জন্মদিন-মানুষকে কাছে টানার আশ্চর্য গুণ তাঁর by শামসুদ্দিন পেয়ারা
১৯৭৭ সালে ইংরেজি সাপ্তাহিক নিউ নেশন-এ আদম ব্যবসায় নিয়ে আমার একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল, যার সঙ্গে বিমানবাহিনীতে কর্মরত এক জুনিয়র কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। তিনি পত্রিকা অফিসে টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, রিপোর্টটি কে করেছেন? এবিএম মূসা সাহেব তখন ওই পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক।
তিনি বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাকে বললেন, ‘পত্রিকার পেছনে প্রিন্টার্স লাইনে দেখুন কার কার নাম আছে।’ ভদ্রলোক নামগুলো পড়লেন। মূসা সাহেব বললেন, ‘যা বলার আমাকে বলতে পারেন। রিপোর্ট সম্পর্কে আপনার কোনো আপত্তি থাকলে জানাতে পারেন। কিন্তু কে রিপোর্ট করেছেন, তা বলা যাবে না। প্রিন্টার্স লাইনে যখন আমার নাম ছাপা হয়েছে, তখন এর দায়িত্বও আমার।’ ভদ্রলোক আর কথা না বাড়িয়ে টেলিফোনটি রেখে দিলেন। এই হলেন এবি এম মূসা।
এখানে বলে রাখি, উপদেষ্টা সম্পাদকের পরামর্শেই আমি রিপোর্টটি করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘সাংবাদিক পরিচয়ে গেলে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। যেতে হবে চাকরিপ্রার্থী হয়ে।’ আমি তা-ই করলাম। উল্লিখিত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললাম। কথা বললাম চাকরিপ্রার্থী আরও অনেকের সঙ্গে, যাঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও চাকরি দেননি ওই কর্মকর্তা।
এবিএম মূসার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটি মনে পড়ে। একদিন বন্ধু ফেরদৌস আলম দুলাল জানান, নিউ নেশন নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক বের হবে। প্রথম আলাপেই তিনি বললেন, ‘কিসে পড়েছিস?’ বললাম, ‘অর্থনীতি।’ এনায়েতউল্লাহ খান, আতাউস সামাদ ও শহিদুল হক ছাড়া সম্ভবত অনুজ সবাইকে তিনি তুই বলে সম্বোধন করতেন। এখনো করেন।
এবিএম মূসা সব সময় সহকর্মীদের আগলে রাখতেন। তিনি রিপোর্টারকে দায়িত্ব দিয়ে বসে থাকতেন না। রিপোর্টের তথ্য জোগাড় করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, খোঁজ নিতেন। কীভাবে রিপোর্টটি করতে হবে, পরামর্শ দিতেন। আমি একবার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ-সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট করার জন্য তৎকালীন ত্রাণসচিব খোরশেদ আলমের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি রাজি হননি। পরে বিষয়টি মূসা সাহেবকে বলায় তিনি তাঁকে টেলিফোন করে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিলেন।
এবিএম মূসার সাংবাদিকতা শুরু পঞ্চাশের দশকে দৈনিক ইনসাফ-এ। এরপর ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-এ যোগ দেন। দীর্ঘদিন সেই পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলেন। এবিএম মূসাই হলেন একমাত্র সাংবাদিক, যিনি পাকিস্তান আমলে সংবাদপত্রের আধুনিক মেকআপ বিষয়ে কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের ফেলোশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যে পড়াশুনা করেছেন। ফিরে এসে তিনি পাকিস্তান অবজারভার-এর চেহারাই বদলে দিলেন। অন্যান্য পত্রিকাও তাঁকে অনুসরণ করল।
খরচ কমাতে আগে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আলোকচিত্রীদের যেকোনো ঘটনার একটি ছবি তুলতে বলত। এবিএম মূসা বললেন, ‘তা হবে না। ৮-১০টি ছবি আনতে হবে। এর মধ্যে বাছাই করে যেটি পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে, সেটি ছাপা হবে।’ এ ছাড়া আগে ছবি ছাপা হতো সম্পাদনা ছাড়াই, আলোকচিত্রী যেভাবে দিতেন। এবিএম মূসাই এ দেশে ছবি সম্পাদনা করে ছাপার রীতি চালু করলেন। সংবাদ পরিবেশনায় বস্তুনিষ্ঠতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি , যে কারণে পাকিস্তান অবজারভার দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকের গৌরব অর্জন করে। পাকিস্তান অবজারভার পশ্চিম পাকিস্তানেও ১০ হাজার কপি চলত, যদিও ওখানকার কোনো দৈনিক এখানে বিক্রি হতো না। এ সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল এবিএম মূসার।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রণাঙ্গন থেকে বিবিসি, লন্ডন টাইমস, টেলিগ্রাফ প্রভৃতি পত্রিকায় খবর পাঠাতেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক ও মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবিএম মূসা এই প্রতিষ্ঠানটির চারবার সভাপতি ও তিনবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
