা হওয়াই উচিত নয়!
বলতে পারেন, আপনারা লেখক, আপনারা খারাপ লেখেন বলেই বইটা খারাপ বেরোয়। সেটা একটা অভিযোগ হতে পারে বটে, আমি মানছি। কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলী কি রবীন্দ্রনাথ খারাপ লিখেছিলেন? ওই বই যখন বাংলাদেশ থেকে বেরোয়, তখন বেশির ভাগ প্রকাশনায় কেন ভুলের ছড়াছড়ি?
একটা কারণ, ভুলটাকে আমরা মেনে নিয়েছি। নির্ভুল বই বের করার আকাঙ্ক্ষা-প্রতিজ্ঞা কোনোটাই আমাদের নেই। এবং সম্ভবত অনেক প্রকাশকের সেই যোগ্যতাও নেই। রবীন্দ্রনাথের বই প্রকাশ করতে হলে যা দরকার তা হলো দক্ষ প্রুফ রিডার। আমাদের দেশে এই ক্ষেত্রটা চরম অবহেলিত। প্রুফ রিডারদের আমরা সম্মানও দিতে চাই না, সম্মানীও দিতে চাই না। যেকোনো একজনকে বসিয়ে দিই প্রুফ সংশোধনের কাজে। ফলে বইগুলোতে ভুল থেকেই যায়।
কিন্তু সব লেখক তো রবীন্দ্রনাথ নন। আবার খোদ রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির প্রতিচিত্রে আমরা দেখি, তিনি যে বানানে লিখেছেন, বই করার সময় সব সময় সেই বানান রাখা হয়নি। পরের দিকে তার বানানের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আনা হয়েছে। তার মানে যা দরকার তা হলো পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা। আমি যখন প্রথম আলোয় একটা লেখা জমা দিই, আমি জানি, এই লেখা আরও তিনজন পড়বেন, সম্পাদনা করবেন, কেবল বাক্য গঠনের ভুল কিংবা বানানের ভুল নয়, তথ্যের অসংগতি, বক্তব্যের অসামঞ্জস্য তারা দূর করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আমি যখন আমার লেখা কোনো প্রকাশকের হাতে তুলে দিই, আমি জানি, এই লেখা কেউ সম্পাদনা করবেন না। শুধু একজন প্রুফ সংশোধক, যিনি মোটেও পেশাদার নন, প্রুফ দেখে দেবেন। সেটাও কখনো কখনো বিপজ্জনক বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমি হয়তো লিখেছি ‘স্টিফেন হকিং’, প্রুফ সংশোধক সেটাকে ‘স্টিফেন হকিন্স’ করে দিয়েছেন। আমি হয়তো লিখেছি ‘ফুল তুলে মালা গাঁথি’, বই প্রকাশের পরে দেখি ছাপা হয়েছে ‘ফুল তোলে মালা গাঁথি’। প্রুফ সংশোধন যে একটা বিশেষ দক্ষতা ও যোগ্যতার ব্যাপার, সবার চোখে সব ভুল ধরা পড়ে না, এটা আমরা মনে রাখি না।
সারা পৃথিবীতেই বিখ্যাত মানুষদের আত্মজীবনীর বই বের হয়। পর্বতারোহী, গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, রাষ্ট্রপতি, কিংবা রাষ্ট্রপতির পত্নী, এঁরা বই লিখলে সে বই বিক্রি হয় ভালো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বইগুলো তাঁরা নিজেরা লেখেন না। তাঁদের জন্য লেখক নিযুক্ত করা হয়। তিনি ওই ব্যক্তির কাছ থেকে গল্প শুনে নিয়ে লিখে দেন। আর শুধু পাণ্ডুলিপি হাতে এলেই প্রকাশকেরা প্রকাশ করেন না। তাঁরা সেই পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেন। সে জন্য পেশাদার সম্পাদক আছেন। এই সম্পাদকেরা অনেক মাতব্বরিই করেন। বইয়ের নাম কী হবে, শুরুটা কেমন করে করতে হবে, কোন অংশ অপ্রয়োজনীয়, কোন