সমুদ্রবক্ষে গ্যাস চুক্তি :আশা না আশঙ্কা?
প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবু ইসহাক রচিত 'জোঁক' নামক কালজয়ী গল্পে পড়েছিলাম ওসমান নামের এক বর্গাচাষির কথা। পরাক্রমশালী ইউসুফ সাহেবের হয়ে পাট বর্গাচাষে নেমে অজ্ঞতা আর অনভিজ্ঞতার কারণে তাকে হারাতে হয় প্রাপ্য ফসল।
সম্প্রতি বিদেশি এক গ্যাস কোম্পানিকে আমাদের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস আবিষ্কার ও উত্তোলনের জন্য প্রদান করাকে অনেকে বর্গাচাষির কাছে বর্গাদারের জমি ধার দেওয়ার মতোই বিবেচনা করে থাকতে পারেন। খসড়া মডেল পিএসসি-২০০৮-এর সাপেক্ষেই আমরা সাধ্যমতো এই চুক্তির বিভিন্ন দিক ব্যবচ্ছেদ করার প্রয়াস করেছি।
কতটুকু গ্যাস পাবে বাংলাদেশ : সবচেয়ে উদ্বেগজনক অংশটি দিয়েই শুরু করি। চুক্তির ১৫.৫.৪ ধারাটিতে বলা হয়েছে, "যে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা স্থানীয় চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা (পাইপলাইন) স্থাপন করতে পারবে, সে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রফিট গ্যাস রাখার অধিকারপ্রাপ্ত হবে, তবে তা কোনোমতেই মোট মার্কেটেবল গ্যাসের (অর্থাৎ মোট উৎপাদিত গ্যাস=কস্ট রিকভারি গ্যাস+কনোকোফিলিপের প্রফিট গ্যাস+ পেট্রোবাংলার প্রফিট গ্যাস) ২০%-এর বেশি হবে না। প্রতি মাসে পেট্রোবাংলা যে পরিমাণ গ্যাস স্থানীয় ব্যবহারের জন্য রাখতে চায় কন্ট্রাক্টরকে এলএনজি রফতানি চুক্তির আগে জানাতে হবে এবং প্রতি মাসে সংরক্ষিত চুক্তির পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। পেট্রোবাংলার অনুরোধে ১১তম বছরের শুরু থেকে উপরে বর্ণিত সংরক্ষিত গ্যাসের পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ ভাগ পর্যন্ত করা যাবে। আমাদের চাহিদা যাই হোক, কর্তৃপক্ষ ৮০ ভাগ গ্যাস প্রথম ১০ বছরের জন্য অনায়াসে রফতানি করার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে এবং নিতান্ত দয়াপরবশত যেন ১১তম বছরে এসে কমিয়ে সেটি ৭০ ভাগ করা হচ্ছে (যদি আদৌ ততদিনে গ্যাস উৎপাদন অব্যাহত থাকে)। আমাদের ভবিষ্যৎ জ্বালানি সংকট যতই প্রকট হোক_ আমাদের প্রাপ্য হবে কেবল ওই ২০ ভাগ, এক পর্যায়ে ৩০ ভাগ। আমরা মনে করি, চুক্তিটি এমনভাবে হওয়া উচিত ছিল যাতে নিজেদের গ্যাসের নূ্যনতম একটি অংশের ওপর বাংলাদেশের মালিকানা নিশ্চিত হয়। অনেকেই গ্যাস উৎপাদনভেদে পেট্রোবাংলা প্রাপ্ত গ্যাসের ৫৫%-৮০% পাবে হিসাব দিচ্ছেন, যা প্রকৃতপক্ষে প্রফিট গ্যাসের অংশ। কিন্তু এই হিসাবে রয়েছে বড় ধরনের অসামঞ্জস্যতা। উৎপাদিত গ্যাসের মোট ৫৫% গ্যাস হলো কস্ট রিকভারি গ্যাস, বাকি ৪৫% মুনাফা গ্যাস। যদি পেট্রোবাংলা প্রফিট গ্যাসের ৫৫% পায় তাহলে সেটি হয় মোট গ্যাসের ২৪.৭৫%। কিন্তু চুক্তির ১৫.৫.৪ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে পেট্রোবাংলার অংশ কখনোই মোট উৎপাদিত গ্যাসের ২০%-এর বেশি হবে না।
