সাদা-কালো জীবনের দীর্ঘশ্বাস by নাজমুজ্জামান নোমান

মূল রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে চোখে পড়ে পথের এক গলিতে ছেলেমেয়েরা বৃষ্টিতে জমে থাকা নোংরা পানিতে খুনসুটিতে ব্যস্ত। তাদের পাশেই সংকুচিতভাবে অবস্থিত টিনশেডের বেশ কিছু রুম। সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে কক্ষগুলো। এরূপ অগোছালো এক কক্ষের ভেতর ঢুকে তিন সন্তান নিয়ে খাবার খেতে দেখা গেল এক নারীকে।


ফ্যান আছে ঠিকই, নেই বিদ্যুৎ। তার পাশেই খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে আছেন ক্লান্ত পুরুষ। কিছুক্ষণ পর এক পশলা বৃষ্টি এসে হাঁটু সমান জল জমিয়ে দিয়ে গেল কক্ষের সামনে সরু রাস্তাগুলোতে। এমন কিছু অবিন্যস্ত চিত্র পুরান ঢাকার প্রতিটি বস্তিতে যে কারোর চোখে পড়বে। শুধু পুরান ঢাকাতেই নয়, জীবনের অন্তিম সম্বলটুকু হারিয়ে এরূপ হাজারো বস্তিবাসীর আশ্রয়স্থল নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা এ অলিগলিতে। দুঃখ ঘোচানোর কিঞ্চিৎ আশা বুকে নিয়ে যারা বাসা বেঁধেছেন এখানে, তার কতটুকুই-বা পেয়েছেন তারা? কেমন করেইবা কাটছে তাদের দিনগুলো? জানার চেষ্টা করেছিলাম সম্প্রতি নগর দরিদ্রতার ওপর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ স্যারের একটি সার্ভেতে গিয়ে।
পুরান ঢাকার ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের বস্তিতে বসবাস করছেন আনোয়ার, নুরজাহান ও রোজিনা। কী কারণে এখানে আসা জানার চেষ্টা করেছিলাম তাদের কয়েকজনের কাছে। আনোয়ারা ও নুরজাহান বললেন, নদীভাঙনের ফলে আজ তাদের এখানে বসবাস। রোজিনা জানান অন্য কথা। ঢাকায় বাসা ভাড়া বেশি। তাই স্বামী রিকশা চালিয়ে যা আয় করেন তাতেই স্বল্প খরচে কোনো রকমে দিন কেটে যায় তাদের। তবে পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ ও পানির সমস্যা তাদের ভোগান্তির প্রধান কারণ। পুরান ঢাকা থেকে বের হয়ে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে দেখা মেলে বেশকিছু প্রতিবন্ধী বস্তিবাসীর সঙ্গে। তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে এসে ভিক্ষা করে দিন কাটাচ্ছেন। এখানে কথা হয় তেমনি এক প্রতিবন্ধী নারী জমিলার সঙ্গে। তিনি একটি বিস্কুট বা কেক দিয়ে সকাল শুরু করেন। হাত-পায়ের বেশকিছু আঙুল না থাকায় রান্না করতে অক্ষম জমিলা। এ জন্য প্রায় দুপুর তার কাটে অনাহারে। রাতে সুযোগ পেলে হোটেল থেকে খেয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েন স্টেশনের পাশে অবস্থিত এ বস্তিটিতে। এখানে বসবাসকারী অন্য দুই বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ও হালিমা। তাদের বাসা রংপুরে। শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে কেউ কাজ দিতে রাজি হয় না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় আসা। তাদের প্রত্যেকের একটি আক্ষেপ, সরকার প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কত কিছু করছে। এর ছিটেফোঁটাও মিলছে না তাদের। মিরপুরের পল্লবী, ব্লক-ডি, সেকশন-১২-তে গড়ে ওঠা একটি বস্তির নাম বেগুনটিলা। এটি সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ২০০৩ সালে। বস্তি নিয়ন্ত্রণকারী সমবায় সমিতির কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অন্যান্য বস্তি থেকে উচ্ছেদের পর এখানে তাদের বাসস্থান গড়ে ওঠে। পুরান ঢাকা এবং এখানে বিদ্যুৎ খরচে রয়েছে বিস্তর ফারাক। বস্তিতে বসবাসরত কর্মক্ষম লোকের পাশাপাশি বিধবা নারীদের এমন অনেক কথা মনে দাগ কেটে যায়।
জরিপ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে কোথায় নগরীর বস্তিবাসীর দরিদ্রতার শিকড়? এর সঙ্গে জানার চেষ্টা করা হয়েছে লুকিয়ে থাকা অজানা বিভিন্ন তথ্য। এখানকার শিক্ষা, বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পারি তার সারমর্ম ঠিক এ রকম_ দিনে যা রোজগার করা হয় তাতে খাবার চাহিদা শেষে সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া অনেকটাই দুরূহ ব্যাপার। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় তাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একাধিক পরিবারের বিদ্যুৎ খরচ মেটানো সম্ভব। স্যানিটেশন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নেই কোনো স্বাধীনতা। তাই বাধ্য হয়ে কয়েকটি পরিবারকে ব্যবহার করতে হয় একটি টয়লেট। হঠাৎ বৃষ্টি এসে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা এখানকার ড্রেনেজ সমস্যার চিত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ রকম জলাবদ্ধতা থেকে পানিবাহী অনেক রোগ ছড়াচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে।
জীবনের গল্প এগিয়ে যায় তার নিজস্ব গতিবেগে। কিন্তু এ গতিবেগ সবসময় একই রকম থাকে না? কারও হারিয়ে যায় এঁদো গলিতে। কারও আবার পথের বাঁকেই নিঃশেষিত হয় সবটুকু কাহিনী। সেখানে ছাপ নেই বিত্তবৈভবের স্বপি্নল রঙের ছটা। কালো ধোঁয়া, ঘাম আর মরচেপড়া স্বপ্নে আচ্ছাদিত থাকে তাদের জীবন। ক্লান্তি আসার ফুরসতেই এসে জোটে নতুন কোনো সাদা-কালো দিনের গল্প। একই জীবনে অনাগত ভবিষ্যৎ পায় না আড়ম্বর আগমনী সম্ভাষণ। প্রজন্ম মানেই ওখানে বাড়তি বোঝা। তবু ওরা বোঝার পাহাড় বয়ে চলে হাসিমুখে। জানা নেই কাল কী হবে! শুধু জানে চলতে হবে, বাঁচতে হবে যতদিন বাঁচা যায়।
noman.ju2010@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.