লাদেন নিহত- প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘোষণা

শুভ সন্ধ্যা। আজ এই সন্ধ্যায় আমি আমেরিকার জনগণ এবং বিশ্বকে জানাতে পারছি যে, যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত এক অভিযানে হাজার হাজার নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশু হত্যার জন্য দায়ী আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে।


প্রায় ১০ বছর আগে আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার মাধ্যমে সেপ্টেম্বর মাসের এক উজ্জ্বল দিনকে অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছিল। ৯/১১-এর সেই ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে এক বেদনাময় স্মৃতি হয়ে আছে। সেপ্টেম্বরের নির্মেঘ আকাশ চিড়ে আসা ছিনতাই করা বিমানগুলো টুইন টাওয়ারকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়, পেন্টাগন-পেনসিলভানিয়ার শাংকসভিলে ফ্লাইট-৯৩-এর ধ্বংসাবশেষ থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। সেখানে সাহসী নাগরিকদের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ আরো ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞকে প্রতিরোধ করে। এর পরও আমরা জানি, সেই ঘটনার পেছনের অনেক কাহিনী পৃথিবীর মানুষের কাছে অজানা। কারো ডিনারের টেবিলের আসন খালি, শিশুরা মা-বাবার সানি্নধ্য ছাড়া বেড়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে, অনেক মা-বাবা কখনো জানতে পারবে না, শিশুকে জড়িয়ে ধরার অনুভূতি কী। আমাদের বুকের মাঝখানে ক্ষত তৈরি করে দিয়ে তিন হাজার নাগরিককে সেদিন কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
২০০১ সালে আমাদের সেই দুঃখ ভারাক্রান্ত সময়ে আমেরিকার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, আহতদের নিজ শরীরের রক্ত দিয়েছি। আমাদের পরস্পরের প্রতি দৃঢ় সংহতির কথা, দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসার কথা ঘোষণা করেছি। কে কোথা থেকে এসেছি, কে কোন ঈশ্বরের আরাধনা করি, কে কোন সম্প্রদায়ের লোক_সবকিছু ভুলে গিয়ে ওইদিন আমরা এক আমেরিকার পরিবার হিসেবে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। এই ভয়ানক পাপিষ্ঠ আক্রমণ যারা করেছে, তাদের বিচারের প্রশ্নে এবং জাতির নিরাপত্তার প্রশ্নে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। আমরা দ্রুত জানতে পেরেছিলাম, এই হামলা ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন আল-কায়েদা দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এই সংগঠন খোলাখুলিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বে নিরীহ জনগণকে হত্যা করতে আত্মনিয়োগ করে। সুতরাং আমরা দেশের নাগরিকদের, আমাদের বন্ধুদের এবং আমাদের জোটকে নিরাপদ করার জন্য আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হই।
আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমী সেনাবাহিনী এবং সন্ত্রাসবিরোধী পেশাজীবীদের ধন্যবাদ। গত ১০ বছরে আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আমরা অনেক সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধ করেছি এবং নিজেদের প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করেছি। আফগানিস্তান থেকে আমরা তালেবান সরকারকে উৎখাত করেছি, যারা ওসামা বিন লাদেন এবং আল-কায়েদাকে সমর্থন দিয়ে দেশটিকে তাদের জন্য নিরাপদ স্বর্গভূমি করে দিয়েছিল। আমরা সারা বিশ্বে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র এবং জোটরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কাজ করেছি ৯/১১-এর ঘটনার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতদেরসহ আল-কায়েদা সন্ত্রাসীদের হত্যা অথবা গ্রেপ্তার করতে।
