মৃদুকন্ঠ-সংস্কৃতিই সংহতির ধারক by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
পহেলা বৈশাখ ঢাকার রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল প্রতিবছরের মতো এবারও। গ্রামগঞ্জে যেন উৎসবের জোয়ার এসেছিল। সমগ্র বাঙালি জাতি যেন এক প্রাণ, যেমনটা দেখেছিলাম একাত্তরে। একাত্তর বুঝি প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ নববর্ষের উৎসবে যোগ দিতে ছুটে আসে বাংলাদেশে।
ছুটে বেড়ায় জনবহুল নগর-শহর থেকে ধন-ধান্য-পুষ্পে ভরা বাংলার গ্রামগঞ্জে, মাঠে-ঘাটে, হাওর-বাঁওড়ে, ক্ষেত-খামারে পথে-প্রান্তরে_ সর্বত্র। স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্যের জন্য বাঙালি জাতি একাট্টা হয়েছিল একাত্তরে। আপন পরিচিতির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির ঐকতানে বাঙালি জাতির দৃঢ় একাত্মতা ফুটে ওঠে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ।
বৈশাখ আসে এপ্রিল মাসে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করেছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। অপেক্ষা ছিল শুধু পহেলা বৈশাখের। নববর্ষ এল একাত্তরের ১৪ এপ্রিল। মাত্র তিন দিন পর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতির স্বাধীনতার রক্ষার সংগ্রাম পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন বাঙালির ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাঁর সুযোগ্য সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন অকুতোভয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হলো। যুদ্ধের সৈনিক ছিলেন দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক তথা আমজনতা। এটা কোনো সিপাহির যুদ্ধ ছিল না। ছিল জনযুদ্ধ। বাঙালি সেনারাও যোগ দিয়েছিল এই গৌরবময় জনযুদ্ধে। ৯ মাসের জনযুদ্ধে বাঙালি নর-নারী অরক্ষিত ছিল। পাকিস্তানি সেনা আর তাদের রাজাকার দোসররা হত্যা-লুণ্ঠন চালিয়েছিল। কিন্তু সাধারণ চোর-ডাকাতরা এই ৯ মাস চুরি-ডাকাতি করেনি। অরক্ষিত বাড়িতেও ঢোকেনি। অভূতপূর্ব একতা, সহমর্মিতা। বাঙালি জাতি এক মন, এক প্রাণ।
পহেলা বৈশাখ এলেই মনে পড়ে যায় একাত্তর। একাত্তরে অবশ্য ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পহেলা বৈশাখে কেউ ডাক দেয় না। বিশ্বকবি বরং বৈশাখকে ডাক দিয়েছিলেন, স্বাগত জানিয়েছিলেন_'এসো বৈশাখ, এসো এসো।' বৈশাখের আগমনী বার্তাই বুঝি বাঙালির ঐক্যের ডাক। বাঙালির নববর্ষের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মধ্যরাতের অন্ধকারে সে আসে না। কারো নিদ্রা কেড়ে নেয় না। সূর্যের প্রথম হাসির ঝলকের সঙ্গে সঙ্গে নববর্ষের আগমন। ঊষার স্নিগ্ধ আলোকছটায় বাঙালির হৃদয়কে আলোকিত করে আমোদিত করে আগমন করে নববর্ষ। তাই তো রমনার বটমূলে নতুন সূর্যোদয়লগ্নে একটা সাদামাটা সংগীতানুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। অনুষ্ঠান উপলক্ষ মাত্র। সৌহার্দ্য, ভালোবাসা, আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ভাগাভাগি করে নেওয়াই লক্ষ্য। সংগীতের সুরধারায় বৈশাখ যেন লক্ষ-কোটি বাঙালির হৃদয়কে গেঁথে রেখেছে এক লয়ে। এক মাত্রায়। এক সুরধ্বনিতে।
