অর্থনীতি-শেয়ারবাজার, সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপন ও একটি পর্যালোচনা by তোফাজ্জল হোসেন
শেয়ারবাজার যখন চরম আস্থার সংকটে ভুগছে, সরকার বাজার উত্তরণে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে, ঠিক তখনই কিছু দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থান্বেষী মহল শেয়ার কেলেঙ্কারির দায়ভার অন্যের ওপর অর্থাৎ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরিচালকদের শেয়ার ধারণে এসইসি কর্তৃক একটি নির্দেশনা জারি করা হয়।
নির্দেশনাটি পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে কোম্পানির ৩০% শেয়ার ধারণ; প্রত্যেক স্পন্সর পরিচালককে আলাদাভাবে ২% শেয়ার ধারণ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে পাবলিক শেয়ারহোল্ডারদের ২% শেয়ার ধারণে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ চার-পাঁচ বছর আগে এসইসি শেয়ারের কোনো ক্যাটাগরি থাকবে না বলে নির্দেশনা জারি করেছিল
সময়ের আলোচিত, সমালোচিত শব্দ 'শেয়ারবাজার'। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী জড়িত। এই শেয়ারবাজারেই দেশের অসংখ্য বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অর্থনীতি ও শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে, বিনিয়োগযোগ্য নতুন পুঁজি গঠিত হয়েছে। নানা ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও 'পতন' নামক আরেকটি শব্দের কারণে অর্জনগুলো ব্যাহত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পতন নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী পদক্ষেপ, সংসদে আলোচনা-সমালোচনা, বিনিয়োগকারীদের রাজপথে আন্দোলন, পারিবারিক অশান্তি, আত্মহত্যাসহ নানাবিধ ঘটনা-দুর্ঘটনার শিকার দেশের শেয়ারবাজার। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অদক্ষতা, অপ্রয়োজনীয় সার্কুলার জারি ও প্রত্যাহার, দুর্বল মনিটরিং, ডাইরেক্ট লিস্টিংয়ের নামে বিশেষ বিশেষ কোম্পানিকে সুবিধা প্রদান, ত্রুটিপূর্ণ বুক বিল্ডিং পদ্ধতি, অ্যাসেট রি-ভ্যালুয়েশনে অস্বচ্ছতা, প্লেসমেন্ট শেয়ার বাণিজ্য, ব্যাংকের সঞ্চয়ী ও মেয়াদি আমানতের সুদের হার হ্রাস, নানামুখী গুজব, বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োচিত পদক্ষেপের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বহীনতা, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আইনি সীমার বাইরে বিনিয়োগ, চাহিদা ও জোগানের অসামঞ্জস্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের বাজার থেকে মুনাফা তুলে নেওয়া নানাবিধ কারণ এবং পক্ষ শেয়ারবাজারকে যেভাবে অতিমূল্যায়িত করেছে, তেমনি নিয়ে গেছে পতনের দিকে।
ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি বিদ্যমান। এটাই ব্যবসার ধর্ম। আর এ নিয়মকে মেনেই যে কাউকে ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হয়। শেয়ারবাজার এর ব্যতিক্রম নয়। বিনিয়োগের লাভ যেমন বিনিয়োগকারীর, তেমনি সাময়িক ক্ষতিও বিনিয়োগকারীর। শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় বিনিয়োগে বিভিন্ন কোম্পানির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, শেয়ারের মৌল ভিত্তি ও কোম্পানির আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই বিনিয়োগকারীকে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। নানা উন্নয়ন ও সংস্কার সত্ত্বেও আমাদের দেশের শেয়ারবাজার এখনও উন্নত বিশ্বের শেয়ারবাজারের বিবেচনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে। শক্তিশালী শেয়ারবাজার, বিনিয়োগ নিরাপত্তার জন্য কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন অপরিহার্য ছিল, যেমন_ ১. প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন; ২. নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পূর্ণ স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা; ৩. দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ধারণ; ৪. শেয়ারবাজারের ডি-মিউচুয়ালাইজেশন; ৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা; ৬. বিনিয়োগকারীদের প্রশিক্ষণ। উপরিউক্ত নিয়ামক, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন না ঘটিয়ে রোড শোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে অংশগ্রহণের আহ্বান (যারা শেয়ারবাজার সম্পর্কে খুব কিছু বোঝেন না), দেশব্যাপী ব্রোকারেজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শাখা খোলার অনুমতি প্রদান শেয়ারবাজারকে অতিমূল্যায়িত করতে সহায়তা করেছে।
