বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা? by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১' অনুমোদনের পর থেকে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। এ নীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বানে একদিনের হরতাল পালিত হয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেক হিসাব-নিকাশ কষতে হয়।


এর মধ্যে ভোটের রাজনীতি মুখ্য। কেননা আমাদের দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। অতএব এমন কথা বলা যাবে না, যাতে নারীরা উল্টো অবস্থান না নেন। তাই বিএনপিকে দেখা যায়, আমিনী সাহেবের হরতালে নৈতিক সমর্থন দিতে। কারণ পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে মাঠে থাকলে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের এ যুগে সরকারের যেকোনো নীতি ও আইন এখন সহজেই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, যেটি আগে সম্ভব ছিল না। সরকার যখন জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ অনুমোদন করে ওয়েবসাইটে দেয়, তখন বিএনপির একটি জনসভা থেকে দাবি করা হয়েছিল_সরকার কেন তাদের নারীনীতি সম্পর্কে অবহিত করছে না। প্রশ্ন হলো, এটি তো জানানোর বিষয় নয়; ইচ্ছা করলেই যেকোনো কেউ জেনে নিতে পারেন। নারীনীতির কোন কোন ধারা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা সহজেই আপনারা জনগণকে অবহিত করতে পারেন এবং বৃহত্তর আন্দোলন কিংবা আমিনীদের সঙ্গে আন্দোলনে শরিক হতে পারেন। আপনাদের কি উচিত নয়, নারীনীতিটি ভালোভাবে পড়ে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা? আমরা আশা করব, আপনারা তা-ই করবেন, নইলে আমাদের ধারণা হবে আপনারা রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য মানুষের মধ্যে ধূম্রজাল সৃষ্টির পথ খুঁজছেন। অনুমোদিত নারীনীতির অনেক ধারার মধ্যে দুটি ধারায় আমিনী সাহেবসহ অন্যান্য ইসলামী দলের ঘোর আপত্তি। ধারা দুটি হলো ২৩.৫ এবং ২৫.২। যেখানে যথাক্রমে বলা হয়েছে সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেওয়া এবং উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান। অন্যান্য ধারার ক্ষেত্রেও তাদের আপত্তি রয়েছে, তবে এ দুটি ধারার ক্ষেত্রে আপত্তি বেশি। তাদের বক্তব্য, এ দুটি ধারা ইসলামের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। যেকোনো আইন কিংবা ধারার ব্যাখ্যা একেকজন একেক রকম দেবে, এটাই স্বাভাবিক_যখন ধারার ব্যাখ্যা থাকে না। ধারা ২৫.২-এ ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিকতার কোনো সুযোগ নেই, কেননা এখানে উত্তরাধিকারের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদানের কথা বলা হয়েছে। বরং এ ধারার মাধ্যমে নারীর উত্তরাধিকার সম্পদের ওপর জোর দিয়ে তা আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আমাদের সমাজে এখনো অনেক পরিবারে ভাইয়েরা তাদের বোনদের সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয় না এবং কখনো কখনো বোনেরা ইচ্ছা করে সম্পত্তি গ্রহণ করে না। নারীনীতির এ ধারাটি ইসলামে নারীর উত্তরাধিকার সম্পদ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ধারা ২৩.৫-এ যে কথা বলা হয়েছে, সেখানেও ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু দেখি না। এখানে নারীকে সম্পদের সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্বের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু সেটি যে উত্তরাধিকার সম্পদ তা বলা হয়নি। নারীর নিজস্ব সম্পদ থাকতে পারে, স্বামীর দেওয়া সম্পদের মালিক হতে পারে কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে সম্পদের মালিক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তার সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্বের দাবি অযৌক্তিক নয়, এ ধারাও পরিষ্কার।
গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা এবং তথ্যপ্রবাহের অবাধ প্রেক্ষাপটে আমরা সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্তির মধ্যে রাখতে পারি না। অনুমোদিত নারীনীতিতে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারকে সব কিছু পরিষ্কার করতে হবে। যে দুটি ধারা নিয়ে আমিনীদের আপত্তি, সে সম্পর্কে সরকারকে পরিষ্কার ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে। যেমন_ধারা ২৩.৫-এ সম্পদ বলতে 'উত্তরাধিকার সম্পদ' নয়, এ ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে আসতে হবে। কেননা সরকার বারবার বলে আসছে, তারা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করেনি। পাশাপাশি একটি কথা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র নয়, এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। আমরা চাই এর দ্রুত বাস্তবায়ন এবং সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নারীনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ধারণা দেওয়া। যাঁরা এর বিরোধিতা করছেন তাঁদের প্রতি অনুরোধ, নারীনীতিটি প্রথমে ভালোভাবে পড়ুন, অতঃপর এর বিশ্লেষণধর্মী সমালোচনা করুন। অযথা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকুন।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neayahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.