শ্রদ্ধাঞ্জলি-অক্ষরানন্দজি : মানবসেবার প্রতীক
অসুস্থ অবস্থায় শ্রী রামকৃষ্ণ দেব বিছানা থেকে উঠে এসে নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে কথা বলার এক চূড়ান্ত মুহূর্তে গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভক্তি এবং ব্যাকুলতায় আপ্লুত হয়েছিলেন কল্পতরু। নাটকে লোকশিক্ষা হয়_কথাটা ঠাকুর যেভাবে বলে আনন্দ পেতেন, সেভাবেই নাট্যকার গিরিশকে ভালোবাসতেন।
শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের ভাব ও আদর্শের পূজারি স্বামী অক্ষরানন্দ মহারাজের কাছ থেকে অনেকটা সে রকম ভালোবাসা ও স্নেহ আরো অনেকের মতো আমরাও পেলাম। লন্ডন থেকে বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মনোজ মিত্রের রচনা এবং নির্দেশক আলী যাকের নির্দেশিত দেশ নাট্যদল প্রযোজিত নাটক 'দর্পণে শরৎশশী'র ওপর লিখিত রিভিউ যখন ছাপা হলো লন্ডন থেকে প্রকাশিত 'সাপ্তাহিক জনমত' পত্রিকায়, তখন সেই পত্রিকা মহারাজকে দেখানো মাত্রই মহারাজের শিশুর মতো কী আনন্দ। এ ঘটনার দুদিন আগে আমারই দাদা গ্রামীণফোনের কর্মকর্তা, তিনি মোবাইল ফোনসেট দিয়েই একটি ছবি তুললেন। ছবিতে বড় মহারাজ পত্রিকা পড়ছেন। পড়ায় নিমগ্নতা, চারদিকে ফুটে ওঠা ফুল, অবয়বে আভিজাত্য_সব মিলেমিশে ছবিটা বড় মহারাজের দারুণ প্রিয়। ক্যালেন্ডারে সেই দিনের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১১। স্থান রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রাঙ্গণ। বড় বাঁধাই করে ছবিটি ভক্তরা যখন যে যাঁর মতো সংগ্রহ করছেন, তখন মহারাজের মনে বিস্ময়_ছবিটি এত ভালো হলো অথচ ওর হাতে তো কোনো দিন ক্যামেরা দেখলাম না। প্রশ্ন : 'তাহলে তুমি ছবিটি কিভাবে তুললে? তুমি কী মনে করেছ এটা তোমার ক্রেডিট?' সবিনয়ে উত্তর : না, মহারাজ। যা হয়েছে, তা ঠাকুরের ইচ্ছায়ই হয়েছে। সব কিছুরই একটা সমাপ্তি হয়। বড় মহারাজকে দাহ করা হয় রাজারবাগ বরদেশ্বরী কালীমন্দির মহাশ্মশানে। চিতায় অগি্ন জ্বলল, নিভল, জল ঢালা হলো। একে একে ভক্ত-সন্ন্যাসীরা যাঁর যাঁর মতো করে ফিরলেন পরবর্তী কাজ সম্পন্ন করার জন্য। ইউনিট উত্তরণের ছেলেরাও ফিরল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পুকুরের জলে আঁধার নামল। জলে হাত-মুখ ধুয়ে আমরা তিনজন এসে দাঁড়ালাম সদ্য নেভা চিতার পাশে। আগুন নিভেছে, কিন্তু তাপের উষ্ণতা তখনো ছড়িয়ে। চিতার বেদিতে একটি ফুলের মালা। এক অদ্ভুত ঘোরে মন-প্রাণ আপ্লুত। পাশে দাঁড়ানো শুভাশীষ, যিনি করেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ দেব চরিত্রে অভিনয়। তাঁর পাশে অরুণাংশু, যিনি করেন স্বামী বিবেকানন্দ চরিত্রে অভিনয়। আর আমি, আমার নেই কোনো পরিচয়। বড় মহারাজ শুধু বলতেন, 'তুমি লেখো, নাটক লেখো।' এ কথা এখন আর কে বলবেন? এই সংশয় নিয়ে যখন বেদিতে তাকিয়েছি, তখন মনে ভাসল, 'হোমলেস টু হার্ভার্ড' চলচ্চিত্রের কথা, যেখানে মৃত মায়ের কফিনের পাশে বসে মেয়ে লিজা জানতে চাইছে_মা, তোমার ঘর কোথায়? তুমি যখন দাদুর ঘরে ছিলে, তখন সেটা ছিল তোমার ঘর। যখন স্বামীর ঘরে, তখন সেটা তোমার ঘর। আর আজ যখন এই এখানে, এখানেই তোমার ঘর। তাহলে তোমার ঘর কোথায়? কিছুক্ষণ পর লিজা নিজের মতো নিজেই উত্তর পেল। ঘর আসলে মনে। লিজার মায়ের ঘর লিজার মনে। ঠিক তেমনি পূর্ব আশ্রমে সাতক্ষীরায় বড় মহারাজের যে ঘর, সন্ন্যাস-জীবনের নরেন্দ্রপুরে যে ঘর, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে যে ঘর, অগি্ন এবং অগি্নর দাহিকা শক্তির মাঝে যে ঘর, এত ঘরের মাঝে বড় মহারাজের কোন ঘরটি চিরস্থায়ী ঘর। উত্তরও মিলল। রামকৃষ্ণ ভাবতরঙ্গে অবগাহন করা আমাদের বড় মহারাজ স্বামী অক্ষরানন্দজি মহারাজের ঘর প্রকৃতপক্ষে ভক্তহৃদয়ে। ১৮ এপ্রিল ২০১১ ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি দেহত্যাগ করেন। দেশ-বিদেশে যে অসংখ্য ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী মহারাজের স্পর্শে এসেছেন, তাঁদের সবার হৃদয়ে বড় মহারাজ অধীস্থান। আর যিনি হৃদয় মাঝে, তিনি যে বিপদে-সম্পদে, জ্ঞানে-অজ্ঞানে, ভালোয়-মন্দয় কখনো আমাদের অনাথ করবেন না, সেটাই তো ধ্রুব সত্য। তিনি ছিলেন মানবসেবার প্রতীক। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
অপূর্ব কুমার কুণ্ডু
No comments