শেয়ারবাজার যখন চরম আস্থার সংকটে ভুগছে, সরকার বাজার উত্তরণে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে, ঠিক তখনই কিছু দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থান্বেষী মহল শেয়ার কেলেঙ্কারির দায়ভার অন্যের ওপর অর্থাৎ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরিচালকদের শেয়ার ধারণে এসইসি কর্তৃক একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। নির্দেশনাটি পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে কোম্পানির ৩০% শেয়ার ধারণ; প্রত্যেক স্পন্সর পরিচালককে আলাদাভাবে ২% শেয়ার ধারণ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে পাবলিক শেয়ারহোল্ডারদের ২% শেয়ার ধারণে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ চার-পাঁচ বছর আগে এসইসি শেয়ারের কোনো ক্যাটাগরি থাকবে না বলে নির্দেশনা জারি করেছিল। পরিচালকদের ২% শেয়ার ধারণ কোম্পানি আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন, বীমা আইনের কোনো ধারা, উপ-ধারা এমনকি কোম্পানির লাইসেন্সপ্রাপ্তির সময়ও উল্লেখ করা হয়নি। এসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জ প্রজ্ঞাপন জারির আগে বিষয়বস্তু নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা না করায় ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। মূলত নিয়ন্ত্রণ সংস্থার ল্যাপসেস, দুর্বল মনিটরিং ও কতিপয় বাজার খেলোয়াড় যারা শেয়ারবাজারের সুবিধাভোগী, তারাই নিজেদের দায়ভার পরিচালকদের ওপর চাপিয়ে পার পেতে চান। এতে সরল উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রোগের কারণ ও রোগ ডিটেক্ট না করে ওষুধ প্রয়োগ করলে রোগী সুস্থ না হয়ে আরও বেশি অসুস্থতার দিকে যাবেন এটাই স্বাভাবিক।
বেসরকারিকরণের প্রথম দিকে অনুমোদন দেওয়া ব্যাংকের মূলধন ছিল ৫ কোটি টাকা। পরে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের সময় মূলধন ২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ঝুঁকি নিরসন ও সক্ষমতা অর্জনে ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নকল্পে ব্যাংকের মূলধন ৪০০ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হলেও অনেক ব্যাংকের মূলধন পাঁচশ' থেকে এক হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এক হাজার কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের একটি ব্যাংক পরিচালকের নীতিমালা অনুযায়ী ২০ কোটি টাকার শেয়ার ধারণ করতে হবে, যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। এতে বাজার আবার শেয়ার সংকটে পড়বে, বাজার নিয়ন্ত্রণ পুঁজিপতিদের হাতে চলে যাবে। বাস্তবতা হলো, ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকালে পরিচালকরা যার যার সামর্থ্য ও তৎসময়ের আইন অনুযায়ী শেয়ার ধারণের মাধ্যমে পরিচালক হয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এমন অনেক কোম্পানি রয়েছে যাদের উদ্যোক্তা সংখ্যা ২০ বা ততোধিক, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেকে ২% শেয়ার ধারণ করতে পারলে সম্মিলিত ধারণ ৩০% ছাড়িয়ে যাবে। যেখানে ৩০% শেয়ার ধারণকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে, সেখানে আলাদাভাবে ২% শেয়ার ধারণের যুক্তিকতা কোথায়! এমনিতেই শেয়ারবাজার পতনে অর্থনীতিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, পুনরায় কৃত্রিমভাবে শেয়ারবাজার উত্তরণের পথ খোঁজা হলে বাজার খেলোয়াড়রা আবার সুবিধা নিয়ে সটকে পড়লে, অর্থনীতি সে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সামর্থ্য ফিরে পাবে না। এর দায়ভার কে নেবে? কোনো উদ্যোক্তা যদি সত্যিকার অর্থেই শেয়ারবাজারকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেন, সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে। ঢালাওভাবে সব পরিচালককে এভাবে আইনি বিধিবিধানের মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়ে বাধ্য করা একটি অশুভ প্রক্রিয়া ছাড়া কিছুই নয়। চাপিয়ে দেওয়া আইনের কারণে সৎ ও উপযুক্ত পরিচালকরা তাদের হাতে শেয়ার ক্রয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় পরিচালক থাকার যোগ্যতা হারাবেন। নতুনভাবে পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন ৫% শেয়ারধারী।