এর পরও ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানের সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে গ্রেপ্তার এড়িয়েছিল। অন্যদিকে, আল-কায়েদা সীমান্ত থেকে তাদের অপারেশন অব্যাহত রেখেছে; এবং সারা বিশ্বে তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে অপারেশন চালিয়েছে। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর সিআইএর পরিচালক লিয়ন প্যানেটাকে নির্দেশ দিয়েছি আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা অথবা গ্রেপ্তারকে অগ্রাধিকার দিতে। সেই সঙ্গে তাদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা, পরাস্ত করা এবং বাধা প্রদান করা ব্যাপকভাবে অব্যাহত রাখতে।
আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাড়ভাঙা খাটুনির পর গত আগস্ট মাসে আমাকে ওসামা বিন লাদেনের সম্ভাব্য অবস্থানের কথা জানানো হয়। কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কয়েক মাস সময় লেগেছে সুতা টেনে মাটিতে নামাতে। আমরা যখন ওসামা বিন লাদেনের পাকিস্তানের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনার তথ্যগুলো জানতে পারছিলাম, তখন আমি কয়েকবার জাতীয় নিরাপত্তা দলের সঙ্গে আলোচনা করি। অবশেষে গত সপ্তাহে আমি নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পেঁৗছি, ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার মতো যথেষ্ট গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। এবং একটি অপারেশন চালিয়ে তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় আনার অনুমতি দেই।
আজ আমার নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে একটি অপারেশন চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ছোট কিন্তু অসাধারণ সাহসী ও দক্ষ দল এই অপারেশনে অংশ নেয়। এতে কোনো আমেরিকান নাগরিকের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তারা বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত না হওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক ছিল। একটি বন্দুকযুদ্ধের পর সেনারা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে এবং তাঁর দেহ নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয়।
বিগত দুই দশক ধরে বিন লাদেন ছিলেন আল-কায়েদার নেতা এবং প্রতীক। তিনি অব্যাহতভাবে আমাদের ওপর, আমাদের বন্ধুদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছেন। বিন লাদেনের মৃত্যু আল-কায়েদাকে পরাজিত করার আমাদের প্রচেষ্টার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এর পরও তাঁর মৃত্যুতে আমাদের প্রচেষ্টা শেষ হয়ে যায়নি। কোনো সন্দেহ নেই, আল-কায়েদা আমাদের ওপর হামলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। অবশ্যই আমাদের দেশের ভেতরে এবং বাইরে সদা সতর্ক থাকতে হবে। আমরা আবার নিশ্চিত করে বলতে চাই, বরাবরের মতোই আমেরিকা কখনোই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে না। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ৯/১১-এর ঘটনার পর যেমন বলেছিলেন, আমাদের যুদ্ধ আমেরিকার বিরুদ্ধে নয়, সেটাই আমি পরিষ্কার করতে চাই। কারণ, বিন লাদেন কখনোই মুসলমানদের নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন ব্যাপক মুসলিম হত্যাকারী। সত্যিকার অর্থেই আমাদের জনগণের পাশাপাশি আল-কায়েদা দেশে দেশে অসংখ্য মুসলমান হত্যা করেছে। সুতরাং যারা শান্তি এবং মানবতায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের বিন লাদেনের অবসানকে স্বাগত জানানো উচিত।
কয়েক বছর ধরে আমি বার বার স্পষ্টভাবে বলেছি, লাদেন কোথায় আছেন, তা জানতে পারলে আমরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পদক্ষেপ নেব। আমরা সেটাই করেছি। কিন্তু এটা উল্লেখ করা জরুরি, পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা ওসামা বিন লাদেন পর্যন্ত এবং যেখানে তিনি লুকিয়ে ছিলেন, সেখানে পেঁৗছতে আমাদের সহায়তা করেছে। বিন লাদেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন; এবং পাকিস্তানের জনগণকে হত্যারও নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আজ রাতে আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জারদারিকে ফোন করেছি। আমার প্রতিনিধিরাও তাঁদের পাকিস্তানি কাউন্টারপার্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা সবাই সম্মত হয়েছেন যে, এটা আমাদের দুই জাতির জন্যই একটি ইতিবাচক এবং ঐতিহাসিক দিন। সামনের দিনগুলোতে আল-কায়েদা এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও পাকিস্তানের অংশগ্রহণ জরুরি।
