বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা-দিন ফুরাল মেলার by আশীষ-উর-রহমান

পেরিয়ে তো গেলই দিনগুলো। আগামীকাল ঝাঁপ বন্ধ হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলার। ফেব্রুয়ারি বছরের স্বল্পায়ু মাস। এবার এক দিন বেশি তার পরমায়ু। সে কারণেই মেলা গড়াচ্ছে বুধবার অবধি। বাড়তি দিনটিতে কিছু নতুন বইও আসবে। বেচাকেনাও চলবে। তারপর আবার এক বছরের অপেক্ষা।


মেলার শেষ দিনগুলোতে যাঁরা আসছেন, তাঁদের আড্ডা-আলাপের তেমন গরজ নেই। বই কেনাটাই মুখ্য। গতকাল সোমবার মেলায় আসা অধিকাংশ মানুষের হাতেই ছিল সদ্য কেনা বইয়ের প্যাকেট। স্টলগুলোর সামনে বেশ ভিড়। এর আগের দিনগুলোতে অনেকের মেলায় আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো। সময় আছে, বই পরেও কেনা যাবে—এই ছিল মনোভাব। এখন তার উল্টো। সময় নেই। বই আগে কিনতে হবে। আড্ডা দেওয়া যাবে পরেও। এ জন্য শেষ দিনগুলোতে প্রকাশকেরা বেশ প্রফুল্লচিত্ত।
গতবারের রেকর্ড ভেঙেছে
শুরু থেকেই একাডেমীর পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল, এবার মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ও বিক্রি উভয়ই বাড়বে। বাস্তবেও তা-ই হয়েছে প্রকাশনার ক্ষেত্রে। গত বছর তথ্যকেন্দ্রের তালিকায় নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ১৩টি। এবার ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নতুন বই এসেছে তিন হাজার ৪২৩টি। বাকি দুই দিনে আরও দেড় শ থেকে দুই শ নতুন বই আসতে পারে।
গতকাল পর্যন্ত প্রকাশিত নতুই বইয়ের মধ্যে কাব্যগ্রন্থ সর্বাধিক—৭৫৬টি। উপন্যাস ৫১১টি, গল্পগ্রন্থ ৩৭৯টি ও প্রবন্ধগ্রন্থ ২৪৬টি।
২৬ বছর পর হেলাল হাফিজ
প্রথম কাব্যগ্রন্থেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ লিখে কিংবদন্তিতে পরিণতপ্রায়। কবি হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ যে জলে আগুন জ্বলে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তারপর আর তাঁর নতুন বই আসেনি মেলায়। এবার ২৬ বছর পর এল কবিতা একাত্তর। হেলাল হাফিজ প্রথম আলোকে জানালেন, এতে কবিতা আছে ৭১টি। মহান মুক্তিযুুদ্ধের চার দশক পূর্ণ হলো। মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করেই ৭১টি কবিতা নিয়ে এই বই। এটি অবশ্য মৌলিক গ্রন্থ নয়। আগের বইটির ৫৬টি কবিতার সঙ্গে নতুন কবিতা আছে ১৫টি। বইটি দ্বিভাষিক। বাংলার সঙ্গে আছে ইংরেজি অনুবাদ। প্রকাশ করেছে বিভাস। তাঁর অনুরাগী পাঠকদের একটি আনন্দের সংবাদও দিলেন। নতুন একটি কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করছেন। নামও ঠিকঠাক, বেদনাকে বলেছি কেঁদো না।
নীতিমালা বদলানো প্রয়োজন
মেলাকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করার জন্য আগামী বছর থেকে শুধুই প্রকাশকদের নিয়ে মেলা আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন একাডেমীর মহাপরিচালক। তবে প্রকাশকেরা বলেছেন, এর সঙ্গে বইয়ের মান উন্নয়নের জন্য মেলার নীতিমালাও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। বর্তমান নীতিমালা অনুসারে স্টল বরাদ্দ পেতে কমপক্ষে ২০টি নতুন বই প্রকাশ করতে হয়। বড় ও মাঝারি মিলে মোটামুটি ভালো বই করেন এমন প্রকাশকের সংখ্যা প্রায় ২০০। ‘এত মানসম্মত পাণ্ডুলিপি কোথায়?’ প্রশ্নটি তুললেন রোদেলা প্রকাশনীর মো. রিয়াজ খান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, লেখকদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি পেতেই জুন পেরিয়ে যায়। সম্পাদনার সময় থাকে না। দ্রুত কাজ করতে গিয়ে মুদ্রণ প্রমাদসহ নানা ত্রুটি থেকে যায়। উপরন্তু ২০টি ভালো পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় না। তখন যেমন-তেমন বই ছাপতে হয়। এখন অনেক শিল্পপতির স্ত্রী, কণ্ঠশিল্পী বা অভিনয়শিল্পী পাণ্ডুলিপি নিয়ে আসেন। তাঁরাই টাকা দিয়ে বই ছাপিয়ে নেন। রাজনৈতিক নেতারাও আসেন। সারা বছর তাঁরা যে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন, সেগুলোও একত্র করে মেলায় বই প্রকাশ করেন নিজ খরচে। ফলে হাজার হাজার বই বের হচ্ছে। বইয়ের মানের দিকে নজর দেওয়ার গরজ বোধ হচ্ছে না। যদি ওই কুড়িটি বইয়ের নিয়ম উঠিয়ে দেওয়া হতো বা সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে প্রকৃত প্রকাশকেরা মানসম্মত বই করতে পারতেন।’
নতুন বই
গতকাল নতুন বই এসেছে ৮৫টি। জিনিয়াস থেকে হরিপদ দত্তের গল্পসমগ্র, সময় থেকে কবীর চৌধুরী অনূদিত সমকালীন আফ্রিকান ছোটগল্প, অ্যাডর্ন থেকে ফয়েজ আহ্মদের মজার পড়া ১০০ ছড়া, সিসটেক থেকে মোজাহিদুল ইসলামের কম্পিউারবিষয়ক মাস্টারিং ই-কমার্স। এ ছাড়া রয়েছে অন্যপ্রকাশ থেকে মুস্তাফা জামান আব্বাসীর নজরুলবিষয়ক পুড়িব একাকী, অন্বেষা থেকে সুমনকুমার দাশের বাংলাদেশের বাউল ফকির পরিচিতি ও গান, সাহিত্য প্রকাশ থেকে হারুণ হাবিবের লুকিং বিয়ন্ড বাউন্ডারিজ। বইটিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ইসলামি জঙ্গিবাদ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখকের প্রবন্ধগুলো স্থান পেয়েছে। নবযুগ থেকে এসেছে মাহবুবুল হকের প্রবন্ধ সংকলন, বর্ষা দুপুর থেকে এসেছে তারকাদের নিয়ে লেখা সুমন পাটওয়ারীর স্বপ্নের তারকা তারকার স্বপ্ন, জ্যোৎস্না প্রকাশন থেকে সন্তোষ গুপ্তের শিল্পকলাবিষয়ক বাংলাদেশের চিত্রকলা: শিল্পী ও শিল্পীরূপ, কাশবন প্রকাশন থেকে এসেছে সৈয়দ আবদাল আহমেদের ঢাকাবিষয়ক গ্রন্থ বুড়িগঙ্গার তীরের রহস্য নগরী, গোল্ডেন বাংলাদেশ থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলম সম্পাদিত আয়করের সহজ ব্যবহারিক গাইড, মোকারম হোসেনের নিসর্গবিষয়ক আমাদের পার্ক ও উদ্যান এবং ছয় রঙের বাংলাদেশ, সমাচার থেকে শামসুজ্জামান শামসের ক্রীড়াবিষয়ক গ্রন্থ বিশ্ববিখ্যাত ৫০ ফুটবলার।
বিদ্রোহীর ৯০ বছর
মেলা মঞ্চে গতকাল ছিল ‘নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছর’ শীর্ষক আলোচনা। প্রবন্ধ পড়েন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। আলোচনা করেন জহিরুল হক ও হাসান আল যায়েদ। সভাপতিত্ব করেন আসাদুল হক। শেষে ছিল লোকসংগীত।

No comments

Powered by Blogger.