মানবাধিকার-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এ কোন পুলিশ বাহিনী?

গত কয়েক দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকলাপের যে বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আমরা দারুণভাবে উদ্বিগ্ন ও অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। সম্প্রতি পুলিশের সহযোগিতায় যে গণপিটুনির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তা পুরো জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। ২০১১ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৯৫ জন মারা যান।


তা ছাড়া পুলিশের গুলিতে বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা তো আছেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চলতি বছরের ৮ আগস্ট পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৬২ জন। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আটজন মারা যান।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের সহযোগিতায় সংঘটিত কয়েকটি ঘটনায় দেখা যায়, গত ২৭ জুলাই সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশ ১৬ বছরের শামছুদ্দিন মিলনকে জনতার হাতে তুলে দেয়। প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে গণপিটুনিতে মিলন মারা যায়। শামছুদ্দিন মিলনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ মিলনের লাশ নিয়ে যায়। ঘটনার ভিডিও চিত্রটি এতটাই ভয়াবহ যে জনতার মধ্যে থেকে কয়েকজন ব্যক্তি কিশোর মিলনকে লাঠিপেটা করে এবং মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পুলিশের কিছু সদস্য সেই পৈশাচিক দৃশ্য দেখেন এবং তাঁরা যে ওই কিশোরকে মেরে ফেলতে বলেছেন, তা-ও ওই ভিডিও চিত্রে শোনা যায়। এ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ না হলে আমরা কেউ কি ভাবতে পারতাম, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এতটা অমানুষিক এবং নৃশংস হতে পারেন!
গত ১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ডাকাতির প্রস্তুতির অভিযোগে খিলগাঁও থানা পুলিশ আটক করে এবং তাঁর ওপর চালানো হয় গণপিটুনির নামে বর্বর নির্যাতন। অথচ কাদের কার সহযোগী, কোথায় ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত পুলিশ সুস্পষ্ট কিছুই জানাতে পারেনি। আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করলে আবদুল কাদেরের ঘটনাটি কোথায় গড়াত, তা বলা মুশকিল।
গত ১৮ জুলাই সাভারের আমিনবাজারে গণপিটুনিতে ডাকাত সন্দেহে ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। নিহত হওয়া ছয় তরুণের বেঁচে যাওয়া বন্ধু আল আমিনের বক্তব্যে জানা গেছে, পুলিশের উপস্থিতিতেই স্থানীয় জনগণ তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলে। তার কথায় জানা যায়, পুলিশ বলেছে, ‘আপনারা সবাইকে মেরে ফেললে সমস্যা হবে, অন্তত একজনকে বাঁচিয়ে রাখুন।’ পুলিশের এ বক্তব্যে গ্রামবাসী আল আমিনকে মারধর বন্ধ করায় সে প্রাণে বেঁচে যায়।
এভাবে সাধারণ মানুষের আইন হাতে তুলে নেওয়া এবং সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের অসংবেদনশীল আচরণ ভয়াবহ ফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে বলে আমাদের শঙ্কা। এর মধ্যেই তার নমুনা আমরা পেতে শুরু করেছি। গত সোমবার গফরগাঁওয়ে এক মহিলার গায়ে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন গরম পানি ঢেলে দেওয়ার নালিশ দিতে পুলিশের কাছে যান। পুলিশ যখন সেই গ্রামে যায়, পুলিশেরই ভাষ্যমতে, গ্রামের লোক তখন ‘ডাকাত’ ‘ডাকাত’ বলে পুলিশকেই আক্রমণ করতে আসে। আমাদের কাছে অবশ্য এটা বোধগম্য নয়, ইউনিফর্ম পরা পুলিশকে কী অর্থে ডাকাত বলে আক্রমণের অবকাশ থাকে! কিন্তু আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো, এখন যেকোনো পরিস্থিতিতে ‘ডাকাত’ ‘ডাকাত’ রব উঠিয়ে যেকোনো মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, কিংবা বলা চলে হয়ে গেছে। আমরা এই পরিণতির আশঙ্কা থেকেই সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে সতর্ক হওয়ার আবেদন জানিয়ে আসছি এত দিন ধরে।
গণপিটুনির পাশাপাশি আরও একটি প্রবণতার কথা শোনা যাচ্ছে। তা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অপহরণ ও গুম। সম্প্রতি ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে তরুণদের হাত-পা ও চোখ বাঁধা গুলিবিদ্ধ লাশ রাস্তা বা তার পাশের এলাকায় পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাশ উদ্ধারের দুই-তিন দিন আগেই তাঁদের এলাকা থেকে র‌্যাব বা পুলিশের পরিচয়ে প্রকাশ্যে তুলে নেওয়া হয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রশিক্ষিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে পুলিশকে আমরা কতটা জনগণের সেবক ভাবতে পারি?
এই বাস্তবতায় আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মাননীয় মন্ত্রী আপনি ১৮ জুলাই আমিনবাজারের ছয় ছাত্রের ঘটনায় বলেছিলেন, ‘সরকার চায় না মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিক।’ কিন্তু আপনার বক্তব্যের সঙ্গে আপনার বাহিনীর কার্যক্রমের অমিল বেড়েই চলেছে।
মিলনকে জনতার হাতে তুলে দিয়ে পুলিশই পরোক্ষভাবে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে মিলন হত্যার দায় এড়ানো সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের মিলন হত্যার অপরাধের দায়ে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
সময় এসেছে পুলিশ বাহিনীর এ নির্যাতনমূলক, বেআইনি, নিষ্ঠুর, মানবতার জন্য অবমাননাকর আচরণ প্রতিরোধ করার এবং ঘটনা ঘটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিকার এবং দোষী ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিদের শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দরকার সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে কঠোর নির্দেশনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং পুলিশ ও র‌্যাবকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা।
যে পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সে পুলিশ বাহিনী মানুষের জীবনকে কত অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলেছে, তা একবার ভেবে দেখুন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন অবস্থা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তার জবাবদিহি আমাদেরও করতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের অপরাধ কার্যক্রমের দায়ভার কোনোভাবেই জাতি বহন করতে পারে না। এ দায় আমরা কেন নেব? পুলিশ জনগণের সেবক না হতে পারে, কিন্তু ঘাতক হওয়ার অধিকার তাকে কেউ দেয়নি।
আমরা মানবাধিকার, সুশাসন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে এই অবস্থার অবসান চাই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক): মানবাধিকার সংস্থা।

No comments

Powered by Blogger.