একদিকে এক ব্যক্তির হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে না দেওয়া, অন্যদিকে উদ্যোক্তা পরিচালককে ২% শেয়ার ধারণ ও নতুন আগত উদ্যোক্তাদের ৫% শেয়ার ধারণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অতীতে পুঁজিবাজারে শেয়ার স্বল্পতার কথা জানিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জ বাজারের চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত সরকারি-বেসরকারি শেয়ার সরবরাহের আহ্বান জানিয়েছিল। যুক্তি ছিল, শেয়ার স্বল্পতায় বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সে সময় স্টক এক্সচেঞ্জের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকার বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এমনকি বাজার যখন অতিমূল্যায়িত, তখন ব্যাংক-বীমার উদ্যোক্তারাও এসইসির আইনি বাধার কারণে শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। অথচ এখন পরিচালকদের নতুন করে ২% শেয়ার ধারণের কথা বলা হচ্ছে। এতে জোগান কমার কারণে বাজার অতিমূল্যায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের নীতি হচ্ছে মজুদবিরোধী, সেখানে শেয়ার ধারণের কথা বলে মজুদকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টির কারণে বড় মূলধনী কোম্পানি, বিশেষ করে আর্থিক খাত যোগ্য উদ্যোক্তার অভাবে মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। এসইসির এ ধরনের প্রজ্ঞাপনের কারণে আর্থিক খাত ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ প্রসঙ্গে বীমা আইন-২০১০-এর ৭৫ ধারায় যুগপৎভাবে একই ব্যক্তির ব্যাংক-বীমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালক না থাকায় বিষয়টি অবতারণা না করে পারছি না। এতে সরকারের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের আস্থার ঘাটতি দেখা দেবে। সরকারের বেসরকারিকরণ নীতি আহ্বানে, কতিপয় উদ্যমী ও সাহসী উদ্যোক্তা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে যে ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করেছিল, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল, তারা হতাশ ও মর্মাহত। বীমা খাতের উন্নয়নে সরকার বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বীমা খাতের উন্নয়নকল্পে নানাবিধ নতুন নতুন সিদ্ধান্ত ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে দক্ষ ও অভিজ্ঞ উদ্যোক্তারা পরিচালক থাকার যোগ্যতা হারালে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নির্দেশনা পালনে বীমা কোম্পানিগুলো পিছিয়ে পড়বে। কোনো পরিচালক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকার যোগ্যতা হারালে তার স্পন্সরটি উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পরিবারের অন্য কোনো অনভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করতে হবে। স্পন্সরটি তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করার সুযোগ নেই।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে নিযুক্ত হওয়ার বিষয়টি ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের ওপর নির্ভরশীল, বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। বরং সৎ, দক্ষ ও যোগ্য উদ্যোক্তার পরিবর্তে অনভিজ্ঞ ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব অর্পিত হলে এ খাতের উন্নতি ও অগ্রগতি ব্যাহত হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান নিয়ে জানা যায়, ২%-এর কম শেয়ার থাকার কারণে তাদের কিছু পরিচালক যেমন পদ হারাবেন আবার ২% বেশি শেয়ার আছে যারা ব্যাংক ও বীমা উভয় প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালক, তারাও পদ হারাবেন। এতে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালকশূন্য হয়ে পড়তে পারে। আইন করে অভিজ্ঞ পরিচালকদের দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে তা হবে অনভিপ্রেত। আইনটি আগামীতে নতুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা গেলেও পূর্ব থেকে বিদ্যমান পরিচালকদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হবে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। সামগ্রিক বিষয়গুলো অর্থনীতি ধ্বংস ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দেশি-বিদেশি চক্রান্ত কি-না তা গভীরভাবে চিন্তা করার অবকাশ করেছে।
তোফাজ্জল হোসেন : সাবেক চেয়ারম্যান এনসিসি ব্যাংক লিমিটেড ও ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কো. লি.