১০০% গ্যাস হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা :১৫.৫.৪ ধারায় বলা আছে, অভ্যন্তরীণ গ্যাস বণ্টনের জন্য এবং মেজারমেন্ট পয়েন্ট থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত পাইপলাইন বসানোর দায়িত্ব পেট্রোবাংলার। বর্তমানে সমুদ্রে ১০০ মাইলের একটি ৩০ ইঞ্চি পাইপলাইন তৈরিতে খরচ ২৭ কোটি ডলার। মাত্র শূন্য দশমিক ৫ বা এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলে সেটা মাটিতে আনতে প্রতি হাজার ঘনফুটে তিন ডলার খরচ পড়ে যাবে। রিজার্ভ আরও কম হলে খরচ বাড়বে। কাজেই ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়াতে পারে তা হলো হয়তো আমরা কনোকোফিলিপসের প্রস্তাবিত আশি ভাগ তো বটেই সেই সঙ্গে আমাদের কুড়ি ভাগ গ্যাসও দেশে আনতে পারব না (পেট্রোবাংলা ১৯৭৪ সালে আবিষ্কৃত নিকট সমুদ্রে অবস্থিত কুতুবদিয়া গ্যাসক্ষেত্রকে ২০০৯ পর্যন্ত সময়কালে উৎপাদনে এনে সে গ্যাস দেশে ব্যবহারের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করতে পারেনি) অথবা পাইপলাইন বসানোর পর দেখা যাবে তা অর্থনৈতিকভাবে এতটাই অলাভজনক যে নিজেদের ভাগের প্রফিট গ্যাস রফতানি করাই লাভজনক প্রমাণিত হবে বা প্রমাণের চেষ্টা হবে। ফলে পুরো ১০০ ভাগ গ্যাসই আমাদের হাতছাড়া হতে পারে।
মেজারমেন্ট পয়েন্ট : চুক্তিতে বলা হচ্ছে, মেজারমেন্ট পয়েন্ট (যেখানে জ্বালানি পরিমাপ করা হবে) পর্যন্ত গ্যাস কনোকোফিলিপসই পেঁৗছে দেবে, এর জন্য তারা যে পাইপলাইন বসাবে তা পেট্রোবাংলা ব্যবহার করতে পারবে, তবে পাইপলাইন বসানোর খরচ কস্ট রিকভারি হিসেবে পেট্রোবাংলার প্রাপ্য গ্যাসের অংশ থেকে কাটা হবে। মেজারমেন্ট পয়েন্ট কোথায় হবে তা পেট্রোবাংলা নির্ধারণ করবে। যদি বলা হতো যে, মেজারমেন্ট পয়েন্ট কোনোক্রমেই স্থলভাগ থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের বেশি হবে না তাহলে এই ধারাটি ব্যবহার করেই আমরা আমাদের প্রাপ্য গ্যাসের (সর্বোচ্চ ২০%) পুরোটা আদায় করতে সক্ষম হতাম।
গ্যাস উত্তোলনের সীমারেখা : ১৫.৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, ইজারাদার, ম্যানেজমেন্ট নীতি অনুসারে এক বছরে গ্যাসের প্রমাণিত মজুদের সাড়ে সাত ভাগ (৭.৫) উৎপন্ন করবে অর্থাৎ এই ধারার মাধ্যমে ইজারাদারের গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণের একটি সীমারেখা টানার চেষ্টা হয়েছে। যদি সীমিত পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হয় তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো। কারণ তাহলে আমাদের জ্বালানি বেশিদিন ব্যবহারের সুযোগ পাব, গ্যাসক্ষেত্রটি বেশিদিন জীবিত থাকবে। এই সীমারেখা না টানা হলে ইজারাদার কোম্পানি অতিদ্রুত তাদের মূলধন ও মুনাফা তুলে নিতে চেষ্টা করবে।
ক্ষতিপূরণের বিধান : চুক্তিতে দুর্ঘটনার জন্য সাধারণ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। অতীতে মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার অভিজ্ঞতার আলোকে কোম্পানির অদক্ষতার জন্য দুর্ঘটনা ঘটলে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হবে_ আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি বললেও মূল চুক্তিতে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
জ্বালানি নিরাপত্তা :এক হিসাব বলা হয়, দেশের বর্তমান গ্যাসের রিজার্ভ ৭-৮ টিসিএফ। এর সঙ্গে আরও ৫-৬ টিসিএফ যোগ হতে পারে বলে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে। কয়লাকে একই মানদণ্ডে যাচাই করা হলে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে বড়জোর ৪৫-৫০ টিসিএফ হতে পারে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিরিখে এই মজুদ যে অপ্রতুল, সেটাও প্রমাণিত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬% ধরলেও আগামী ৫০ বছর নাগাদ আমাদের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ১১০ টিসিএফের কাছাকাছি। ৭% হিসাব করলে এই চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে আনুমানিক ১৫০ টিসিএফ। মোট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে কমপক্ষে ৬০ থেকে ১০০ টিসিএফ পর্যন্ত। এ ঘাটতি পূরণে আমরা বঙ্গোপসাগরেরই মুখাপেক্ষী। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সমুদ্রবক্ষের অনাবিষ্কৃত সম্পদই একমাত্র রক্ষাকবচ।
পেট্রোবাংলার প্রাপ্য অংশ প্রফিট গ্যাসের, সর্বোচ্চ পরিমাণ ৭৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন পরিমাণ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এই চুক্তির মাধ্যমে মোট গ্যাসের সর্বনিম্ন ২২.৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩৩.৭৫ শতাংশ গ্যাস বাংলাদেশ পেতে পারে। যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ৫৫% গ্যাসের দ্বারা কস্ট রিকভারি কমপিল্গট না হয় তাহলে পেট্রোবাংলার গ্যাসের শেয়ার এরপর আরও কমবে। আর যদি আরও কম গ্যাসেই কস্ট রিকভারি হয়ে যায় তাহলে হয়তো শেয়ার বাড়বে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রাপ্য গ্যাস যদি রফতানি করে তাহলে বর্তমান বাজারমূল্য হিসেবে পাবে ১২ ডলার। এ রকম অবস্থায় তাদের লক্ষ্য থাকবে যেভাবে সম্ভব পেট্রোবাংলাকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি। চুক্তির ধারা ভঙ্গ করে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি পেট্রোবাংলা ইতিমধ্যেই কেয়ার্নকে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে একই যুক্তিতে কনোকোফিলিপসকেও দিতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কনোকোফিলিপস চুক্তি আমাদের শঙ্কিত করে। জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ ধরনের চুক্তি কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। আশা করব, দেশের কথা, মানুষের কথা ভেবে, যারা চুক্তি সমর্থন করেছেন, নিজেদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন।
লেখকবৃন্দ : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ছাত্র
কতটুকু গ্যাস পাবে বাংলাদেশ : সবচেয়ে উদ্বেগজনক অংশটি দিয়েই শুরু করি। চুক্তির ১৫.৫.৪ ধারাটিতে বলা হয়েছে, "যে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা স্থানীয় চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা (পাইপলাইন) স্থাপন করতে পারবে, সে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রফিট গ্যাস রাখার অধিকারপ্রাপ্ত হবে, তবে তা কোনোমতেই মোট মার্কেটেবল গ্যাসের (অর্থাৎ মোট উৎপাদিত গ্যাস=কস্ট রিকভারি গ্যাস+কনোকোফিলিপের প্রফিট গ্যাস+ পেট্রোবাংলার প্রফিট গ্যাস) ২০%-এর বেশি হবে না। প্রতি মাসে পেট্রোবাংলা যে পরিমাণ গ্যাস স্থানীয় ব্যবহারের জন্য রাখতে চায় কন্ট্রাক্টরকে এলএনজি রফতানি চুক্তির আগে জানাতে হবে এবং প্রতি মাসে সংরক্ষিত চুক্তির পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। পেট্রোবাংলার অনুরোধে ১১তম বছরের শুরু থেকে উপরে বর্ণিত সংরক্ষিত গ্যাসের পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ ভাগ পর্যন্ত করা যাবে। আমাদের চাহিদা যাই হোক, কর্তৃপক্ষ ৮০ ভাগ গ্যাস প্রথম ১০ বছরের জন্য অনায়াসে রফতানি করার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে এবং নিতান্ত দয়াপরবশত যেন ১১তম বছরে এসে কমিয়ে সেটি ৭০ ভাগ করা হচ্ছে (যদি আদৌ ততদিনে গ্যাস উৎপাদন অব্যাহত