নৃশংসতা-পুলিশ-প্রযোজিত রিয়েল হরর মুভি by মশিউল আলম
ঘটনার নায়ক পুলিশের গাড়ি থেকে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে নামিয়ে দেওয়া হলো জনতার মধ্যে। জনতা পেটাতে শুরু করল বেচারি কিশোরকে। একলা কিশোর, অসহায় কিশোর। তার হালকা-পাতলা এত্তটুকুন শরীরের ওপর চলতে থাকল এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি-লাথি।
এ ছবি নির্বাক নয়; চিৎকার চলছে: ‘মাইরা হালা! মাইরা হালা! পুলিশ কইছে মারি হালাইবার লাই! তোরা মারছ না ক্যা?’
মানে, পুলিশ বলেছে মেরে ফেলতে, তোরা মারছিস না কেন?
কিন্তু মারছে না কে বলেছে? এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি-লাথির সঙ্গে পড়ছে লাঠিরও আঘাত। একা একটি কিশোরের ওপর এতগুলো মানুষের এমন উন্মত্ত নৃশংসতার দৃশ্য চোখের সামনেই প্রত্যক্ষ করছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। কতক্ষণ চলবে এই হরর মুভি, যার প্রযোজক খোদ পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য, উপভোগও করতে চান তাঁরাই? তাঁদের উপভোগটা দীর্ঘ হলেই মজা। কিন্তু কতক্ষণ আর চলতে পারে এমন বিধ্বংসী গণপ্রহার? বেশিক্ষণ কি সম্ভব? কিশোরের পলকা শরীরটা কি পাথরে গড়া যে তা থেঁতলে যাবে না, পিষ্ট হবে না, ভাঙবে না, মচকাবে না? মাথাটা কি তার ইস্পাতের তৈরি যে ইটের আঘাতেও অক্ষত থেকে যাবে? না, এক যুবকের ইটের আঘাতে থেঁতলে গেল কিশোরের মাথা। তার পরও সে যুবক থামল না; উপর্যুপরি আঘাত করেই চলল।
পুলিশ বলেছে মেরে ফেলতে। জনতা সে আজ্ঞা পালন করল। মরে গেল ১৬ বছরের কিশোর। মৃত্যু নিশ্চিত হলে তার দেহটি আবার জায়গা পেল পুলিশের গাড়িতে, এবার প্রাণহীন। আইন এখন লাশের সুরক্ষা দেবে। দেবে তো?
এই রিয়েল হরর মুভিটি আপনারা ইচ্ছে করলেই ইন্টারনেটে দেখতে পারেন। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও তার আশপাশের এলাকায় লোকজন মোবাইল ফোনেও এ ছবি দেখছে।
কিশোরের নাম মিলন। আরেক লিমন! না, এই কিশোরের ভাগ্য আরও খারাপ। লিমন র্যাবের হাতে এক পা হারিয়ে তবু বেঁচে আছে। এই মিলন বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। তার আগে হারিয়েছে ১৪ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোনসেট। ওই টাকা নিয়ে সে যাচ্ছিল উপজেলা সদরের দিকে, জমি নিবন্ধন করার জন্য। তার বাবা চাচাতো ভাইয়ের কাছে ঘরবাড়ি বিক্রি করে জীবিকার সন্ধানে গিয়েছেন সৌদি আরব। চাচাতো ভাই দয়া করে মিলনদের পরিবারকে (মা ও চার ভাই; মিলন সবার বড়) ওই বাড়িতেই আরও কিছুদিন থাকতে দিয়েছেন। কথা হয়েছে, মিলনের বাবা সৌদি আরব থেকে টাকা পাঠাবেন, সেই টাকায় জমি কিনে ঘর বানানোর পর মিলনেরা সেই বিক্রি করা বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠবে। মিলনের বাবা সৌদি আরবে আড়াই বছর কাজ করে টাকা জমিয়ে কয়েক মাস আগে পাঠাতে পেরেছেন এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। মিলনেরা সে টাকায় একই গ্রামে এক খণ্ড জমি কিনেছে। সেই জমির নিবন্ধন করার উদ্দেশ্যেই ১৪ হাজার টাকা নিয়ে সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল মিলন। প্রথমে তার যাওয়ার কথা ছিল নানার কাছে, তারপর নানাকে সঙ্গে নিয়ে উপজেলা সদরে। মাঝপথে সে দেখা করতে যায় দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোনের সঙ্গে। সেই গ্রামে গিয়ে সে একটি পুকুরঘাটে বসে অপেক্ষা করছিল। অপরিচিত দেখে গ্রামের একজন তার পরিচয় ও সেখানে বসে থাকার কারণ জানতে চায়। তারপর সেখানে আসেন স্থানীয় ইউপি সদস্য, একই ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করেন তিনিও। একপর্যায়ে মিলনের সেই দূর সম্পর্কের খালাতো বোনটিকে বিদ্যালয় থেকে সেখানে ডেকে আনা হয় ছেলেটির পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য। মেয়েটি জানায়, সে মিলনকে চেনে, সে তার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই। কিন্তু গ্রামের লোকজন তাতে আশ্বস্ত হতে পারে না; তাদের সন্দেহ হয় মিলন ডাকাত দলের সদস্য, তারা তাকে চড়-থাপড় মারে, ১৪ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোনসেট কেড়ে নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
