চালচিত্র-রাজনীতির আকাশজুড়ে অস্থিরতার ধূলিঝড় by শুভ রহমান
রাজনীতির আকাশজুড়ে অস্থিরতার ধূলিঝড়। পথ দেখা যায় না। কোনো কিছুই সুস্পষ্ট রূপ নিচ্ছে না। নবম জাতীয় সংসদের রুটিনমাফিক দ্বাদশ অধিবেশন শুরু হয়েছে। বিএনপি এখনো সংসদে যায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে কিছুটা সরে আসার কথা বলেও এখনো সেই দাবিতেই তারা ঘোষিত ১২ মার্চে পল্টনে মহাসমাবেশ ও 'ঢাকা চলো'র কর্মসূচি আঁকড়ে ধরে আছে। এদিকে শাসক মহাজোট ও ১৪ দলে অসন্তোষ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দেশি-বিদেশি নানা লবি সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে গোপনে, প্রকাশ্যে তৎপর রয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ মনেপ্রাণে এ অবস্থার সুষ্ঠু সমাধান, অর্থবহ নির্বাচন এবং কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার নিশ্চয়তাই চাইছে। কোনো রকম সংঘাত-সংঘর্ষই কারো কাম্য নয়।
সবাই বলছে, যেকোনো মূল্যে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতেই হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। এখন শুধু দরকার, কোন ব্যবস্থায় সে নির্বাচন পরিচালিত হবে তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি। আর নির্বাচন কমিশনের জন্য সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হলেও এটাই বাস্তবতা যে নির্বাচন পরিচালনার ব্যবস্থাটা ঠিক করার জন্য প্রধান দুটি দলের সমঝোতা অপরিহার্য। ইতিমধ্যেই সংঘাতের আশঙ্কা দূর না হওয়া সত্ত্বেও কিছু নেপথ্য এবং কিছু কিছু প্রকাশ্য অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে বড় দুটি দলের মধ্যে একটা সমঝোতার প্রচ্ছন্ন আবহ সৃষ্টি হয়েছে। খুব একটা সম্মানজনক না হলেও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের দৌত্যের মাধ্যমে দুই দল অনানুষ্ঠানিকভাবে নেপথ্যে সমঝোতার অনেক কাছাকাছি এসেছে। এর পরে প্রণব মুখার্জি আসছেন এবং ভারতও এ মধ্যস্থতায় যোগ দেবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ রকম সমঝোতা জনগণের প্রতি শতভাগ আস্থা ও আনুগত্য থাকলে দুই দল নিজেরাই গড়ে তুলতে পারত। সেটাই হতো দুই দলের জন্য, এ দেশের জন্য, এ দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের জন্য সবচেয়ে সম্মানজনক ও আকাঙ্ক্ষিত। অতীতের মতো সেটা এবারও হচ্ছে না। তার পরও বিশ্ব বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমাদের বলতে হচ্ছে, যেভাবেই হোক, যত দ্রুত সম্ভব দুই দলের মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা ব্যবস্থার প্রশ্নে একটা চূড়ান্ত সমঝোতা হোক। সমঝোতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তাদের একগুঁয়েমি ছেড়ে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছেড়ে অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী বা একটি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় সরে এসেছে। এতে সরকারি দল ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল একরকম স্বস্তিই বোধ করছে। উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার পর তা পুনর্বহালের চেয়ে নতুন একটি ব্যবস্থা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থাই যে অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য হবে, সেটা বিএনপিও অবশেষে মনে হচ্ছে মেনে নিতে রাজি। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, মূলত কৌশলগত কারণেই বিএনপি ১২ মার্চের মহাসমাবেশের আগে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করছে না। তারা শক্তির মহড়াই দেখিয়ে চলেছে।
ইতিমধ্যে দুই দলেরই একটা অন্তর্বর্তী সরকারের ফর্মুলা দেওয়ার উদ্যোগের কথা জানা গেছে। বিদেশি কূটনীতিকরা বলছেন, ব্যবস্থা যা-ই হোক, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ এবং একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। আর সে জন্যই দরকার দুই পক্ষের মধ্যে একটা দৃঢ় ও চূড়ান্ত সমঝোতা।
পর্যবেক্ষক মহল এটাও মনে করছে, সমঝোতা না হওয়ার, সমঝোতা শেষ মুহূর্তে ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার, একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, একটা 'কুরুক্ষেত্র' বেঁধে অসাংবিধানিক শক্তির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া, দেশের উন্নয়ন ও সব সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া, জনগণের জানমালের বিপুল ক্ষতি সাধিত হওয়া এবং দেশের দীর্ঘস্থায়ী এক পশ্চাৎপদতার অন্ধকার যুগে নিক্ষিপ্ত হওয়া ইত্যাকার সব রকম আশঙ্কাই এখনো পুরোমাত্রায় বিরাজ করছে। সমঝোতা না হলে যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচারও ভণ্ডুল হওয়ার সমূহ আশঙ্কা বিরাজ করছে। তার মানেই আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র লোপাট হয়ে যাওয়া।