এবিএম মূসা নিউ নেশন-এ বেশি দিন ছিলেন না। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে এসকাপের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক পদে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তাঁর সঙ্গে আমি আবার দুই বছরের মতো কাজ করার সুযোগ পাই। পরে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক হন। এ ছাড়া নিউজ ডে ও যুগান্তর-এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ দেশের সাংবাদিকতা ভুবনে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন।
আরেকটি বিষয় লক্ষ করেছি, আমাদের পেশার কিংবা পেশার বাইরে কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে গেলে সেটির সমাধান না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। অনেক সময় দেখেছি, আমরা হয়তো তাঁকে বলে সমস্যাটির কথা বলে ভুলে গেছি। কিন্তু তিনি ভুলতেন না। নিজেই জিজ্ঞেস করতেন।
এবিএম মূসা এখনো সুস্থ থাকলে প্রায় প্রতিদিন প্রেসক্লাবে আসেন। সবার সঙ্গে গল্প করেন। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, তরুণতর সাংবাদিকেরা যে টেবিলে বসেন, মূসা সাহেব সেখানে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলাপ করেন, হাসিঠাট্টায় সবাইকে মাতিয়ে রাখেন।
সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে এবিএম মূসা এখন লেখালেখিতে ব্যস্ত। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টিভি টক শোরও দর্শকপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তিনি। অশীতিপর এই মানুষটি যেমন দলমত-নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধা ও সমীহ আদায় করে নেন; তেমনি প্রতিটি মানুষকেও তিনি কাছে টেনে নেন। মানুষকে কাছে টানার আশ্চর্য গুণ আছে তাঁর।
এবিএম মূসার ৮১তম জন্মবার্ষিকীতে জানাই রক্তিম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমাদের সহযাত্রী, আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে তিনি বেঁচে থাকুন আরও অনেক দিন।
শামসুদ্দিন পেয়ারা
এখানে বলে রাখি, উপদেষ্টা সম্পাদকের পরামর্শেই আমি রিপোর্টটি করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘সাংবাদিক পরিচয়ে গেলে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। যেতে হবে চাকরিপ্রার্থী হয়ে।’ আমি তা-ই করলাম। উল্লিখিত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললাম। কথা বললাম চাকরিপ্রার্থী আরও অনেকের সঙ্গে, যাঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও চাকরি দেননি ওই কর্মকর্তা।
এবিএম মূসার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটি মনে পড়ে। একদিন বন্ধু ফেরদৌস আলম দুলাল জানান, নিউ নেশন নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক বের হবে। প্রথম আলাপেই তিনি বললেন, ‘কিসে পড়েছিস?’ বললাম, ‘অর্থনীতি।’ এনায়েতউল্লাহ খান, আতাউস সামাদ ও শহিদুল হক ছাড়া সম্ভবত অনুজ সবাইকে তিনি তুই বলে সম্বোধন করতেন। এখনো করেন।
এবিএম মূসা সব সময় সহকর্মীদের আগলে রাখতেন। তিনি রিপোর্টারকে দায়িত্ব দিয়ে বসে থাকতেন না। রিপোর্টের তথ্য জোগাড় করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, খোঁজ নিতেন। কীভাবে রিপোর্টটি করতে হবে, পরামর্শ দিতেন। আমি একবার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ-সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট করার জন্য তৎকালীন ত্রাণসচিব খোরশেদ আলমের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি রাজি হননি। পরে বিষয়টি মূসা সাহেবকে বলায় তিনি তাঁকে টেলিফোন করে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিলেন।