এই যুদ্ধ আমেরিকার জনগণ ইচ্ছা করে ঘাড়ে নেয়নি। এই যুদ্ধ আমাদের কূলে এসে ভিড়েছিল এবং কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো আমাদের নাগরিকদের হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। ১০ বছরের ত্যাগ, সংগ্রাম এবং সার্ভিসের মধ্য দিয়ে আমরা জানি, এই যুদ্ধে কতটা ক্ষতি হয়েছে। এর ভার আমাকে প্রতিটি সময় বহন করতে হয়েছে, যখন কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে কারো পরিবারের কাছে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষর করেছি অথবা একজন আহত সেনার চোখের দিকে তাকিয়েছি।
তাই আমেরিকানরা যুদ্ধের মর্ম বোঝে। এর পরও জাতি হিসেবে আমরা কখনোই আমাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিকে বরদাশত করব না। আমাদের নাগরিকদের হত্যা করা হলে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব না। দেশবাসীর, আমাদের বন্ধুদের এবং জোটের প্রতিরক্ষায় আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমরা আমাদের মূল্যবোধের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান থাকব।
আজ রাতের মতো একটি রাতে যারা আল-কায়েদার হাতে স্বজন হারিয়েছে, সেসব পরিবারকে আমরা বলতে পারি_বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আজ রাতে আমরা কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এবং সন্ত্রাসবিরোধী প্রফেশনালদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি, যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এই ফলাফল অর্জন করেছেন। আমেরিকার জনগণ হয়তো তাদের নাম জানে না, তাদের কাজ দেখেনি, কিন্তু তাঁরা তাঁদের কাজের সন্তুষ্টিকে অনুভব করছেন। ন্যায়বিচারের জন্য তাঁদের শ্রমের ফলকে অনুভব করছেন।
যাঁরা অসীম সাহসিকতার-দেশপ্রেমের-পেশাদারিত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করে এই অপারেশন চালিয়েছেন, তাঁদের আমরা অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সেপ্টেম্বরের ওই দিনটির ভারী বোঝা যে প্রজন্ম বয়ে চলেছে, তাদেরই অংশ এঁরা।
৯/১১-এর ঘটনায় স্বজন হারানো পরিবারগুলোকে বলছি, আমরা কখনোই আপনাদের ক্ষয়ক্ষতির কথা ভুলিনি। আরো একটি আক্রমণ প্রতিহত করতে যে প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন, তা থেকে আমরা কখনোই বিচ্যুত হইনি।
আজ রাতে ৯/১১-এর ঘটনার পর আমাদের যে ঐক্য চেতনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা স্মরণ করতে হয়। আমি জানি, এটি একটি শাসরুদ্ধকর অবস্থা। এর পরও এই অর্জন আমেরিকার জনগণের দৃঢ়তার এবং মহানুভবতার স্বাক্ষর। আমেরিকার নিরাপত্তার কাজ শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু আজ রাতে আমরা আবার বলব, আমরা যেটা করব বলে মনি করি, আমেরিকা তা করতে পারে। এটাই আমাদের ইতিহাসের কথা। সেটা হোক জনগণের অগ্রগতির প্রশ্নে অথবা নাগরিকদের সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অথবা বাইরের দেশগুলোতে আমাদের মূল্যবোধের অবস্থানের প্রশ্নে বা পৃথিবীকে নিরাপদ স্থান করার ক্ষেত্রে ত্যাগের প্রশ্নে। আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এ কাজ আমরা কেবল সম্পদ ও ক্ষমতার কারণে করিনি। বরং আমরা তা করেছি এ কারণে যে, আমরা ঈশ্বরের অধীন একটি জাতি, যা অখণ্ডনীয়, যেখানে সবার জন্য স্বাধীনতা ও বিচার নিশ্চিত হবে।
ধন্যবাদ।
ঈশ্বর আপনাদের সহায় হোক, ঈশ্বর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সহায় হোক।

১ মে ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রদত্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষণ : কালের কণ্ঠের পাঠকদের জন্য বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.