সমঝোতা কারা করতে পারে, কারা সমঝোতার শক্তি
সমঝোতা কোনো দুর্বলতার লক্ষণ বা নিদর্শন নয়। সমঝোতা হচ্ছে দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকাশ। যারা শুধু ক্ষমতার রাজনীতিতেই মগ্ন, যারা সংকীর্ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দেয়, তারাই সমঝোতা করবে না।
গণতন্ত্রের বিরোধী বলেই তারা সমঝোতার বিরোধী। হিটলার গণতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন বলেই ১৯৩৩ সালে সংসদ বা পার্লামেন্ট ভবন বাইখস্ট্যাগ চক্রান্ত করে গোপনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, মিথ্যা দোষ চাপিয়েছিলেন কমিউনিস্টদের ওপর। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সে জন্য পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়ে হিটলারের নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় বসে সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্টসহ সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে কারারুদ্ধ করেছিল। গণতন্ত্রকে হিটলার ভয়ের চোখে দেখতেন। মনে করতেন গণতন্ত্রের পথেই সমাজতন্ত্র আসবে। অতএব গণতন্ত্রকেই রুখতে হবে। স্ট্যালিনের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি (নন অ্যাগ্রেশন প্যাক্ট) ও শান্তিচুক্তি হিটলারই ভঙ্গ করে পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়াকে আক্রমণ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাধিয়েছিলেন। বিশ্ব সভ্যতা ও মানবতাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরিণতিতে তাঁকেই তার ফ্যাসিবাদী নীতিসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হয়েছিল। ইতিহাসের রায়। 'যো চাল চালেগি হিটলারকি উয়ো হিটলারকি তারে মিট যায়েগি'- পঞ্চাশের দশকে আইপির ছিল তেজোদীপ্ত গান। শুধু ধ্রুপদী ইতিহাসই নয়, আধুনিক ও সাম্প্রতিক ইতিহাসেও পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর অনৈক্যের দরুন সে দেশে সামরিক নেপথ্য শক্তির হাতেই গণতন্ত্র বন্দি হয়ে থাকা এবং অন্যদিকে বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে সরকারি ও বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের কারণেই দীর্ঘতম সময় গণতন্ত্র টিকে থাকার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
সব সময়ই স্বৈরশক্তি গণতন্ত্র ও মানবতার বিরুদ্ধে হত্যা, ধ্বংস, মৃত্যুর পথ গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরতন্ত্রও সমঝোতা ও আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, অধিকার নস্যাৎ করতে চেয়েছিল। ইতিহাসে সব সময় যুক্তিবিরোধী শক্তি, পশুশক্তি, সহিংস শক্তিরই পরাজয় হয়। বিশ্বজুড়ে আজও ধ্বংসাত্মক শক্তিরই পরাজয় হচ্ছে।
যুক্তিবাদী শক্তি, সভ্য শক্তি তাই সব সময় শান্তির পথ, সমঝোতার পথই গ্রহণ করবে। আজ এখানেও পরিশেষে শান্তি ও সমঝোতার শক্তিরই জয় হবে। লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় এর কোনো বিকল্প নেই। তবে সমঝোতা তো অবশ্যই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে নয়। বরং স্বাধীনতাবিরোধী, একাত্তরের স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতি ক্ষমাহীন থেকেই যেকোনো সমঝোতা হতে হবে। সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে বিরোধিতা করে আসছে, সে প্রশ্নে কোনো রকম নমনীয়তা ও প্রশ্রয় দেওয়া হবে কার্যত গণতন্ত্রকেই অর্থহীন করে দেওয়া। বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার অর্থ হতে হবে অপরিহার্যভাবেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে, যুদ্ধাপরাধীদের ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করে যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া, রাজনৈতিকভাবে তাদের ছাড় দিয়ে কোনো সমঝোতাই হতে পারে না।