বৈশাখের উৎসবে কেউ ডাক দেয় না। কোনো নেতা ডাক দেন না। কোনো নেতা আহ্বান জানান না। তবু বাঙালির হৃদয়তন্ত্রীতে একসঙ্গে সুর বেজে ওঠে। সবাই ছুটে আসে রাস্তায়। ঘরে তালা ঝুলিয়ে পুরো পরিবার নেমে পড়ে রাস্তায়। শিশুসন্তান একটা বাবার কাঁধে, অন্যটা মায়ের কোলে। পথ চলতে চলতে অচেনা শিল্পীর কাছে গালের মাঝখানটায় এঁকে নিচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা। অথবা নববর্ষের শুভেচ্ছা। অথবা শৈল্পিক কোনো অভিব্যক্তি। সারা বছর গাড়ি আর রিকশার ভিড়ে মানুষ পথ চলতে পারে না। পহেলা বৈশাখে মানুষের ভিড়ে গাড়ির চাক্কা জাম। পথচারীর পদচারণে রিকশা-স্কুটারও পালিয়ে গেছে। রাস্তা জনতার দখলে। কিন্তু মারামারি নেই। হানাহানি নেই। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া নেই। রয়েছে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়। প্রীতিময় আচরণ। পহেলা বৈশাখে জাতির বিভক্তির সামান্যতম চিহ্নও চোখে পড়ে না। তারপর সারা বছর জাতিকে কুরে কুরে খায় বিভক্তির অভিযোগ। বিভক্তির আওয়াজ প্রকট হয়ে ওঠে রাজনীতির অঙ্গনে। সম্পদ লুণ্ঠনে বিভক্তি নেই। চোরাচালানিতে বিভক্তি নেই। ঋণখেলাপে বিভক্তি নেই। যত বিভক্তি রাজনীতিতে। কেন এমনটা হলো? কোন বিষয়কে নিয়ে এমনটা হলো?
মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজ দেশে ফিরে গেল। কিন্তু তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস তো বাংলাদেশেই রয়ে গেল। জামায়াত-মুসলিম লীগাররাও রয়ে গেল এ দেশে। অবশ্য পরাজিত দোসরদের নেতারা পালিয়ে রইল পাকিস্তানে, আরব দেশ ও বিলেতে। তাদের একসূত্রে গেঁথে রাখল পাকিস্তান। বিশেষ করে ভুট্টো। আইএসআই তাদের সক্রিয় সহযোগিতায় নিয়োজিত হলো। কূটনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করল পাকিস্তান, সৌদি আরব ও চীন। অল্প কয়েকজন দেশদ্রোহী বাংলাদেশি এভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠল এবং লন্ডনে বসে 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি' গঠন করল। এই হলো বিভক্তির শুরুর কথা। এটা জাতীয় বিভক্তি নয়। জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র মাত্র। ষড়যন্ত্রটা সফল হলো ১৯৭৫ সালে। জনগণের ইচ্ছায় নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেও নয়। অস্ত্র ও অর্থ দ্বারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে। হত্যার মাধ্যমে। একাত্তরে ওই মহল কর্তৃক সম্পাদিত গণহত্যার আদলে। বাঙালির ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। প্রবাসী সরকার পরিচালনাকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজনকে জেলখানায় হত্যা করা হলো। মুক্তিযোদ্ধা নেতা-জনতাকে ধরে ধরে জেলে পোরা হলো। একাত্তরের হন্তা-লুণ্ঠনকারী অপরাধীদের জেল থেকে মুক্ত করে দালালিতে নিযুক্ত করা হলো। একাত্তরের দালালরা হলো পঁচাত্তরের দালাল। পালিয়ে থাকা দেশদ্রোহী গোলাম আযম গংদের দেশে ফিরিয়ে পুনর্বাসিত করা হলো। স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হলো। এই হলো দেশদ্রোহী মুষ্টিমেয় কয়েকজনের রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের ইতিহাস। বিভক্তি সৃষ্টির পূর্ব কথা।