সময়ের আলোচিত, সমালোচিত শব্দ 'শেয়ারবাজার'। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী জড়িত। এই শেয়ারবাজারেই দেশের অসংখ্য বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অর্থনীতি ও শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে, বিনিয়োগযোগ্য নতুন পুঁজি গঠিত হয়েছে। নানা ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও 'পতন' নামক আরেকটি শব্দের কারণে অর্জনগুলো ব্যাহত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পতন নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী পদক্ষেপ, সংসদে আলোচনা-সমালোচনা, বিনিয়োগকারীদের রাজপথে আন্দোলন, পারিবারিক অশান্তি, আত্মহত্যাসহ নানাবিধ ঘটনা-দুর্ঘটনার শিকার দেশের শেয়ারবাজার। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অদক্ষতা, অপ্রয়োজনীয় সার্কুলার জারি ও প্রত্যাহার, দুর্বল মনিটরিং, ডাইরেক্ট লিস্টিংয়ের নামে বিশেষ বিশেষ কোম্পানিকে সুবিধা প্রদান, ত্রুটিপূর্ণ বুক বিল্ডিং পদ্ধতি, অ্যাসেট রি-ভ্যালুয়েশনে অস্বচ্ছতা, প্লেসমেন্ট শেয়ার বাণিজ্য, ব্যাংকের সঞ্চয়ী ও মেয়াদি আমানতের সুদের হার হ্রাস, নানামুখী গুজব, বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োচিত পদক্ষেপের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বহীনতা, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আইনি সীমার বাইরে বিনিয়োগ, চাহিদা ও জোগানের অসামঞ্জস্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের বাজার থেকে মুনাফা তুলে নেওয়া নানাবিধ কারণ এবং পক্ষ শেয়ারবাজারকে যেভাবে অতিমূল্যায়িত করেছে, তেমনি নিয়ে গেছে পতনের দিকে।
ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি বিদ্যমান। এটাই ব্যবসার ধর্ম। আর এ নিয়মকে মেনেই যে কাউকে ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হয়। শেয়ারবাজার এর ব্যতিক্রম নয়। বিনিয়োগের লাভ যেমন বিনিয়োগকারীর, তেমনি সাময়িক ক্ষতিও বিনিয়োগকারীর। শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় বিনিয়োগে বিভিন্ন কোম্পানির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, শেয়ারের মৌল ভিত্তি ও কোম্পানির আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই বিনিয়োগকারীকে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। নানা উন্নয়ন ও সংস্কার সত্ত্বেও আমাদের দেশের শেয়ারবাজার এখনও উন্নত বিশ্বের শেয়ারবাজারের বিবেচনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে। শক্তিশালী শেয়ারবাজার, বিনিয়োগ নিরাপত্তার জন্য কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন অপরিহার্য ছিল, যেমন_ ১. প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন; ২. নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পূর্ণ স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা; ৩. দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ধারণ; ৪. শেয়ারবাজারের ডি-মিউচুয়ালাইজেশন; ৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা; ৬. বিনিয়োগকারীদের প্রশিক্ষণ। উপরিউক্ত নিয়ামক, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন না ঘটিয়ে রোড শোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে অংশগ্রহণের আহ্বান (যারা শেয়ারবাজার সম্পর্কে খুব কিছু বোঝেন না), দেশব্যাপী ব্রোকারেজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শাখা খোলার অনুমতি প্রদান শেয়ারবাজারকে অতিমূল্যায়িত করতে সহায়তা করেছে।
শেয়ারবাজার যখন চরম আস্থার সংকটে ভুগছে, সরকার বাজার উত্তরণে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে, ঠিক তখনই কিছু দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থান্বেষী মহল শেয়ার কেলেঙ্কারির দায়ভার অন্যের ওপর অর্থাৎ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরিচালকদের শেয়ার ধারণে এসইসি কর্তৃক একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। নির্দেশনাটি পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে কোম্পানির ৩০% শেয়ার ধারণ; প্রত্যেক স্পন্সর পরিচালককে আলাদাভাবে ২% শেয়ার ধারণ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে পাবলিক শেয়ারহোল্ডারদের ২% শেয়ার ধারণে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ চার-পাঁচ বছর আগে এসইসি শেয়ারের কোনো ক্যাটাগরি থাকবে না বলে নির্দেশনা জারি করেছিল। পরিচালকদের ২% শেয়ার ধারণ কোম্পানি আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন, বীমা আইনের কোনো ধারা, উপ-ধারা এমনকি কোম্পানির লাইসেন্সপ্রাপ্তির সময়ও উল্লেখ করা হয়নি। এসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জ প্রজ্ঞাপন জারির আগে বিষয়বস্তু নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা না করায় ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। মূলত নিয়ন্ত্রণ সংস্থার ল্যাপসেস, দুর্বল মনিটরিং ও কতিপয় বাজার খেলোয়াড় যারা শেয়ারবাজারের সুবিধাভোগী, তারাই নিজেদের দায়ভার পরিচালকদের ওপর চাপিয়ে পার পেতে চান। এতে সরল উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রোগের কারণ ও রোগ ডিটেক্ট না করে ওষুধ প্রয়োগ করলে রোগী সুস্থ না হয়ে আরও বেশি অসুস্থতার দিকে যাবেন এটাই স্বাভাবিক।
বেসরকারিকরণের প্রথম দিকে অনুমোদন দেওয়া ব্যাংকের মূলধন ছিল ৫ কোটি টাকা। পরে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের সময় মূলধন ২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ঝুঁকি নিরসন ও সক্ষমতা অর্জনে ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নকল্পে ব্যাংকের মূলধন ৪০০ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হলেও অনেক ব্যাংকের মূলধন পাঁচশ' থেকে এক হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এক হাজার কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের একটি ব্যাংক পরিচালকের নীতিমালা অনুযায়ী ২০ কোটি টাকার শেয়ার ধারণ করতে হবে, যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। এতে বাজার আবার শেয়ার সংকটে পড়বে, বাজার নিয়ন্ত্রণ পুঁজিপতিদের হাতে চলে যাবে। বাস্তবতা হলো, ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকালে পরিচালকরা যার যার সামর্থ্য ও তৎসময়ের আইন অনুযায়ী শেয়ার ধারণের মাধ্যমে পরিচালক হয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এমন অনেক কোম্পানি রয়েছে যাদের উদ্যোক্তা সংখ্যা ২০ বা ততোধিক, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেকে ২% শেয়ার ধারণ করতে পারলে সম্মিলিত ধারণ ৩০% ছাড়িয়ে যাবে। যেখানে ৩০% শেয়ার ধারণকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে, সেখানে আলাদাভাবে ২% শেয়ার ধারণের যুক্তিকতা কোথায়! এমনিতেই শেয়ারবাজার পতনে অর্থনীতিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, পুনরায় কৃত্রিমভাবে শেয়ারবাজার উত্তরণের পথ খোঁজা হলে বাজার খেলোয়াড়রা আবার সুবিধা নিয়ে সটকে পড়লে, অর্থনীতি সে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সামর্থ্য ফিরে পাবে না। এর দায়ভার কে নেবে? কোনো উদ্যোক্তা যদি সত্যিকার অর্থেই শেয়ারবাজারকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেন, সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে। ঢালাওভাবে সব পরিচালককে এভাবে আইনি বিধিবিধানের মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়ে বাধ্য করা একটি অশুভ প্রক্রিয়া ছাড়া কিছুই নয়। চাপিয়ে দেওয়া আইনের কারণে সৎ ও উপযুক্ত পরিচালকরা তাদের হাতে শেয়ার ক্রয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় পরিচালক থাকার যোগ্যতা হারাবেন। নতুনভাবে পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন ৫% শেয়ারধারী।