সমঝোতার বিষয়টি বস্তুত নতুন কিছু নয়। সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার সময়ই সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান বিরোধী দলের প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থার প্রস্তাব থাকলে তা নিয়ে সংসদে আলোচনায় আসার আহ্বান জানিয়ে রেখেছিলেন। অনেক পানি ঘোলা করে শেষ পর্যন্ত বিএনপি সেই বিকল্প একটি প্রস্তাব হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার ফর্মুলা নিয়েই শেষে সংসদে আসবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এর আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগও বিভিন্ন সময় অনমনীয়, এমনকি দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রদর্শন করে সমঝোতার পরিবর্তে সংঘাত-সংঘর্ষের আত্মঘাতী পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছিল। এখন পর্যন্ত তারা বাহ্যিকভাবে সে বৈরিতা সম্পূর্ণ ত্যাগ করেনি- সম্ভবত কৌশলগত কারণেই। জাতির কাছে এটা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। বিএনপির পূর্বঘোষিত 'ঢাকা চলো' ও পল্টনে ১২ মার্চের মহাসমাবেশের কর্মসূচিকে নগ্নভাবে ও অগণতান্ত্রিকভাবে বাধা দেওয়ার জন্য সরকারি দল রাজধানীর প্রবেশপথগুলো উলি্লখিত দিনে দখলে রাখার ঘোষণা দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি ও গণতন্ত্রের কার্যত মৃত্যুঘণ্টাই বাজিয়ে দিয়েছিল।
যা হোক, পরিশেষে বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপেই হোক কিংবা নিজেদের চৈতন্যোদয়ের কারণেই হোক, তারা আর সে পথে যায়নি। ১২ মার্চের মহাসমাবেশ বাধাগ্রস্ত না করে ভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারাও অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার একটা ফর্মুলা সংসদে পেশ করতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন সুবিবেচক মহলের সঙ্গে আমরাও দুই পক্ষের এই চৈতন্যোদয়কে স্বাগত জানাই। সংঘাত-সংঘর্ষের পথে গিয়ে তারা গণতন্ত্রের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার পথ থেকে সরে এলে জাতি এতে শুধু স্বস্তি বোধই করবে না, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদীও হয়ে উঠবে।
আমরা মনে করি, ১২ মার্চের মহাসমাবেশ করার পর দীর্ঘ সময় বর্জনের অবসান ঘটিয়ে প্রধান বিরোধী দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার ফর্মুলা বিল আকারে তুলে ধরার জন্য সংসদে প্রত্যাবর্তনের যে নব অধ্যায়ের সূচনা করবে, ভবিষ্যতে তা অভিন্ন জাতীয় স্বার্থ ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে সংসদের দুই প্রধান পক্ষ- সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ও ভূমিকা গ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বর্ণোজ্জ্বল সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করে দেবে।
২৬.০২.২০১২
সবাই বলছে, যেকোনো মূল্যে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতেই হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। এখন শুধু দরকার, কোন ব্যবস্থায় সে নির্বাচন পরিচালিত হবে তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি। আর নির্বাচন কমিশনের জন্য সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হলেও এটাই বাস্তবতা যে নির্বাচন পরিচালনার ব্যবস্থাটা ঠিক করার জন্য প্রধান দুটি দলের সমঝোতা অপরিহার্য। ইতিমধ্যেই সংঘাতের আশঙ্কা দূর না হওয়া সত্ত্বেও কিছু নেপথ্য এবং কিছু কিছু প্রকাশ্য অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে বড় দুটি দলের মধ্যে একটা সমঝোতার প্রচ্ছন্ন আবহ সৃষ্টি হয়েছে। খুব একটা সম্মানজনক না হলেও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের দৌত্যের মাধ্যমে দুই দল অনানুষ্ঠানিকভাবে নেপথ্যে সমঝোতার অনেক কাছাকাছি এসেছে। এর পরে প্রণব মুখার্জি আসছেন এবং ভারতও এ মধ্যস্থতায় যোগ দেবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ রকম সমঝোতা জনগণের প্রতি শতভাগ আস্থা ও আনুগত্য থাকলে দুই দল নিজেরাই গড়ে তুলতে পারত। সেটাই হতো দুই দলের জন্য, এ দেশের জন্য, এ দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের জন্য সবচেয়ে সম্মানজনক ও আকাঙ্ক্ষিত। অতীতের মতো সেটা এবারও হচ্ছে না। তার পরও বিশ্ব বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমাদের বলতে হচ্ছে, যেভাবেই হোক, যত দ্রুত সম্ভব দুই দলের মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা ব্যবস্থার প্রশ্নে একটা চূড়ান্ত সমঝোতা হোক। সমঝোতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তাদের