থাকে)। আমাদের ভবিষ্যৎ জ্বালানি সংকট যতই প্রকট হোক_ আমাদের প্রাপ্য হবে কেবল ওই ২০ ভাগ, এক পর্যায়ে ৩০ ভাগ। আমরা মনে করি, চুক্তিটি এমনভাবে হওয়া উচিত ছিল যাতে নিজেদের গ্যাসের নূ্যনতম একটি অংশের ওপর বাংলাদেশের মালিকানা নিশ্চিত হয়। অনেকেই গ্যাস উৎপাদনভেদে পেট্রোবাংলা প্রাপ্ত গ্যাসের ৫৫%-৮০% পাবে হিসাব দিচ্ছেন, যা প্রকৃতপক্ষে প্রফিট গ্যাসের অংশ। কিন্তু এই হিসাবে রয়েছে বড় ধরনের অসামঞ্জস্যতা। উৎপাদিত গ্যাসের মোট ৫৫% গ্যাস হলো কস্ট রিকভারি গ্যাস, বাকি ৪৫% মুনাফা গ্যাস। যদি পেট্রোবাংলা প্রফিট গ্যাসের ৫৫% পায় তাহলে সেটি হয় মোট গ্যাসের ২৪.৭৫%। কিন্তু চুক্তির ১৫.৫.৪ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে পেট্রোবাংলার অংশ কখনোই মোট উৎপাদিত গ্যাসের ২০%-এর বেশি হবে না।
১০০% গ্যাস হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা :১৫.৫.৪ ধারায় বলা আছে, অভ্যন্তরীণ গ্যাস বণ্টনের জন্য এবং মেজারমেন্ট পয়েন্ট থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত পাইপলাইন বসানোর দায়িত্ব পেট্রোবাংলার। বর্তমানে সমুদ্রে ১০০ মাইলের একটি ৩০ ইঞ্চি পাইপলাইন তৈরিতে খরচ ২৭ কোটি ডলার। মাত্র শূন্য দশমিক ৫ বা এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলে সেটা মাটিতে আনতে প্রতি হাজার ঘনফুটে তিন ডলার খরচ পড়ে যাবে। রিজার্ভ আরও কম হলে খরচ বাড়বে। কাজেই ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়াতে পারে তা হলো হয়তো আমরা কনোকোফিলিপসের প্রস্তাবিত আশি ভাগ তো বটেই সেই সঙ্গে আমাদের কুড়ি ভাগ গ্যাসও দেশে আনতে পারব না (পেট্রোবাংলা ১৯৭৪ সালে আবিষ্কৃত নিকট সমুদ্রে অবস্থিত কুতুবদিয়া গ্যাসক্ষেত্রকে ২০০৯ পর্যন্ত সময়কালে উৎপাদনে এনে সে গ্যাস দেশে ব্যবহারের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করতে পারেনি) অথবা পাইপলাইন বসানোর পর দেখা যাবে তা অর্থনৈতিকভাবে এতটাই অলাভজনক যে নিজেদের ভাগের প্রফিট গ্যাস রফতানি করাই লাভজনক প্রমাণিত হবে বা প্রমাণের চেষ্টা হবে। ফলে পুরো ১০০ ভাগ গ্যাসই আমাদের হাতছাড়া হতে পারে।
মেজারমেন্ট পয়েন্ট : চুক্তিতে বলা হচ্ছে, মেজারমেন্ট পয়েন্ট (যেখানে জ্বালানি পরিমাপ করা হবে) পর্যন্ত গ্যাস কনোকোফিলিপসই পেঁৗছে দেবে, এর জন্য তারা যে পাইপলাইন বসাবে তা পেট্রোবাংলা ব্যবহার করতে পারবে, তবে পাইপলাইন বসানোর খরচ কস্ট রিকভারি হিসেবে পেট্রোবাংলার প্রাপ্য গ্যাসের অংশ থেকে কাটা হবে। মেজারমেন্ট পয়েন্ট কোথায় হবে তা পেট্রোবাংলা নির্ধারণ করবে। যদি বলা হতো যে, মেজারমেন্ট পয়েন্ট কোনোক্রমেই স্থলভাগ থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের বেশি হবে না তাহলে এই ধারাটি ব্যবহার করেই আমরা আমাদের প্রাপ্য গ্যাসের (সর্বোচ্চ ২০%) পুরোটা আদায় করতে সক্ষম হতাম।
গ্যাস উত্তোলনের সীমারেখা : ১৫.৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, ইজারাদার, ম্যানেজমেন্ট নীতি অনুসারে এক বছরে গ্যাসের প্রমাণিত মজুদের সাড়ে সাত ভাগ (৭.৫) উৎপন্ন করবে অর্থাৎ এই ধারার মাধ্যমে ইজারাদারের গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণের একটি সীমারেখা টানার চেষ্টা হয়েছে। যদি সীমিত পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হয় তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো। কারণ তাহলে আমাদের জ্বালানি বেশিদিন ব্যবহারের সুযোগ পাব, গ্যাসক্ষেত্রটি বেশিদিন জীবিত থাকবে। এই সীমারেখা না টানা হলে ইজারাদার কোম্পানি অতিদ্রুত তাদের মূলধন ও মুনাফা তুলে নিতে চেষ্টা করবে।