একদিকে এক ব্যক্তির হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে না দেওয়া, অন্যদিকে উদ্যোক্তা পরিচালককে ২% শেয়ার ধারণ ও নতুন আগত উদ্যোক্তাদের ৫% শেয়ার ধারণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অতীতে পুঁজিবাজারে শেয়ার স্বল্পতার কথা জানিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জ বাজারের চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত সরকারি-বেসরকারি শেয়ার সরবরাহের আহ্বান জানিয়েছিল। যুক্তি ছিল, শেয়ার স্বল্পতায় বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সে সময় স্টক এক্সচেঞ্জের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকার বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এমনকি বাজার যখন অতিমূল্যায়িত, তখন ব্যাংক-বীমার উদ্যোক্তারাও এসইসির আইনি বাধার কারণে শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। অথচ এখন পরিচালকদের নতুন করে ২% শেয়ার ধারণের কথা বলা হচ্ছে। এতে জোগান কমার কারণে বাজার অতিমূল্যায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের নীতি হচ্ছে মজুদবিরোধী, সেখানে শেয়ার ধারণের কথা বলে মজুদকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টির কারণে বড় মূলধনী কোম্পানি, বিশেষ করে আর্থিক খাত যোগ্য উদ্যোক্তার অভাবে মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। এসইসির এ ধরনের প্রজ্ঞাপনের কারণে আর্থিক খাত ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ প্রসঙ্গে বীমা আইন-২০১০-এর ৭৫ ধারায় যুগপৎভাবে একই ব্যক্তির ব্যাংক-বীমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালক না থাকায় বিষয়টি অবতারণা না করে পারছি না। এতে সরকারের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের আস্থার ঘাটতি দেখা দেবে। সরকারের বেসরকারিকরণ নীতি আহ্বানে, কতিপয় উদ্যমী ও সাহসী উদ্যোক্তা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে যে ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করেছিল, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল, তারা হতাশ ও মর্মাহত। বীমা খাতের উন্নয়নে সরকার বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বীমা খাতের উন্নয়নকল্পে নানাবিধ নতুন নতুন সিদ্ধান্ত ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে দক্ষ ও অভিজ্ঞ উদ্যোক্তারা পরিচালক থাকার যোগ্যতা হারালে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নির্দেশনা পালনে বীমা কোম্পানিগুলো পিছিয়ে পড়বে। কোনো পরিচালক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকার যোগ্যতা হারালে তার স্পন্সরটি উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পরিবারের অন্য কোনো অনভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করতে হবে। স্পন্সরটি তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করার সুযোগ নেই।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে নিযুক্ত হওয়ার বিষয়টি ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের ওপর নির্ভরশীল, বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। বরং সৎ, দক্ষ ও যোগ্য উদ্যোক্তার পরিবর্তে অনভিজ্ঞ ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব অর্পিত হলে এ খাতের উন্নতি ও অগ্রগতি ব্যাহত হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান নিয়ে জানা যায়, ২%-এর কম শেয়ার থাকার কারণে তাদের কিছু পরিচালক যেমন পদ হারাবেন আবার ২% বেশি শেয়ার আছে যারা ব্যাংক ও বীমা উভয় প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালক, তারাও পদ হারাবেন। এতে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালকশূন্য হয়ে পড়তে পারে। আইন করে অভিজ্ঞ পরিচালকদের দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে তা হবে অনভিপ্রেত। আইনটি আগামীতে নতুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা গেলেও পূর্ব থেকে বিদ্যমান পরিচালকদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হবে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। সামগ্রিক বিষয়গুলো অর্থনীতি ধ্বংস ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দেশি-বিদেশি চক্রান্ত কি-না তা গভীরভাবে চিন্তা করার অবকাশ করেছে।
তোফাজ্জল হোসেন : সাবেক চেয়ারম্যান এনসিসি ব্যাংক লিমিটেড ও ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কো. লি.
No comments