অংশ আরেকটু বাড়াতে হবে, সম্পাদকেরা সে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেখকেরা সেই পরামর্শ মেনে নেন। বানান ভুল, বা বাক্যের ভুল তো অবশ্যই সংশোধিত হয়। তথ্যগত ভুল ধরার জন্যও সম্পাদক থাকে। এ কারণে অনেক দেশে একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির পর বই বের হতে বছরখানেক সময় লেগে যায়। আর ওই পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেও লেখক কমপক্ষে বছরখানেক সময় নেন। কেউ হয়তো তিন-চার বছর ধরেই পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন।
আমি চাই, আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সম্পাদক থাকুক। প্রকাশকদের বলি, প্রিয় প্রকাশকগণ, লাভ তো কম করলেন না, এবার একটু পেশাদার হোন। সম্পাদক নিয়োগ করুন। তাঁরা পাণ্ডুলিপি বাছবেন, পাণ্ডুলিপি ঘষামাজা করবেন। তাঁরা আমাকে পরামর্শ দেবেন, বলবেন, আপনি এই জায়গাটা একটু বদলে দিন। আপনার শেষটা ভালো হয়নি। আমরা জানি, টি এস এলিয়টের কবিতা ‘ওয়েস্ট ল্যান্ডে’র অনেক অংশ এজরা পাউন্ড ফেলে দিয়েছিলেন। তাতে ওই কবিতার শ্রীবৃদ্ধিই ঘটেছিল।
সারা পৃথিবীতেই নিজের খরচে বই বের করার রেওয়াজ আছে। এটা দোষের ব্যাপার নয়। কিন্তু ওই পাণ্ডুলিপিটাও সুসম্পাদিত হয়ে তারপর প্রকাশিত হওয়া উচিত। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি বলতে বাধ্য হব, আমাদের বাংলাদেশে প্রকাশিত বহু বই প্রকাশ না হলেই ভালো হতো। এগুলো ঠিক এই অবস্থায় প্রকাশযোগ্য নয়। হয়তো একটু সম্পাদিত হলে এই পাণ্ডুলিপিগুলো থেকেই সুন্দর বই প্রকাশ করা যেত।
আবার যাঁরা বলেন, বইমেলায় আমার পড়ার মতো কোনো বই নেই, তাদের সঙ্গেও আমি একমত নই। প্রতিবছরই বইমেলায় চমৎকার কিছু বই বেরোয়। সাম্প্রতিক লেখকদের বইয়ের কথায় পরে আসছি, আমাদের কি বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী বই সব পড়া হয়ে গেছে? আমরা কি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পুরো পড়ে ফেলেছি! বইমেলায় মুদ্রণপ্রমাদে কণ্টকিত রবীন্দ্রনাথ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি প্রতীক/অবসরের নির্ভুল রবীন্দ্র-নজরুল-মানিক-ওয়ালীউল্লাহ্ও তো পাওয়া যায়। এই বইমেলা এখন গোলাপ নিয়ে আবদুশ শাকুরের সহস্র পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করার যোগ্যতা যেমন অর্জন করেছে, তেমনি শিল্পীর চোখে ঢাকা নামের হাজার টাকা দামের বইটি তো এই বইমেলাতেই প্রথমা আনতে পেরেছে। আর আছেন আমাদের তরুণ প্রথাবিরোধী নতুন ধারার লেখকেরা। প্রতিবছর কোনো না কোনো তরুণ তারুণ্যের স্পর্ধা নিয়ে হাজির হন মেলায়। শুদ্ধস্বরের দিকে গেলে, লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে গেলে তাদের খোঁজ পাওয়া যায়। আর আছে অনুবাদের বই। অনুবাদের ক্ষেত্রেও আমি বলব, খারাপ অনুবাদের বই যেমন বের হয়, তেমনি ভালো হাতের সুন্দর অনুবাদের বইও বইমেলাতেই