তারপর পুলিশ মিলনকে নিয়ে যে বিভীষিকাময় দৃশ্যের আয়োজন করে, তার কিছু বিবরণ এ লেখার শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি সাংবাদিকদের বলেছেন, লোকজন মিলনকে ডাকাত সন্দেহ করেই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। কিন্তু তিনি বললেন না, সেই পিটিয়ে মারার আয়োজনটা করেছেন তাঁরই সহকর্মীরা, রাষ্ট্র যাদের ওপর জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে। ঘটনার পর নোয়াখালী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে করা প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে, মিলনকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় পুলিশের সহায়তা ছিল। এটা পুলিশের ভাষ্য। এই ভাষ্য সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করে না। সম্পূর্ণ সত্যটা হলো, পুলিশ মিলনকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত জনতার হাতে তুলে দিয়েছে। আর ভিডিও চিত্রে একটি কণ্ঠের কথা ‘পুলিশ কইছে মারি হালাইবার লাই’ যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হয়, পুলিশের নির্দেশেই উন্মত্ত জনতা কিশোর মিলনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, পুলিশের সদস্যরা তাঁদের নির্দেশ পালনের দৃশ্যটি চোখের সম্মুখে প্রত্যক্ষ করেছেন।
পুলিশি বিভীষিকার এ এক অভিনব, অকল্পনীয় রূপ। এত দিন আমরা দেখেছি, ভুলবশত বা সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়ে অপরাধী সন্দেহ করে বা সম্পূর্ণ নিরপরাধ জেনেও লোকজনকে নির্যাতন করে, গুলি করে, পেটায়, চাপাতির কোপ মারে পুলিশের সদস্যরা নিজেরাই। এবার দেখা গেল, মানুষ মারার জন্য পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে জনতাকে। অভিনব কৌশলই বলতে হয়। পুলিশ তো নিজে মারেনি, মেরেছে জনতা। পুলিশকে দোষ দিতে হলে সর্বোচ্চ এই দোষ দেওয়া যায়, তারা কর্তব্যে অবহেলা করেছে। জনতা একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে আর পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখেছে। মানে নিষ্ক্রিয় থেকেছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, বা কর্তব্যে অবহেলা এই দেশে নতুন কী? কত বড়ই বা দোষ? তাই কর্তব্যে অবহেলার দায়ে পুলিশের তিন সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসিকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু আসলে তো পুলিশের ভূমিকা এখানে হত্যাকারীর। নিজেদের হাতে বা লাঠি-বন্দুক দিয়ে তারা মিলনকে মারেনি বটে, কিন্তু মেরেছে জনতাকে দিয়ে। জনতা এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে পুলিশের প্রাণঘাতী অস্ত্রের মতো। এ বিভীষিকাময় ঘটনার প্রকৃত নায়ক পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমনে তাদের ব্যর্থতার কারণে নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জের ওই এলাকায় ডাকাতের উপদ্রব এতই বেড়েছে যে লোকজন অপরিচিত কাউকে দেখলেই সন্দেহ করে। আর এই গণসন্দেহ যে ভয়াবহ বাতিকের পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার একটা উদাহরণ মিলনের গণপিটুনি ও হত্যার ঘটনা।
