স্মরণ-মনে পড়ে বন্ধুকে by জাহানারা হক

চলে গেল আমাদের এক বন্ধু নূরজাহান আলম অজানা গন্তব্যে, জীবনের অমোঘ নিয়মে। গত ১০ জুলাই প্রায় দুই বছর অগ্ন্যাশয়ে কর্কট রোগে ভুগছিল। নূরজাহানের জন্ম সাতক্ষীরার এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে। পিতা ১৯৪৯ সালে বসিরহাট থেকে খুলনা চলে আসেন। নূরজাহান ছিল ১২ ভাইবোনের একজন।


বড় না হলেও ছোটবেলা থেকে অন্যান্য ভাইবোনের দেখভাল করতে হয়েছে তাকে। পড়াশোনায় বরাবরই ছিল মেধাবী। এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায়ই প্রথম বিভাগ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে সম্মান ও মাস্টার্স শেষ করে ১৯৬১ সালে। ইতিমধ্যে ১৯৬০ সালে আমেরিকাপ্রবাসী এক ডাক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয়। খুব অল্প দিনেই নূরজাহান বুঝতে পারে যে তার দাম্পত্য জীবন সম্মানজনক হবে না। এরপর ভগ্নহূদয়ে সে ঢাকা ফিরে আসে এবং একাই জীবন-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় মেয়ে ইরিকে নিয়ে। লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেয়। অনেক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল সে। এই সময়ে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, যা পরে ঘনিষ্ঠতার রূপ নেয়। নূরজাহান বাংলাদেশ ফেডারেশন অব বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনাল উইমেনের সাধারণ সম্পাদক, বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনাল উইমেন নর্থ ওয়েস্টের প্রতিষ্ঠাতা-সাধারণ সম্পাদক, বাস্তবায়ন সমিতির সদস্য এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্য ছিল।
পরবর্তীতে তার স্বামী ব্যারিস্টার কে জেড আলমও একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
মনে পড়ে, খাওয়াদাওয়া, একসঙ্গে পথচলা, কত জিনিস আদর করে দিয়ে দেওয়া...। মনে পড়ে, সে একবার ব্যাগ থেকে খুলে একটা সুগন্ধি দিতে গিয়ে দেখল তাতে অনেকটা কম আছে। আবার একটা বড় বোতল থেকে শিশিটা পূর্ণ করে দিল। আর একবার, কার কাছ থেকে শুনেছে আমি হজব্রত পালনে যাচ্ছি, সে আমাকে অনেকগুলো বোরকা (যা কাজে লেগেছিল) আর কতগুলো ছোট ব্যাগ তৈরি করে দিয়ে গেল। কোনো দাওয়াতে গেলে সবার জন্য ছোট ছোট তৈরি জিনিস নিয়ে যেত।
ওর সহূদয়তার পরিচয় আমি পেয়েছি নাইরোবি বিশ্ব নারী সম্মেলনে গিয়ে কিংবা কুমিল্লায় একসঙ্গে ওয়ার্কশপ করতে গিয়ে। আর এ রকম অনেক কাজেই একসঙ্গে গিয়েছি। অনেক ছোট ছোট কথা মনে পড়ছে। কোনো সময় বিরক্ত হয়ে কারও সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলে নূরজাহান বলত, মানুষ তো ভালো-মন্দ মিশিয়েই হয়—তার শুধু ভালোটুকু আমরা নেব, আর মন্দটুকু মনে না রাখলেই হয়।
প্রায় দুই বছর অগ্ন্যাশয়ের সমস্যায় ভুগেছিল। রোগটা ভালো হলো না। সবাইকে ছেড়ে চলে গেল নূরজাহান। আমরা হারালাম এক বন্ধুকে। আর তার চার সন্তান হারাল তাদের মাকে। ‘রিনি ও শেলী গার্মেন্ট’ এর কর্মীরা হারাল তাদের কর্মদাতাকে। যে যায় সে আর ফিরে আসে না। শুধু মনে পড়ে তাকে।

No comments

Powered by Blogger.