পাওয়া যায়। সেবা প্রকাশনীর প্রকাশনার নির্ভুলতা নিয়ে আমি সব সময়ই আস্থাবান। এবার প্রথমা থেকে প্রকাশিত কার্লোস ফুয়েন্তেসের আউরা কিংবা মারিও বার্গাস য়োসার বইটা নিয়ে দিব্যি সন্তোষ প্রকাশ করা চলে। এখানেও একটা ‘কিন্তু’ আছে। আমরা অনুবাদ করার সময় ও প্রকাশ করার আগে যথাযথ স্থান থেকে প্রায় ক্ষেত্রেই অনুমতি নিই না। এই কাজটাও আমাদের করতে পারতে হবে। মূল লেখকের বা প্রকাশকের অনুমতি ছাড়া অনুবাদ প্রকাশ করা উচিত নয়।
দুটো মজার ঘটনা বলে এই লেখা শেষ করব। রবার্ট লুইস স্টিফেনসন দি স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড হাইড ছয় দিনে দুইবার লিখেছিলেন। প্রথমবার লিখতে তাঁর সময় লেগেছিল তিন দিন। তাঁর স্ত্রী ফ্যানির সেটা ভালো লাগেনি, থ্রিলার-মার্কা লেগেছিল। ফ্যানি সে কথা স্বামীকে জানালে যা হয় তাই হয়েছিল। লেখক রেগে গিয়েছিলেন। পরে তিনি ভেবে দেখলেন, বউয়ের কথাই ঠিক। আগুনে সেই পাণ্ডুলিপি ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবার লিখতে বসলেন। মাত্র তিন দিনে লিখে ফেললেন সেই বইটি, যা আজও আমরা পড়ে থাকি। কাজেই তিন দিনে বই লিখলেই খারাপ হয় না, আবার তিন বছর ধরে লিখলেই ভালো হবে, এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।
বিখ্যাত নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক স্যামুয়েল বেকেটের একটি উপন্যাস মারফি মোট ৪২ জন প্রকাশক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তারপর ৪৩তম প্রকাশক সেটা ছাপেন। সেটা বিক্রিও হয়নি, তার কোনো প্রশংসাও জোটেনি। স্যামুয়েল বেকেটের সাফল্য শুরু হয় তাঁর ৪৭ বছর বয়সে। ৮০ বছর বয়সে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
মিরোস্লাভ হোলুবের একটা কবিতায় স্যামুয়েল বেকেটের একটা উদ্ধৃতি আছে। এই কবিতাটা আমার খুব প্রিয়, আর প্রিয় এর ভেতরে ব্যবহূত বেকেটের কথাটা।
“যদিও শিল্পী হওয়া মানেই ব্যর্থ হওয়া আর শিল্প মাত্রই ব্যর্থতার বশংবদ—যেমনটা বলেছেন স্যামুয়েল বেকেট, কবিতা তবুও মানুষের শেষ কাজগুলোর নয়, প্রথম কাজগুলোর একটি।”
যিনি শিল্পী তাঁকে ব্যর্থ হতেই হবে। আর যিনি ব্যর্থ হবেন, তাঁর হাত দিয়েই সম্ভব হবে শিল্প।
কাজেই ব্যর্থতাকে আমরা ভয় পাই না। ব্যর্থতার আগুনে পুড়েই একদিন হয়তো আমাদের হাত থেকেই শিল্পরচনা সম্ভবপর হয়ে উঠবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আমাদের দেশে প্রকাশকের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। বইয়ের প্রকাশনার মানও আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে। ঝকঝকে ছাপা, রঙিন প্রচ্ছদ, কোনো কোনো প্রকাশকের বইয়ের বাঁধাইও খুব ভালো, কাগজ ধবধবে সাদা। বইটা দেখলেই হাতে নিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পড়তে আরম্ভ করলেই বুঝবেন, রূপে চমৎকার বইটি আসলে ভুলে ভরা। ভুল বাক্য, ভুল বানান। এ ধরনের একটা বই ছাপা হওয়াই উচিত নয়!