একগুঁয়েমি ছেড়ে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছেড়ে অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী বা একটি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় সরে এসেছে। এতে সরকারি দল ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল একরকম স্বস্তিই বোধ করছে। উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার পর তা পুনর্বহালের চেয়ে নতুন একটি ব্যবস্থা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থাই যে অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য হবে, সেটা বিএনপিও অবশেষে মনে হচ্ছে মেনে নিতে রাজি। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, মূলত কৌশলগত কারণেই বিএনপি ১২ মার্চের মহাসমাবেশের আগে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করছে না। তারা শক্তির মহড়াই দেখিয়ে চলেছে।
ইতিমধ্যে দুই দলেরই একটা অন্তর্বর্তী সরকারের ফর্মুলা দেওয়ার উদ্যোগের কথা জানা গেছে। বিদেশি কূটনীতিকরা বলছেন, ব্যবস্থা যা-ই হোক, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ এবং একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। আর সে জন্যই দরকার দুই পক্ষের মধ্যে একটা দৃঢ় ও চূড়ান্ত সমঝোতা।
পর্যবেক্ষক মহল এটাও মনে করছে, সমঝোতা না হওয়ার, সমঝোতা শেষ মুহূর্তে ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার, একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, একটা 'কুরুক্ষেত্র' বেঁধে অসাংবিধানিক শক্তির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া, দেশের উন্নয়ন ও সব সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া, জনগণের জানমালের বিপুল ক্ষতি সাধিত হওয়া এবং দেশের দীর্ঘস্থায়ী এক পশ্চাৎপদতার অন্ধকার যুগে নিক্ষিপ্ত হওয়া ইত্যাকার সব রকম আশঙ্কাই এখনো পুরোমাত্রায় বিরাজ করছে। সমঝোতা না হলে যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচারও ভণ্ডুল হওয়ার সমূহ আশঙ্কা বিরাজ করছে। তার মানেই আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র লোপাট হয়ে যাওয়া।
সমঝোতা কারা করতে পারে, কারা সমঝোতার শক্তি
সমঝোতা কোনো দুর্বলতার লক্ষণ বা নিদর্শন নয়। সমঝোতা হচ্ছে দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকাশ। যারা শুধু ক্ষমতার রাজনীতিতেই মগ্ন, যারা সংকীর্ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দেয়, তারাই সমঝোতা করবে না।
গণতন্ত্রের বিরোধী বলেই তারা সমঝোতার বিরোধী। হিটলার গণতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন বলেই ১৯৩৩ সালে সংসদ বা পার্লামেন্ট ভবন বাইখস্ট্যাগ চক্রান্ত করে গোপনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, মিথ্যা দোষ চাপিয়েছিলেন কমিউনিস্টদের ওপর। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সে জন্য পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়ে হিটলারের নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় বসে সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্টসহ সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে কারারুদ্ধ করেছিল। গণতন্ত্রকে হিটলার ভয়ের চোখে দেখতেন। মনে করতেন গণতন্ত্রের পথেই সমাজতন্ত্র আসবে। অতএব গণতন্ত্রকেই রুখতে হবে। স্ট্যালিনের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি (নন অ্যাগ্রেশন প্যাক্ট) ও শান্তিচুক্তি হিটলারই ভঙ্গ করে পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়াকে আক্রমণ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাধিয়েছিলেন। বিশ্ব সভ্যতা ও মানবতাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরিণতিতে তাঁকেই তার ফ্যাসিবাদী নীতিসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হয়েছিল। ইতিহাসের রায়। 'যো চাল চালেগি হিটলারকি উয়ো হিটলারকি তারে মিট যায়েগি'- পঞ্চাশের দশকে আইপির ছিল তেজোদীপ্ত গান। শুধু ধ্রুপদী ইতিহাসই নয়, আধুনিক ও সাম্প্রতিক ইতিহাসেও পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর অনৈক্যের দরুন সে দেশে সামরিক নেপথ্য শক্তির হাতেই গণতন্ত্র বন্দি হয়ে থাকা এবং অন্যদিকে বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে সরকারি ও বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের কারণেই দীর্ঘতম সময় গণতন্ত্র টিকে থাকার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
সব সময়ই স্বৈরশক্তি গণতন্ত্র ও মানবতার বিরুদ্ধে হত্যা, ধ্বংস, মৃত্যুর পথ গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরতন্ত্রও সমঝোতা ও আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, অধিকার নস্যাৎ করতে চেয়েছিল। ইতিহাসে সব সময় যুক্তিবিরোধী শক্তি, পশুশক্তি, সহিংস শক্তিরই পরাজয় হয়। বিশ্বজুড়ে আজও ধ্বংসাত্মক শক্তিরই পরাজয় হচ্ছে।
যুক্তিবাদী শক্তি, সভ্য শক্তি তাই সব সময় শান্তির পথ, সমঝোতার পথই গ্রহণ করবে। আজ এখানেও পরিশেষে শান্তি ও সমঝোতার শক্তিরই জয় হবে। লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় এর কোনো বিকল্প নেই। তবে সমঝোতা তো অবশ্যই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে নয়। বরং স্বাধীনতাবিরোধী, একাত্তরের স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতি ক্ষমাহীন থেকেই যেকোনো সমঝোতা হতে হবে। সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে বিরোধিতা করে আসছে, সে প্রশ্নে কোনো রকম নমনীয়তা ও প্রশ্রয় দেওয়া হবে কার্যত গণতন্ত্রকেই অর্থহীন করে দেওয়া। বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার অর্থ হতে হবে অপরিহার্যভাবেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে, যুদ্ধাপরাধীদের ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করে যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া, রাজনৈতিকভাবে তাদের ছাড় দিয়ে কোনো সমঝোতাই হতে পারে না।
সমঝোতার বিষয়টি বস্তুত নতুন কিছু নয়। সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার সময়ই সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান বিরোধী দলের প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থার প্রস্তাব থাকলে তা নিয়ে সংসদে আলোচনায় আসার আহ্বান জানিয়ে রেখেছিলেন। অনেক পানি ঘোলা করে শেষ পর্যন্ত বিএনপি সেই বিকল্প একটি প্রস্তাব হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার ফর্মুলা নিয়েই শেষে সংসদে আসবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এর আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগও বিভিন্ন সময় অনমনীয়, এমনকি দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রদর্শন করে সমঝোতার পরিবর্তে সংঘাত-সংঘর্ষের আত্মঘাতী পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছিল। এখন পর্যন্ত তারা বাহ্যিকভাবে সে বৈরিতা সম্পূর্ণ ত্যাগ করেনি- সম্ভবত কৌশলগত কারণেই। জাতির কাছে এটা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। বিএনপির পূর্বঘোষিত 'ঢাকা চলো' ও পল্টনে ১২ মার্চের মহাসমাবেশের কর্মসূচিকে নগ্নভাবে ও অগণতান্ত্রিকভাবে বাধা দেওয়ার জন্য সরকারি দল রাজধানীর প্রবেশপথগুলো উলি্লখিত দিনে দখলে রাখার ঘোষণা দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি ও গণতন্ত্রের কার্যত মৃত্যুঘণ্টাই বাজিয়ে দিয়েছিল।
যা হোক, পরিশেষে বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপেই হোক কিংবা নিজেদের চৈতন্যোদয়ের কারণেই হোক, তারা আর সে পথে যায়নি। ১২ মার্চের মহাসমাবেশ বাধাগ্রস্ত না করে ভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারাও অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার একটা ফর্মুলা সংসদে পেশ করতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন সুবিবেচক মহলের সঙ্গে আমরাও দুই পক্ষের এই চৈতন্যোদয়কে স্বাগত জানাই। সংঘাত-সংঘর্ষের পথে গিয়ে তারা গণতন্ত্রের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার পথ থেকে সরে এলে জাতি এতে শুধু স্বস্তি বোধই করবে না, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদীও হয়ে উঠবে।
আমরা মনে করি, ১২ মার্চের মহাসমাবেশ করার পর দীর্ঘ সময় বর্জনের অবসান ঘটিয়ে প্রধান বিরোধী দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার ফর্মুলা বিল আকারে তুলে ধরার জন্য সংসদে প্রত্যাবর্তনের যে নব অধ্যায়ের সূচনা করবে, ভবিষ্যতে তা অভিন্ন জাতীয় স্বার্থ ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে সংসদের দুই প্রধান পক্ষ- সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ও ভূমিকা গ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বর্ণোজ্জ্বল সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করে দেবে।
২৬.০২.২০১২
No comments