যাঁর বজ্রকণ্ঠ শুনে মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হতেন, যাঁর স্থান ছিল প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায়, যাঁর জন্য একাত্তরে মুমিন বাঙালিরা সর্বক্ষণ দোয়া করতেন, রোজা রাখতেন, অন্য ধর্মীয়রা নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বিধাতার কাছে ভিক্ষা চাইতেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ হলো! মার্শাল ল আর সন্ত্রাসী অস্ত্রের ভয়ে সন্ত্রস্ত করে রাখা হতো জনপদ। প্রচার করা হতো 'নতুন বাংলাদেশ' তথা বাংলাস্থানের কথা। বিদেশি অর্থ-অস্ত্র-কূটনীতির মদদে পরিচালিত দেশদ্রোহীরা জবর দখলের শাসন চালিয়েছিল অনেক বছর। রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে দেশদ্রোহী গোষ্ঠীটি ক্ষমতার চলমানতা রক্ষা করেছিল। নির্বাচন ম্যানিপুলেট করে 'গণতান্ত্রিক' লেবাসে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছিল। স্কুলের ছেলেমেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বদলে তথাকথিত 'নতুন বাংলাদেশের' বিকৃত কল্পকাহিনী শেখানো হতো। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাস লালন করা হতো। এভাবেই জাতির বিভক্তি রেখাকে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা চলেছিল। এটা যে পাকিস্তানে প্রণীত এবং পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত ষড়যন্ত্র এবং স্বল্পসংখ্যক দেশদ্রোহী বাংলাদেশি (বাঙালি নয়) যে এর তল্পীবাহক, তার পরিষ্কার প্রমাণ রয়েছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, (যদিও পাবলিক মেমোরি খুব শর্ট), পঁচাত্তরের পর বহুকাল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী' কথাটি উচ্চারিত হতো না। বলা হতো পাকিস্তান নাকি ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, বাংলাদেশের কাছে নয়! অথচ আমরা কালের সাক্ষী যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে 'বাংলা-ভারত যৌথ বাহিনী'র কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা।
আরো একটি ছোট্ট ঘটনা প্রাসঙ্গিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল, হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল একটি লেখার জন্য। লেখাটির নাম 'পাক ছার জমিন শাদবাদ'। প্রকাশিত হয়েছিল ইত্তেফাক পত্রিকায়। শিরোনামের শব্দগুলো পাকিস্তানি জাতীয় সংগীতের প্রথম লাইন। লেখাটাতে ব্যঙ্গ ছিল। ক্ষুব্ধ হয়েছিল পাকিস্তান। তাই পাকিস্তানি এজেন্টরাই সন্ত্রাস করেছিল। একটানা ২০ বছর ছদ্মবেশী পাকিস্তানি শাসনে এবং ২০০১ সালের পর জামায়াতি সংশ্লেষে অনেকটা সরাসরি দেশদ্রোহীদের অপশাসনের দেশে বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ বিভক্তি কিন্তু ক্ষমতাসীনদের। জনতার নয়। জনতা বিভক্ত হয়নি। প্রমাণ ২০০৮ সালের নির্বাচন। সত্তরের নির্বাচনের মতো। অর্থ দাঁড়ায়, সত্তরের জনতা আর ২০০৮ সালের জনতা, একই মতাবলম্বী। এদের মধ্যে বিভেদ নেই। মতান্তর নেই। শাসনক্ষমতায় জনতার অংশগ্রহণ বাড়লেই বিভক্তি হ্রাস পেতে পেতে লোপ পাবে। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে এবং ৯০ শতাংশ লোক অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা পেলে বছর দশকের মধ্যে জনসক্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। নারীনীতি বাস্তবায়িত হলে, নারীর ক্ষমতায়ন হলে জনসক্রিয়তা আরো বাড়বে। শর্ত একটাই, এ সময়টাতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ সরকার থাকতে হবে। দেশদ্রোহীরা ছদ্মবেশে ক্ষমতায় প্রবেশ করতে পারে না।