বলতে পারেন, আপনারা লেখক, আপনারা খারাপ লেখেন বলেই বইটা খারাপ বেরোয়। সেটা একটা অভিযোগ হতে পারে বটে, আমি মানছি। কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলী কি রবীন্দ্রনাথ খারাপ লিখেছিলেন? ওই বই যখন বাংলাদেশ থেকে বেরোয়, তখন বেশির ভাগ প্রকাশনায় কেন ভুলের ছড়াছড়ি?
একটা কারণ, ভুলটাকে আমরা মেনে নিয়েছি। নির্ভুল বই বের করার আকাঙ্ক্ষা-প্রতিজ্ঞা কোনোটাই আমাদের নেই। এবং সম্ভবত অনেক প্রকাশকের সেই যোগ্যতাও নেই। রবীন্দ্রনাথের বই প্রকাশ করতে হলে যা দরকার তা হলো দক্ষ প্রুফ রিডার। আমাদের দেশে এই ক্ষেত্রটা চরম অবহেলিত। প্রুফ রিডারদের আমরা সম্মানও দিতে চাই না, সম্মানীও দিতে চাই না। যেকোনো একজনকে বসিয়ে দিই প্রুফ সংশোধনের কাজে। ফলে বইগুলোতে ভুল থেকেই যায়।
কিন্তু সব লেখক তো রবীন্দ্রনাথ নন। আবার খোদ রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির প্রতিচিত্রে আমরা দেখি, তিনি যে বানানে লিখেছেন, বই করার সময় সব সময় সেই বানান রাখা হয়নি। পরের দিকে তার বানানের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আনা হয়েছে। তার মানে যা দরকার তা হলো পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা। আমি যখন প্রথম আলোয় একটা লেখা জমা দিই, আমি জানি, এই লেখা আরও তিনজন পড়বেন, সম্পাদনা করবেন, কেবল বাক্য গঠনের ভুল কিংবা বানানের ভুল নয়, তথ্যের অসংগতি, বক্তব্যের অসামঞ্জস্য তারা দূর করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আমি যখন আমার লেখা কোনো প্রকাশকের হাতে তুলে দিই, আমি জানি, এই লেখা কেউ সম্পাদনা করবেন না। শুধু একজন প্রুফ সংশোধক, যিনি মোটেও পেশাদার নন, প্রুফ দেখে দেবেন। সেটাও কখনো কখনো বিপজ্জনক বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমি হয়তো লিখেছি ‘স্টিফেন হকিং’, প্রুফ সংশোধক সেটাকে ‘স্টিফেন হকিন্স’ করে দিয়েছেন। আমি হয়তো লিখেছি ‘ফুল তুলে মালা গাঁথি’, বই প্রকাশের পরে দেখি ছাপা হয়েছে ‘ফুল তোলে মালা গাঁথি’। প্রুফ সংশোধন যে একটা বিশেষ দক্ষতা ও যোগ্যতার ব্যাপার, সবার চোখে সব ভুল ধরা পড়ে না, এটা আমরা মনে রাখি না।
সারা পৃথিবীতেই বিখ্যাত মানুষদের আত্মজীবনীর বই বের হয়। পর্বতারোহী, গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, রাষ্ট্রপতি, কিংবা রাষ্ট্রপতির পত্নী, এঁরা বই লিখলে সে বই বিক্রি হয় ভালো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বইগুলো তাঁরা নিজেরা লেখেন না। তাঁদের জন্য লেখক নিযুক্ত করা হয়। তিনি ওই ব্যক্তির কাছ থেকে গল্প শুনে নিয়ে লিখে দেন। আর শুধু পাণ্ডুলিপি হাতে এলেই প্রকাশকেরা প্রকাশ করেন না। তাঁরা সেই পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেন। সে