কয়েক মাস আগে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকারের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, পুলিশ বাহিনীকে তিনি দেখতে চান জনগণের বন্ধু হিসেবে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে পুলিশ বাহিনীকে দেখা হয় ‘পুলিশ ফোর্স’ হিসেবে; আসলে আমাদের প্রয়োজন ‘পুলিশ সার্ভিস’, অর্থাৎ পুলিশ বিভাগ হবে একটি সেবা সংস্থা, তারা জনগণকে সেবা দেবে। কিন্তু কী দুঃখের বিষয়, জনগণকে সেবা দেওয়ার পরিবর্তে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হাতে এমন সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যা সভ্য দুনিয়ার মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। ডাকাত সন্দেহে একটি ছেলেকে ধরে জনতার মধ্যে ছেড়ে দিয়ে কোন দেশের পুলিশ বলবে, ওটা ডাকাত, মেরে ফ্যালো?
নাগরিক যখন সাংবাদিক
মিলনের নৃশংস হত্যার ঘটনাটি ঘটে ২৭ জুলাই সকালে। কিন্তু জাতীয় সংবাদমাধ্যমে সেটি প্রকাশ পেল ৭ আগস্ট—১০ দিন পরে। এই অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণ কী? আসলে, ২৬ জুলাই দিবাগত রাতে ও ভোরের দিকে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চরকাঁকড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতের গুলিতে একজন আর ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মিলনের ঘটনাটি ঘটে ২৭ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। এই সবগুলো মৃত্যুর খবর পরদিন ২৮ জুলাই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহতদের মধ্যে স্থান পেয়ে যায় নিরীহ কিশোর মিলন। কিন্তু কে জানত, তার হত্যাদৃশ্যটির চলমান চিত্র রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল কোনো ব্যক্তির মোবাইল ফোনে। সেই ব্যক্তি ভিডিও ফুটেজটি দেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল সময় টেলিভিশনকে। সময় টেলিভিশনে ফুটেজটি প্রদর্শিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি হলো।
এর আগ পর্যন্ত আমাদের সংবাদকর্মীদের মধ্যে মিলন হত্যার এই ঘটনা নিয়ে কোনো সন্দেহই জাগেনি। ওই অঞ্চলের স্থানীয় সংবাদকর্মীরা দেশবাসীকে তাই জানিয়েছেন, যা পুলিশের সূত্রে জানতে পেরেছিলেন। মিলনের মা ৪ আগস্ট থানায় মামলা করেন এই অভিযোগে যে তাঁর নিরীহ নিরপরাধ ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কারোর কিছু যায় আসেনি। কেউ অনুসন্ধান চালাতে যাননি। প্রতিনিয়ত যত ধরনের খুন-রাহাজানির ঘটনা ঘটছে, সবকিছুর পেছনে অনুসন্ধান চালানো লোকবল-সাপেক্ষ ব্যাপারও বটে। এ ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যে বিরাট এক সহায়ক শক্তি হিসেবে মূলধারার সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়াতে পারে, সময় টেলিভিশনের মাধ্যমে তার প্রমাণ মিলল। টিভি চ্যানেলটি ‘এখন আপনিও হতে পারেন সাংবাদিক’ বলে দর্শকদের আহ্বান জানাচ্ছে সংবাদমূল্যবাহী ভিডিও ফুটেজ পাঠাতে। মিলনের হত্যাদৃশ্যের ভিডিও ফুটেজটি এভাবেই হয়ে উঠল নাগরিক সাংবাদিকতার একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। অন্যান্য টিভি চ্যানেল, এমনকি সংবাদপত্রগুলোরও উচিত নাগরিকদের কাছ থেকে প্রামাণ্য তথ্য, বিশেষত ভিডিও ফুটেজ আহ্বান করা। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের যেসব খবর ও ভিডিও চিত্র আমরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পাচ্ছি, সেগুলোর অধিকাংশই সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ও ভিডিও ক্যামেরায় তোলা। এখন বাংলাদেশেও নাগরিক সাংবাদিকতার সময় এসেছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।মানে, পুলিশ বলেছে মেরে ফেলতে, তোরা মারছিস না কেন?
কিন্তু মারছে না কে বলেছে? এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি-লাথির সঙ্গে পড়ছে লাঠিরও আঘাত। একা একটি কিশোরের ওপর এতগুলো মানুষের এমন উন্মত্ত নৃশংসতার দৃশ্য চোখের সামনেই প্রত্যক্ষ করছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। কতক্ষণ চলবে এই হরর মুভি, যার প্রযোজক খোদ পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য, উপভোগও করতে চান তাঁরাই? তাঁদের উপভোগটা দীর্ঘ হলেই মজা। কিন্তু কতক্ষণ আর চলতে পারে এমন বিধ্বংসী গণপ্রহার? বেশিক্ষণ কি সম্ভব? কিশোরের পলকা শরীরটা কি পাথরে গড়া যে তা থেঁতলে যাবে না, পিষ্ট হবে না, ভাঙবে না, মচকাবে না? মাথাটা কি তার ইস্পাতের তৈরি যে ইটের আঘাতেও অক্ষত থেকে যাবে? না, এক যুবকের ইটের আঘাতে থেঁতলে গেল কিশোরের মাথা। তার পরও সে যুবক থামল না; উপর্যুপরি আঘাত করেই চলল।
পুলিশ বলেছে মেরে ফেলতে। জনতা সে আজ্ঞা পালন করল। মরে গেল ১৬ বছরের কিশোর। মৃত্যু নিশ্চিত হলে তার দেহটি আবার জায়গা পেল পুলিশের গাড়িতে, এবার প্রাণহীন। আইন এখন লাশের সুরক্ষা দেবে। দেবে তো?
এই রিয়েল হরর মুভিটি আপনারা ইচ্ছে করলেই ইন্টারনেটে দেখতে পারেন। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও তার আশপাশের এলাকায় লোকজন মোবাইল ফোনেও এ ছবি দেখছে।
কিশোরের নাম মিলন। আরেক লিমন! না, এই কিশোরের ভাগ্য আরও খারাপ। লিমন র্যাবের হাতে এক পা হারিয়ে তবু বেঁচে আছে। এই মিলন বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। তার আগে হারিয়েছে ১৪ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোনসেট। ওই টাকা নিয়ে সে যাচ্ছিল উপজেলা সদরের দিকে, জমি নিবন্ধন করার জন্য। তার বাবা চাচাতো ভাইয়ের কাছে ঘরবাড়ি বিক্রি করে জীবিকার সন্ধানে গিয়েছেন সৌদি আরব। চাচাতো ভাই দয়া করে মিলনদের পরিবারকে (মা ও চার ভাই; মিলন সবার বড়) ওই বাড়িতেই আরও কিছুদিন থাকতে দিয়েছেন। কথা হয়েছে, মিলনের বাবা সৌদি আরব থেকে টাকা পাঠাবেন, সেই টাকায় জমি কিনে ঘর বানানোর পর মিলনেরা সেই বিক্রি করা বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠবে। মিলনের বাবা সৌদি আরবে আড়াই বছর কাজ করে টাকা জমিয়ে কয়েক মাস আগে পাঠাতে পেরেছেন এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। মিলনেরা সে টাকায় একই গ্রামে এক খণ্ড জমি কিনেছে। সেই জমির নিবন্ধন করার উদ্দেশ্যেই ১৪ হাজার টাকা নিয়ে সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল মিলন। প্রথমে তার যাওয়ার কথা ছিল নানার কাছে, তারপর নানাকে সঙ্গে নিয়ে উপজেলা সদরে। মাঝপথে সে দেখা করতে যায় দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোনের সঙ্গে। সেই গ্রামে গিয়ে সে একটি পুকুরঘাটে বসে অপেক্ষা করছিল। অপরিচিত দেখে গ্রামের একজন তার পরিচয় ও সেখানে বসে থাকার কারণ জানতে চায়। তারপর সেখানে আসেন স্থানীয় ইউপি সদস্য, একই ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করেন তিনিও। একপর্যায়ে মিলনের সেই দূর সম্পর্কের খালাতো বোনটিকে বিদ্যালয় থেকে সেখানে ডেকে আনা হয় ছেলেটির পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য। মেয়েটি জানায়, সে মিলনকে চেনে, সে তার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই। কিন্তু গ্রামের লোকজন তাতে আশ্বস্ত হতে পারে না; তাদের সন্দেহ হয় মিলন ডাকাত দলের সদস্য, তারা তাকে চড়-থাপড় মারে, ১৪ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোনসেট কেড়ে নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