গণ-ঐক্য দৃশ্যমান সংস্কৃতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। পহেলা বৈশাখ সেই ইঙ্গিতই পুনর্বার দিয়ে গেল। এ জন্য একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। নাগরিক সমাজ ও সরকার সম্মিলিতভাবে এ আন্দোলনটি পরিচালনা করতে পারে। প্রথম পর্যায়ে কয়েকটি পদক্ষেপ বিবেচনাযোগ্য। প্রতিটি শিক্ষালয়ে (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইংরেজি ও অন্যান্য) আবৃত্তি ও সংগীতচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য একটি সিডি প্লেয়ার, হারমোনিয়াম ও তবলার জন্য বরাদ্দ দিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের সময় সংগীত জানা প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিটি স্কুলে অন্তত একজন গানের শিক্ষক থাকার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। তিনি শুধু সংগীতশিক্ষক হবেন না, গণিত, বাংলা বা যেকোনো বিষয়ের শিক্ষক হয়েও গান শেখানোর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন। তবে প্রথাগত গান শেখানোর দরকার নেই। চর্চা হবে শুধু মুক্তিযুদ্ধের গান, দেশাত্মবোধক গান, একুশের গান, মরমি বাংলা গান প্রভৃতি। বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ হতে পারে রবীন্দ্র-নজরুলগীতি। আবৃত্তিতে থাকতে পারে দেশাত্মবোধক ছড়া, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা প্রভৃতি। সপ্তাহে এক দিন হাফ-ডে ক্লাস করে, বাকি অর্ধদিবসে আবৃত্তি-সংগীতচর্চার জন্য রুটিনে নির্ধারিত রাখা যায়। প্রত্যেক শিক্ষালয়ে সরকার কয়েকটি সিডি-ক্যাসেট দান করবে, যার মধ্যে থাকবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের গান, জাগরণের গান, স্বদেশের গান, নৈতিকতার গান, গ্রামবাংলার গান। এ গানগুলো শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বিনোদন ও চরিত্র গঠনে সহায়ক হবে। ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা হবে। সম্ভব হলে ফিচার ফিল্ম দেখানো হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাব, সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মরত সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আর্থিক সহায়তা দেবে। এটি শিল্পকলা একাডেমীর মাধ্যমেও দেওয়া যেতে পারে। তৃতীয় প্রস্তাব, গ্রামগঞ্জে স্থানীয়ভাবে সুপরিচিত কবিয়ালদের প্রত্যেককে মাসিক সম্মানী দিতে হবে। সম্মানীর বিনিময়ে তাঁরা ঘুরে ঘুরে বিকেলে-সন্ধ্যায় গান শোনাবেন। নিজেরাই গান তৈরি করবেন। তবে গানগুলো হবে মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় শহীদদের নিয়ে, জাতীয় পর্যায়ের যোদ্ধাদের (তাজউদ্দীন, নজরুল, ভাসানী প্রমুখ) নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। ১৫ আগস্ট কারবালার শোকগাথার মতো করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বপ্নকে নিয়ে। আবহমান বাংলাকে নিয়ে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ কাজগুলো করলে দরিদ্র সাংস্কৃতিককর্মী, কবিয়াল, নাট্যদলগুলো বিকাশ লাভ করতে পারে। নিরানন্দ গ্রামীণ জীবনে আনন্দের ছোঁয়া লাগতে পারে। সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে জনতার ঐক্য শুধু দৃঢ়তা পাবে না, দৃশ্যমানও হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি যেমন জেগে উঠেছিল, সংস্কৃতির মাঝে বাঙালি আবার তার আত্মপরিচয় খুঁজে পাবে, প্রত্যয়ী হয়ে উঠবে। বিভক্তি কেটে যাবে। সংহতি সংহত হবে। সংস্কৃতি হয়ে উঠুক সংহতির হাতিয়ার। গর্জে উঠুক মুক্তিযুদ্ধের মতো আরেকবার।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