জন্য পেশাদার সম্পাদক আছেন। এই সম্পাদকেরা অনেক মাতব্বরিই করেন। বইয়ের নাম কী হবে, শুরুটা কেমন করে করতে হবে, কোন অংশ অপ্রয়োজনীয়, কোন অংশ আরেকটু বাড়াতে হবে, সম্পাদকেরা সে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেখকেরা সেই পরামর্শ মেনে নেন। বানান ভুল, বা বাক্যের ভুল তো অবশ্যই সংশোধিত হয়। তথ্যগত ভুল ধরার জন্যও সম্পাদক থাকে। এ কারণে অনেক দেশে একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির পর বই বের হতে বছরখানেক সময় লেগে যায়। আর ওই পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেও লেখক কমপক্ষে বছরখানেক সময় নেন। কেউ হয়তো তিন-চার বছর ধরেই পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন।
আমি চাই, আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সম্পাদক থাকুক। প্রকাশকদের বলি, প্রিয় প্রকাশকগণ, লাভ তো কম করলেন না, এবার একটু পেশাদার হোন। সম্পাদক নিয়োগ করুন। তাঁরা পাণ্ডুলিপি বাছবেন, পাণ্ডুলিপি ঘষামাজা করবেন। তাঁরা আমাকে পরামর্শ দেবেন, বলবেন, আপনি এই জায়গাটা একটু বদলে দিন। আপনার শেষটা ভালো হয়নি। আমরা জানি, টি এস এলিয়টের কবিতা ‘ওয়েস্ট ল্যান্ডে’র অনেক অংশ এজরা পাউন্ড ফেলে দিয়েছিলেন। তাতে ওই কবিতার শ্রীবৃদ্ধিই ঘটেছিল।
সারা পৃথিবীতেই নিজের খরচে বই বের করার রেওয়াজ আছে। এটা দোষের ব্যাপার নয়। কিন্তু ওই পাণ্ডুলিপিটাও সুসম্পাদিত হয়ে তারপর প্রকাশিত হওয়া উচিত। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি বলতে বাধ্য হব, আমাদের বাংলাদেশে প্রকাশিত বহু বই প্রকাশ না হলেই ভালো হতো। এগুলো ঠিক এই অবস্থায় প্রকাশযোগ্য নয়। হয়তো একটু সম্পাদিত হলে এই পাণ্ডুলিপিগুলো থেকেই সুন্দর বই প্রকাশ করা যেত।
আবার যাঁরা বলেন, বইমেলায় আমার পড়ার মতো কোনো বই নেই, তাদের সঙ্গেও আমি একমত নই। প্রতিবছরই বইমেলায় চমৎকার কিছু বই বেরোয়। সাম্প্রতিক লেখকদের বইয়ের কথায় পরে আসছি, আমাদের কি বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী বই সব পড়া হয়ে গেছে? আমরা কি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পুরো পড়ে ফেলেছি! বইমেলায় মুদ্রণপ্রমাদে কণ্টকিত রবীন্দ্রনাথ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি প্রতীক/অবসরের নির্ভুল রবীন্দ্র-নজরুল-মানিক-ওয়ালীউল্লাহ্ও তো পাওয়া যায়। এই বইমেলা এখন গোলাপ নিয়ে আবদুশ শাকুরের সহস্র পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করার যোগ্যতা যেমন অর্জন করেছে, তেমনি শিল্পীর চোখে ঢাকা নামের হাজার টাকা দামের বইটি তো এই বইমেলাতেই প্রথমা আনতে পেরেছে। আর আছেন আমাদের তরুণ প্রথাবিরোধী নতুন ধারার লেখকেরা। প্রতিবছর কোনো না কোনো তরুণ তারুণ্যের স্পর্ধা নিয়ে হাজির হন মেলায়। শুদ্ধস্বরের দিকে গেলে, লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে গেলে তাদের খোঁজ পাওয়া যায়। আর আছে অনুবাদের বই। অনুবাদের ক্ষেত্রেও আমি বলব, খারাপ অনুবাদের বই যেমন বের হয়, তেমনি ভালো হাতের সুন্দর অনুবাদের বইও বইমেলাতেই পাওয়া যায়। সেবা প্রকাশনীর প্রকাশনার নির্ভুলতা নিয়ে আমি সব সময়ই আস্থাবান। এবার প্রথমা থেকে প্রকাশিত কার্লোস ফুয়েন্তেসের আউরা কিংবা মারিও বার্গাস য়োসার বইটা নিয়ে দিব্যি সন্তোষ প্রকাশ করা চলে। এখানেও একটা ‘কিন্তু’ আছে। আমরা অনুবাদ করার সময় ও প্রকাশ করার আগে যথাযথ স্থান থেকে প্রায় ক্ষেত্রেই অনুমতি নিই না। এই কাজটাও আমাদের করতে পারতে হবে। মূল লেখকের বা প্রকাশকের অনুমতি ছাড়া অনুবাদ প্রকাশ করা উচিত নয়।
দুটো মজার ঘটনা বলে এই লেখা শেষ করব। রবার্ট লুইস স্টিফেনসন দি স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড হাইড ছয় দিনে দুইবার লিখেছিলেন। প্রথমবার লিখতে তাঁর সময় লেগেছিল তিন দিন। তাঁর স্ত্রী ফ্যানির সেটা ভালো লাগেনি, থ্রিলার-মার্কা লেগেছিল। ফ্যানি সে কথা স্বামীকে জানালে যা হয় তাই হয়েছিল। লেখক রেগে গিয়েছিলেন। পরে তিনি ভেবে দেখলেন, বউয়ের কথাই ঠিক। আগুনে সেই পাণ্ডুলিপি ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবার লিখতে বসলেন। মাত্র তিন দিনে লিখে ফেললেন সেই বইটি, যা আজও আমরা পড়ে থাকি। কাজেই তিন দিনে বই লিখলেই খারাপ হয় না, আবার তিন বছর ধরে লিখলেই ভালো হবে, এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।
বিখ্যাত নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক স্যামুয়েল বেকেটের একটি উপন্যাস মারফি মোট ৪২ জন প্রকাশক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তারপর ৪৩তম প্রকাশক সেটা ছাপেন। সেটা বিক্রিও হয়নি, তার কোনো প্রশংসাও জোটেনি। স্যামুয়েল বেকেটের সাফল্য শুরু হয় তাঁর ৪৭ বছর বয়সে। ৮০ বছর বয়সে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
মিরোস্লাভ হোলুবের একটা কবিতায় স্যামুয়েল বেকেটের একটা উদ্ধৃতি আছে। এই কবিতাটা আমার খুব প্রিয়, আর প্রিয় এর ভেতরে ব্যবহূত বেকেটের কথাটা।
“যদিও শিল্পী হওয়া মানেই ব্যর্থ হওয়া আর শিল্প মাত্রই ব্যর্থতার বশংবদ—যেমনটা বলেছেন স্যামুয়েল বেকেট, কবিতা তবুও মানুষের শেষ কাজগুলোর নয়, প্রথম কাজগুলোর একটি।”
যিনি শিল্পী তাঁকে ব্যর্থ হতেই হবে। আর যিনি ব্যর্থ হবেন, তাঁর হাত দিয়েই সম্ভব হবে শিল্প।
কাজেই ব্যর্থতাকে আমরা ভয় পাই না। ব্যর্থতার আগুনে পুড়েই একদিন হয়তো আমাদের হাত থেকেই শিল্পরচনা সম্ভবপর হয়ে উঠবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments