রবার্ট ফিস্ক-বেইমানি করা হয়েছে? পাকিস্তান বিন লাদেনের অবস্থান জানত

মধ্যপ্রাচ্যে লাখ লাখ আরবের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার আন্দোলনের কাছে যে মধ্যবয়স্ক মানুষটি গুরুত্বহীন, রাজনৈতিক ব্যর্থতায় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে_তিনি গতকাল নিহত হলেন পাকিস্তানে। আর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব পাগল হয়ে উঠল।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাঁর নির্ভেজাল জন্ম-সনদ দেখিয়েই মধ্যরাতে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু-সনদ দেখিয়ে দিলেন।


তিনি নিহত হয়েছেন যে শহরটিতে, ব্রিটিশরাজের এক মেজরের নামে নামকরণ করা হয়েছিল সে শহরটির। আমাদের বলা হয়েছে, মাথায় একটি মাত্র গুলি করা হয়েছে। কিন্তু দেহটি গোপনে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়া এবং একইভাবে গোপনে সাগরে সমাহিত করার বিষয়টি? তাঁর দেহটিকে কোনো প্রার্থনালয়ে না নিয়ে এমন অস্বাভাবিক ও ভীতসন্ত্রস্তভাবে সরিয়ে দেওয়া হলো, যেন তা অনেকটা বিন লাদেন এবং তাঁর ভয়ংকর সংগঠনকে ভয় পাওয়ার মতোই।
অমেরিকানরা উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে পড়ল। ডেভিড ক্যামরুন এটিকে দেখলেন, 'একটি বিশাল এগিয়ে যাওয়া' হিসেবে। ভারত এটাকে বর্ণনা করেছে, 'বিজয়ের মাইলফলক' বলে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, 'তুরুপের পুনঃধ্বনি'। কিন্তু ৯/১১-এ তিন হাজার লোকের মৃত্যুর পর মধ্যপ্রাচ্যে অগণিত মানুষ, বিন লাদেনকে খুঁজতে ১০ বছর এবং ইরাক ও আফগানিস্তানে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু, আসুন আমরা প্রার্থনা করি, যেন এমন পুনঃধ্বনি আমাদের আর শুনতে না হয়। প্রতিশোধমূলক হামলা? হয়তো পশ্চিমা দেশে ছোট রাজনৈতিক দল নিয়ে তারা বের হয়ে আসবে, যাদের সঙ্গে সরাসরি আল-কায়েদার কোনো সম্পর্ক নেই। নিশ্চিত থাকুন, কেউ হয়তো ইতিমধ্যেই শহীদ ওসামা বিন লাদেন ব্রিগেড গঠনের স্বপ্ন দেখছে। হয়তোবা আফগানিস্তানে এবং তা তালেবানদের মধ্যে। কিন্তু গত চার মাসে আরবভূমিতে যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তা প্রমাণ করেছে যে আল-কায়েদা এখন রাজনৈতিকভাবে মৃত। বিন লাদেন বিশ্বকে বলেছিলেন, তিনি আমাকেও ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে মুবারকের মতো, বেন আলীর মতো পশ্চিমঘেঁষা শাসকদের ধ্বংস করতে চান। তিনি একটি নতুন ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু শেষ কয়েক মাসে লাখ লাখ আরব মুসলমান জেগে উঠেছে। তারা শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তা ইসলামের জন্য নয়, বরং মুক্তি, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্য। বিন লাদেন এ শাসকদের উৎখাত করেননি। করেছে জনগণ এবং তারা কোনো খিলাফত চায়নি।
আমি তাঁর সঙ্গে তিনবার সাক্ষাৎ করেছি, কিন্তু একটি প্রশ্ন তাঁর কাছে অজিজ্ঞাসিতই রয়ে গেল_এ বছর খ্রিস্টান ও মুসলমানকে একসঙ্গে ইসলামের পরিবর্তে জাতীয় পতাকার নিচে যে আন্দোলনগুলো ছড়িয়ে দিতে তিনি দেখেছেন তা নিয়ে তিনি কী ভাবছেন?