তারপর পুলিশ মিলনকে নিয়ে যে বিভীষিকাময় দৃশ্যের আয়োজন করে, তার কিছু বিবরণ এ লেখার শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি সাংবাদিকদের বলেছেন, লোকজন মিলনকে ডাকাত সন্দেহ করেই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। কিন্তু তিনি বললেন না, সেই পিটিয়ে মারার আয়োজনটা করেছেন তাঁরই সহকর্মীরা, রাষ্ট্র যাদের ওপর জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে। ঘটনার পর নোয়াখালী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে করা প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে, মিলনকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় পুলিশের সহায়তা ছিল। এটা পুলিশের ভাষ্য। এই ভাষ্য সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করে না। সম্পূর্ণ সত্যটা হলো, পুলিশ মিলনকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত জনতার হাতে তুলে দিয়েছে। আর ভিডিও চিত্রে একটি কণ্ঠের কথা ‘পুলিশ কইছে মারি হালাইবার লাই’ যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হয়, পুলিশের নির্দেশেই উন্মত্ত জনতা কিশোর মিলনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, পুলিশের সদস্যরা তাঁদের নির্দেশ পালনের দৃশ্যটি চোখের সম্মুখে প্রত্যক্ষ করেছেন।
পুলিশি বিভীষিকার এ এক অভিনব, অকল্পনীয় রূপ। এত দিন আমরা দেখেছি, ভুলবশত বা সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়ে অপরাধী সন্দেহ করে বা সম্পূর্ণ নিরপরাধ জেনেও লোকজনকে নির্যাতন করে, গুলি করে, পেটায়, চাপাতির কোপ মারে পুলিশের সদস্যরা নিজেরাই। এবার দেখা গেল, মানুষ মারার জন্য পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে জনতাকে। অভিনব কৌশলই বলতে হয়। পুলিশ তো নিজে মারেনি, মেরেছে জনতা। পুলিশকে দোষ দিতে হলে সর্বোচ্চ এই দোষ দেওয়া যায়, তারা কর্তব্যে অবহেলা করেছে। জনতা একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে আর পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখেছে। মানে নিষ্ক্রিয় থেকেছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, বা কর্তব্যে অবহেলা এই দেশে নতুন কী? কত বড়ই বা দোষ? তাই কর্তব্যে অবহেলার দায়ে পুলিশের তিন সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসিকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু আসলে তো পুলিশের ভূমিকা এখানে হত্যাকারীর। নিজেদের হাতে বা লাঠি-বন্দুক দিয়ে তারা মিলনকে মারেনি বটে, কিন্তু মেরেছে জনতাকে দিয়ে। জনতা এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে পুলিশের প্রাণঘাতী অস্ত্রের মতো। এ বিভীষিকাময় ঘটনার প্রকৃত নায়ক পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমনে তাদের ব্যর্থতার কারণে নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জের ওই এলাকায় ডাকাতের উপদ্রব এতই বেড়েছে যে লোকজন অপরিচিত কাউকে দেখলেই সন্দেহ করে। আর এই গণসন্দেহ যে ভয়াবহ বাতিকের পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার একটা উদাহরণ মিলনের গণপিটুনি ও হত্যার ঘটনা।
কয়েক মাস আগে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকারের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, পুলিশ বাহিনীকে তিনি দেখতে চান জনগণের বন্ধু হিসেবে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে পুলিশ বাহিনীকে দেখা হয় ‘পুলিশ ফোর্স’ হিসেবে; আসলে আমাদের প্রয়োজন ‘পুলিশ সার্ভিস’, অর্থাৎ পুলিশ বিভাগ হবে একটি সেবা সংস্থা, তারা জনগণকে সেবা দেবে। কিন্তু কী দুঃখের বিষয়, জনগণকে সেবা দেওয়ার পরিবর্তে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হাতে এমন সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যা সভ্য দুনিয়ার মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। ডাকাত সন্দেহে একটি ছেলেকে ধরে জনতার মধ্যে ছেড়ে দিয়ে কোন দেশের পুলিশ বলবে, ওটা ডাকাত, মেরে ফ্যালো?
নাগরিক যখন সাংবাদিক
মিলনের নৃশংস হত্যার ঘটনাটি ঘটে ২৭ জুলাই সকালে। কিন্তু জাতীয় সংবাদমাধ্যমে সেটি প্রকাশ পেল ৭ আগস্ট—১০ দিন পরে। এই অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণ কী? আসলে, ২৬ জুলাই দিবাগত রাতে ও ভোরের দিকে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চরকাঁকড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতের গুলিতে একজন আর ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মিলনের ঘটনাটি ঘটে ২৭ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। এই সবগুলো মৃত্যুর খবর পরদিন ২৮ জুলাই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহতদের মধ্যে স্থান পেয়ে যায় নিরীহ কিশোর মিলন। কিন্তু কে জানত, তার হত্যাদৃশ্যটির চলমান চিত্র রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল কোনো ব্যক্তির মোবাইল ফোনে। সেই ব্যক্তি ভিডিও ফুটেজটি দেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল সময় টেলিভিশনকে। সময় টেলিভিশনে ফুটেজটি প্রদর্শিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি হলো।
এর আগ পর্যন্ত আমাদের সংবাদকর্মীদের মধ্যে মিলন হত্যার এই ঘটনা নিয়ে কোনো সন্দেহই জাগেনি। ওই অঞ্চলের স্থানীয় সংবাদকর্মীরা দেশবাসীকে তাই জানিয়েছেন, যা পুলিশের সূত্রে জানতে পেরেছিলেন। মিলনের মা ৪ আগস্ট থানায় মামলা করেন এই অভিযোগে যে তাঁর নিরীহ নিরপরাধ ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কারোর কিছু যায় আসেনি। কেউ অনুসন্ধান চালাতে যাননি। প্রতিনিয়ত যত ধরনের খুন-রাহাজানির ঘটনা ঘটছে, সবকিছুর পেছনে অনুসন্ধান চালানো লোকবল-সাপেক্ষ ব্যাপারও বটে। এ ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যে বিরাট এক সহায়ক শক্তি হিসেবে মূলধারার সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়াতে পারে, সময় টেলিভিশনের মাধ্যমে তার প্রমাণ মিলল। টিভি চ্যানেলটি ‘এখন আপনিও হতে পারেন সাংবাদিক’ বলে দর্শকদের আহ্বান জানাচ্ছে সংবাদমূল্যবাহী ভিডিও ফুটেজ পাঠাতে। মিলনের হত্যাদৃশ্যের ভিডিও ফুটেজটি এভাবেই হয়ে উঠল নাগরিক সাংবাদিকতার একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। অন্যান্য টিভি চ্যানেল, এমনকি সংবাদপত্রগুলোরও উচিত নাগরিকদের কাছ থেকে প্রামাণ্য তথ্য, বিশেষত ভিডিও ফুটেজ আহ্বান করা। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের যেসব খবর ও ভিডিও চিত্র আমরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পাচ্ছি, সেগুলোর অধিকাংশই সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ও ভিডিও ক্যামেরায় তোলা। এখন বাংলাদেশেও নাগরিক সাংবাদিকতার সময় এসেছে।
mashiul.alam@gmail.com
No comments