এবিএম মূসার সাংবাদিকতা শুরু পঞ্চাশের দশকে দৈনিক ইনসাফ-এ। এরপর ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-এ যোগ দেন। দীর্ঘদিন সেই পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলেন। এবিএম মূসাই হলেন একমাত্র সাংবাদিক, যিনি পাকিস্তান আমলে সংবাদপত্রের আধুনিক মেকআপ বিষয়ে কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের ফেলোশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যে পড়াশুনা করেছেন। ফিরে এসে তিনি পাকিস্তান অবজারভার-এর চেহারাই বদলে দিলেন। অন্যান্য পত্রিকাও তাঁকে অনুসরণ করল।
খরচ কমাতে আগে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আলোকচিত্রীদের যেকোনো ঘটনার একটি ছবি তুলতে বলত। এবিএম মূসা বললেন, ‘তা হবে না। ৮-১০টি ছবি আনতে হবে। এর মধ্যে বাছাই করে যেটি পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে, সেটি ছাপা হবে।’ এ ছাড়া আগে ছবি ছাপা হতো সম্পাদনা ছাড়াই, আলোকচিত্রী যেভাবে দিতেন। এবিএম মূসাই এ দেশে ছবি সম্পাদনা করে ছাপার রীতি চালু করলেন। সংবাদ পরিবেশনায় বস্তুনিষ্ঠতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি , যে কারণে পাকিস্তান অবজারভার দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকের গৌরব অর্জন করে। পাকিস্তান অবজারভার পশ্চিম পাকিস্তানেও ১০ হাজার কপি চলত, যদিও ওখানকার কোনো দৈনিক এখানে বিক্রি হতো না। এ সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল এবিএম মূসার।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রণাঙ্গন থেকে বিবিসি, লন্ডন টাইমস, টেলিগ্রাফ প্রভৃতি পত্রিকায় খবর পাঠাতেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক ও মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবিএম মূসা এই প্রতিষ্ঠানটির চারবার সভাপতি ও তিনবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
এবিএম মূসা নিউ নেশন-এ বেশি দিন ছিলেন না। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে এসকাপের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক পদে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তাঁর সঙ্গে আমি আবার দুই বছরের মতো কাজ করার সুযোগ পাই। পরে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক হন। এ ছাড়া নিউজ ডে ও যুগান্তর-এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ দেশের সাংবাদিকতা ভুবনে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন।
আরেকটি বিষয় লক্ষ করেছি, আমাদের পেশার কিংবা পেশার বাইরে কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে গেলে সেটির সমাধান না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। অনেক সময় দেখেছি, আমরা হয়তো তাঁকে বলে সমস্যাটির কথা বলে ভুলে গেছি। কিন্তু তিনি ভুলতেন না। নিজেই জিজ্ঞেস করতেন।
এবিএম মূসা এখনো সুস্থ থাকলে প্রায় প্রতিদিন প্রেসক্লাবে আসেন। সবার সঙ্গে গল্প করেন। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, তরুণতর সাংবাদিকেরা যে টেবিলে বসেন, মূসা সাহেব সেখানে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলাপ করেন, হাসিঠাট্টায় সবাইকে মাতিয়ে রাখেন।
সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে এবিএম মূসা এখন লেখালেখিতে ব্যস্ত। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টিভি টক শোরও দর্শকপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তিনি। অশীতিপর এই মানুষটি যেমন দলমত-নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধা ও সমীহ আদায় করে নেন; তেমনি প্রতিটি মানুষকেও তিনি কাছে টেনে নেন। মানুষকে কাছে টানার আশ্চর্য গুণ আছে তাঁর।
এবিএম মূসার ৮১তম জন্মবার্ষিকীতে জানাই রক্তিম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমাদের সহযাত্রী, আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে তিনি বেঁচে থাকুন আরও অনেক দিন।
শামসুদ্দিন পেয়ারা
No comments