তাঁর দৃষ্টিতে আল-কায়েদা হলো তাঁর নিজের সৃষ্টি। যে প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের কোনো পরিচয়পত্র বহন করতে হয় না। সকালে উঠে সোজা হেঁটে এলেন আল-কায়েদা হতে চাইলেন এবং হয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর গুহায় কোনো কম্পিউটার ছিল না, বোমা বিস্ফোরণের জন্য কোনো ফোনের ব্যবস্থা ছিল না। যখন আরব একনায়করা আমাদের সমর্থনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসন করেছেন, তখন তাঁরা আমেরিকাকে অভিযুক্ত করাকে এড়িয়ে গেছেন। একমাত্র বিন লাদেন এসব ব্যাপারে কথা বলেছেন। আরবরা কখনো উঁচু ভবনে আঘাত করতে চায়নি। কিন্তু তারা সেই লোকটিকে সমর্থন করেছে, যিনি তাদের মনের কথা বলেছেন। এখন ক্রমান্বয়ে তারা নিজেদের কথা বলতে পারছে। এখন আর তাদের লাদেনকে প্রয়োজন নেই। লাদেন তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু গুহার কথা বলতে বলতে বিন লাদেনের নিহত হওয়ার ঘটনায় পাকিস্তানের ওপর একটি তিক্ত দৃষ্টি এসে পড়েছে। কয়েক মাস ধরে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি আমাদের বলে আসছিলেন, বিন লাদেন আফগানিস্তানের গুহায় বসবাস করছেন। এখন বেরিয়ে এসেছে যে লাদেন পাকিস্তানেই একটি বড় বাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন। বেইমানি? অবশ্যই তাঁর সঙ্গে বেইমানি করা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, নাকি পাকিস্তানের ইন্টারসার্ভিস ইন্টেলিজেন্ট? সম্ভবত দুটোই। পাকিস্তান জানত তিনি কোথায় ছিলেন।
১৮৫৩ সালে মেজর জেমস অ্যাবোটের প্রতিষ্ঠিত শহরটিতে শুধু দেশের মিলিটারি কলেজই রয়েছে তাই নয়, পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় দ্বিতীয় ডিভিশনের সদর দপ্তরও। প্রায় এক বছর আগে আমি আরো একজন 'মোস্ট ওয়ান্টেডম্যান'-এর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গিয়েছিলাম, যাঁকে মুম্বাই ধ্বংসাত্মক ঘটনার পেছনে থাকা দলের নেতা বলে মনে করা হয়। আমি তাঁকে পেয়েছিলাম পাকিস্তানের শহর লাহোরে। তিনি মেশিনগান হাতে দেহরক্ষী বেষ্টিত ছিলেন; যারা আসলে সাদা পোশাকের পাকিস্তানি পুলিশ।
অবশ্যই আরো একটি সুস্পষ্ট প্রশ্নের উত্তর জানা যায়নি; তারা কি লাদেনকে গ্রেফতার করতে পারত না? সিআইএ, নেভি সিলস, স্পেশাল ফোর্স যাই বলুন না কেন, তাদের কি বাঘের ওপর জাল ফেলার সুযোগ ছিল না? বারাক ওবামা লাদেনের নিহত হওয়াকে বলেছেন বিচার। অবশ্যই বহুকালের রীতি অনুসারে বিচারের প্রক্রিয়া হলো আদালত, শুনানি, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, রায়। সাদ্দামের ছেলের মতো বিন লাদেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে তিনি জীবিত ধরা দিতে চাননি। যেখানে তিনি মারা গেছেন সেই রুমে বালতি বালতি রক্ত ছিল।
কিন্তু সে আদালত লাদেনের চেয়ে জনগণকে বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলত। তিনি হয়তো কথা বলতেন সোভিয়েত যুদ্ধের সময় সিআইএ-র সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিয়ে। অথবা কথা বলতেন সৌদি যুবরাজ প্রিন্স তুরকির সঙ্গে পাকিস্তানে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা নিয়ে। ঠিক যেমন সাদ্দাম হোসেনকে ১৫৩ জনকে হত্যার মামলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি বলার সুযোগ পাননি হাজার হাজার কুর্দিকে গ্যাস প্রয়োগ করে হত্যার কথা, যে গ্যাস এসেছিল আমেরিকা থেকে। বলতে পারেননি ১৯৮০ সালে ইরান আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সহায়তা পাওয়ার কথা এবং ডোনাল্ড র‌্যামসফেল্ডের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিনি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের আক্রমণের জন্য মোস্ট ওয়ান্টেড ছিলেন না। তিনি এ স্ট্যাটাস পেয়েছিলেন আফ্রিকায় ইউএস অ্যামবাসিতে আল-কায়েদার হামলা এবং দাহরানে আমেরিকার ব্যারাকে হামলার কারণে। আমি যখন প্রথম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, তিনি তখন সর্বদাই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অপেক্ষা করছিলেন। ২০০১ সালে তিনি তোরাবোরা পাহাড়ের গুহায় মৃত্যুর মুখোমুখি অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তাঁর দেহরক্ষীরা তাঁকে লড়তে দেয়নি এবং বাধ্য করেছে হেঁটে পাহাড় টপকে পাকিস্তানে চলে যেতে। তিনি করাচিতে কিছু সময় কাটিয়েছেন। করাচির ওপর তাঁর এক ধরনের দুর্বলতা ছিল। বিস্ময়করভাবে তিনি আমাকে পাকিস্তানের আগের রাজধানী করাচির দেয়ালে তাঁর সমর্থনে যে গ্রাফিটি হয়েছে তার ছবি দিয়েছিলেন। তিনি শহরের ইমামদের প্রশংসা করেছেন।
অন্য মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি ছিল রহস্যপূর্ণ। আমি প্রথম যখন আফগান্তিানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, তখন তিনি তাঁর ক্যাম্প থেকে আমাকে তালেবানদের ভয়ে রাতে জালালাবাদে যেতে দিতে চাননি। পরের দিন তিনি আল-কায়েদার এক লেফটেন্যান্টকে আমার সঙ্গে দেহরক্ষী হিসেবে দেন। তাঁর দল শিয়াদের ভয়ানকভাবে ঘৃণা করে এবং একনায়কদের নাস্তিক বলে মনে করে। যদিও তিনি আমেরিকার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সাবেক ইরাকে সাবেক বাথ পার্টিকে সহায়তা করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি হামাসকে কখনো ভালো বলতেন না। ২০০১ সালে আমি এক ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করতাম লাদেনের সঙ্গে। একবার তাঁর এক বিশ্বস্ত আল-কায়েদা সহযোগীর সঙ্গে পাকিস্তানের একটি গোপন অবস্থানে সাক্ষাৎ করেছি।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লকে অপহরণের পর আমি ইনডিপেনডেন্টে দীর্ঘ আর্টিকেল লিখে আবেদন জানিয়েছি তাঁকে রক্ষা করার। ২০০১ সালের আফগান সীমান্তে যখন আমাকে পিটিয়ে আহত করা হয় তখন পার্ল এবং তাঁর স্ত্রী আমার দেখাশোনা করেছিলেন। অনেক পরে আমি জানতে পেরেছিলাম, বিন লাদেন আমার লেখাটি পড়ে দুঃখ পেয়েছিলেন। কারণ পার্লকে ইতিমধ্যে হত্যা করা হয়েছে।
বিন লাদেনের নিজের বিশ্বাস তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এক স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে গেছেন, দুই স্ত্রী রবিবারের আমেরিকার হামলায় নিহত হয়েছেন। ১৯৯৪ সালের আফগানিস্তানে তাঁর এক ছেলে ওমরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। অত্যন্ত সুঠাম দেহের ছোট ছেলেটি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে সুখী কি না। সে ইংরেজিতে জবাব দিয়েছিল, হ্যাঁ। কিন্তু গত বছর তাঁর একটি বই প্রকাশ হয়েছে লিভিং বিন লাদেন। বইতে সে বর্ণনা করেছে কিভাবে তাঁর বাবা তার (ওমরের) আদরের কুকুরকে হত্যা করেছে রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য। বইতে ওসামা বিন লাদেনকে সে এভিলম্যান বলে আখ্যায়িত করেছে।
গতকাল আমি আরব থেকে তিনটি টেলিফোন কল পেয়েছি। তাঁরা সবাই বিশ্বাস করেন, লাদেনের ডামি, এটি লাদেন নয়। ঠিক যেমন অনেক ইরাকি এখনো বিশ্বাস করে যে সাদ্দাম হোসেনের ছেলেরা নিহত হয়নি, এমনকি প্রকৃত সাদ্দামেরও ফাঁসি হয়নি। যদি আমরা ভুল করে থাকি, যদি সত্যিই লাদেনের ডামি হয় এবং পরবর্তী সময়ে লাদেনের কোনো ভিডিও বের হয়ে আসে তাহলে বারাক ওবামাকে পরের নির্বাচনে হারতে হবে।
লেখক : ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি, ইনডিপেনডেন্ট থেকে
ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.