ক্ষতিপূরণের বিধান : চুক্তিতে দুর্ঘটনার জন্য সাধারণ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। অতীতে মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার অভিজ্ঞতার আলোকে কোম্পানির অদক্ষতার জন্য দুর্ঘটনা ঘটলে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হবে_ আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি বললেও মূল চুক্তিতে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
জ্বালানি নিরাপত্তা :এক হিসাব বলা হয়, দেশের বর্তমান গ্যাসের রিজার্ভ ৭-৮ টিসিএফ। এর সঙ্গে আরও ৫-৬ টিসিএফ যোগ হতে পারে বলে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে। কয়লাকে একই মানদণ্ডে যাচাই করা হলে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে বড়জোর ৪৫-৫০ টিসিএফ হতে পারে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিরিখে এই মজুদ যে অপ্রতুল, সেটাও প্রমাণিত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬% ধরলেও আগামী ৫০ বছর নাগাদ আমাদের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ১১০ টিসিএফের কাছাকাছি। ৭% হিসাব করলে এই চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে আনুমানিক ১৫০ টিসিএফ। মোট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে কমপক্ষে ৬০ থেকে ১০০ টিসিএফ পর্যন্ত। এ ঘাটতি পূরণে আমরা বঙ্গোপসাগরেরই মুখাপেক্ষী। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সমুদ্রবক্ষের অনাবিষ্কৃত সম্পদই একমাত্র রক্ষাকবচ।
পেট্রোবাংলার প্রাপ্য অংশ প্রফিট গ্যাসের, সর্বোচ্চ পরিমাণ ৭৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন পরিমাণ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এই চুক্তির মাধ্যমে মোট গ্যাসের সর্বনিম্ন ২২.৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩৩.৭৫ শতাংশ গ্যাস বাংলাদেশ পেতে পারে। যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ৫৫% গ্যাসের দ্বারা কস্ট রিকভারি কমপিল্গট না হয় তাহলে পেট্রোবাংলার গ্যাসের শেয়ার এরপর আরও কমবে। আর যদি আরও কম গ্যাসেই কস্ট রিকভারি হয়ে যায় তাহলে হয়তো শেয়ার বাড়বে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রাপ্য গ্যাস যদি রফতানি করে তাহলে বর্তমান বাজারমূল্য হিসেবে পাবে ১২ ডলার। এ রকম অবস্থায় তাদের লক্ষ্য থাকবে যেভাবে সম্ভব পেট্রোবাংলাকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি। চুক্তির ধারা ভঙ্গ করে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি পেট্রোবাংলা ইতিমধ্যেই কেয়ার্নকে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে একই যুক্তিতে কনোকোফিলিপসকেও দিতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কনোকোফিলিপস চুক্তি আমাদের শঙ্কিত করে। জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ ধরনের চুক্তি কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। আশা করব, দেশের কথা, মানুষের কথা ভেবে, যারা চুক্তি সমর্থন করেছেন, নিজেদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন।
লেখকবৃন্দ : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ছাত্র
No comments