বৈশাখ আসে এপ্রিল মাসে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করেছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। অপেক্ষা ছিল শুধু পহেলা বৈশাখের। নববর্ষ এল একাত্তরের ১৪ এপ্রিল। মাত্র তিন দিন পর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতির স্বাধীনতার রক্ষার সংগ্রাম পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন বাঙালির ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাঁর সুযোগ্য সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন অকুতোভয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হলো। যুদ্ধের সৈনিক ছিলেন দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক তথা আমজনতা। এটা কোনো সিপাহির যুদ্ধ ছিল না। ছিল জনযুদ্ধ। বাঙালি সেনারাও যোগ দিয়েছিল এই গৌরবময় জনযুদ্ধে। ৯ মাসের জনযুদ্ধে বাঙালি নর-নারী অরক্ষিত ছিল। পাকিস্তানি সেনা আর তাদের রাজাকার দোসররা হত্যা-লুণ্ঠন চালিয়েছিল। কিন্তু সাধারণ চোর-ডাকাতরা এই ৯ মাস চুরি-ডাকাতি করেনি। অরক্ষিত বাড়িতেও ঢোকেনি। অভূতপূর্ব একতা, সহমর্মিতা। বাঙালি জাতি এক মন, এক প্রাণ।
পহেলা বৈশাখ এলেই মনে পড়ে যায় একাত্তর। একাত্তরে অবশ্য ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পহেলা বৈশাখে কেউ ডাক দেয় না। বিশ্বকবি বরং বৈশাখকে ডাক দিয়েছিলেন, স্বাগত জানিয়েছিলেন_'এসো বৈশাখ, এসো এসো।' বৈশাখের আগমনী বার্তাই বুঝি বাঙালির ঐক্যের ডাক। বাঙালির নববর্ষের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মধ্যরাতের অন্ধকারে সে আসে না। কারো নিদ্রা কেড়ে নেয় না। সূর্যের প্রথম হাসির ঝলকের সঙ্গে সঙ্গে নববর্ষের আগমন। ঊষার স্নিগ্ধ আলোকছটায় বাঙালির হৃদয়কে আলোকিত করে আমোদিত করে আগমন করে নববর্ষ। তাই তো রমনার বটমূলে নতুন সূর্যোদয়লগ্নে একটা সাদামাটা সংগীতানুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। অনুষ্ঠান উপলক্ষ মাত্র। সৌহার্দ্য, ভালোবাসা, আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ভাগাভাগি করে নেওয়াই লক্ষ্য। সংগীতের সুরধারায় বৈশাখ যেন লক্ষ-কোটি বাঙালির হৃদয়কে গেঁথে রেখেছে এক লয়ে। এক মাত্রায়। এক সুরধ্বনিতে।
বৈশাখের উৎসবে কেউ ডাক দেয় না। কোনো নেতা ডাক দেন না। কোনো নেতা আহ্বান জানান না। তবু বাঙালির হৃদয়তন্ত্রীতে একসঙ্গে সুর বেজে ওঠে। সবাই ছুটে আসে রাস্তায়। ঘরে তালা ঝুলিয়ে পুরো পরিবার নেমে পড়ে রাস্তায়। শিশুসন্তান একটা বাবার কাঁধে, অন্যটা মায়ের কোলে। পথ চলতে চলতে অচেনা শিল্পীর কাছে গালের মাঝখানটায় এঁকে নিচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা। অথবা নববর্ষের শুভেচ্ছা। অথবা শৈল্পিক কোনো অভিব্যক্তি। সারা বছর গাড়ি আর রিকশার ভিড়ে মানুষ পথ চলতে পারে না। পহেলা বৈশাখে মানুষের ভিড়ে গাড়ির চাক্কা জাম। পথচারীর পদচারণে রিকশা-স্কুটারও পালিয়ে গেছে। রাস্তা জনতার দখলে। কিন্তু মারামারি নেই। হানাহানি নেই। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া নেই। রয়েছে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়। প্রীতিময় আচরণ। পহেলা বৈশাখে জাতির বিভক্তির সামান্যতম চিহ্নও চোখে পড়ে না। তারপর সারা বছর জাতিকে কুরে কুরে খায় বিভক্তির অভিযোগ। বিভক্তির আওয়াজ প্রকট হয়ে ওঠে রাজনীতির অঙ্গনে। সম্পদ লুণ্ঠনে বিভক্তি নেই। চোরাচালানিতে বিভক্তি নেই। ঋণখেলাপে বিভক্তি নেই। যত বিভক্তি রাজনীতিতে। কেন এমনটা হলো? কোন বিষয়কে নিয়ে এমনটা হলো?
মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজ দেশে ফিরে গেল। কিন্তু তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস তো বাংলাদেশেই রয়ে গেল। জামায়াত-মুসলিম লীগাররাও রয়ে গেল এ দেশে। অবশ্য পরাজিত দোসরদের নেতারা পালিয়ে রইল পাকিস্তানে, আরব দেশ ও বিলেতে। তাদের একসূত্রে গেঁথে রাখল পাকিস্তান। বিশেষ করে ভুট্টো। আইএসআই তাদের সক্রিয় সহযোগিতায় নিয়োজিত হলো। কূটনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করল পাকিস্তান, সৌদি আরব ও চীন। অল্প কয়েকজন দেশদ্রোহী বাংলাদেশি এভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠল এবং লন্ডনে বসে 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি' গঠন করল। এই হলো বিভক্তির শুরুর কথা। এটা জাতীয় বিভক্তি নয়। জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র মাত্র। ষড়যন্ত্রটা সফল হলো ১৯৭৫ সালে। জনগণের ইচ্ছায় নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেও নয়। অস্ত্র ও অর্থ দ্বারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে। হত্যার মাধ্যমে। একাত্তরে ওই মহল কর্তৃক সম্পাদিত গণহত্যার আদলে। বাঙালির ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। প্রবাসী সরকার পরিচালনাকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজনকে জেলখানায় হত্যা করা হলো। মুক্তিযোদ্ধা নেতা-জনতাকে ধরে ধরে জেলে পোরা হলো। একাত্তরের হন্তা-লুণ্ঠনকারী অপরাধীদের জেল থেকে মুক্ত করে দালালিতে নিযুক্ত করা হলো। একাত্তরের দালালরা হলো পঁচাত্তরের দালাল। পালিয়ে থাকা দেশদ্রোহী গোলাম আযম গংদের দেশে ফিরিয়ে পুনর্বাসিত করা হলো। স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হলো। এই হলো দেশদ্রোহী মুষ্টিমেয় কয়েকজনের রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের ইতিহাস। বিভক্তি সৃষ্টির পূর্ব কথা।
যাঁর বজ্রকণ্ঠ শুনে মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হতেন, যাঁর স্থান ছিল প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায়, যাঁর জন্য একাত্তরে মুমিন বাঙালিরা সর্বক্ষণ দোয়া করতেন, রোজা রাখতেন, অন্য ধর্মীয়রা নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বিধাতার কাছে ভিক্ষা চাইতেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ হলো! মার্শাল ল আর সন্ত্রাসী অস্ত্রের ভয়ে সন্ত্রস্ত করে রাখা হতো জনপদ। প্রচার করা হতো 'নতুন বাংলাদেশ' তথা বাংলাস্থানের কথা। বিদেশি অর্থ-অস্ত্র-কূটনীতির মদদে পরিচালিত দেশদ্রোহীরা জবর দখলের শাসন চালিয়েছিল অনেক বছর। রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে দেশদ্রোহী গোষ্ঠীটি ক্ষমতার চলমানতা রক্ষা করেছিল। নির্বাচন ম্যানিপুলেট করে 'গণতান্ত্রিক' লেবাসে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছিল। স্কুলের ছেলেমেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বদলে তথাকথিত 'নতুন বাংলাদেশের' বিকৃত কল্পকাহিনী শেখানো হতো। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাস লালন করা হতো। এভাবেই জাতির বিভক্তি রেখাকে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা চলেছিল। এটা যে পাকিস্তানে প্রণীত এবং পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত ষড়যন্ত্র এবং স্বল্পসংখ্যক দেশদ্রোহী বাংলাদেশি (বাঙালি নয়) যে এর তল্পীবাহক, তার পরিষ্কার প্রমাণ রয়েছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, (যদিও পাবলিক মেমোরি খুব শর্ট), পঁচাত্তরের পর বহুকাল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী' কথাটি উচ্চারিত হতো না। বলা হতো পাকিস্তান নাকি ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, বাংলাদেশের কাছে নয়! অথচ আমরা কালের সাক্ষী যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে 'বাংলা-ভারত যৌথ বাহিনী'র কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা।
আরো একটি ছোট্ট ঘটনা প্রাসঙ্গিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল, হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল একটি লেখার জন্য। লেখাটির নাম 'পাক ছার জমিন শাদবাদ'। প্রকাশিত হয়েছিল ইত্তেফাক পত্রিকায়। শিরোনামের শব্দগুলো পাকিস্তানি জাতীয় সংগীতের প্রথম লাইন। লেখাটাতে ব্যঙ্গ ছিল। ক্ষুব্ধ হয়েছিল পাকিস্তান। তাই পাকিস্তানি এজেন্টরাই সন্ত্রাস করেছিল। একটানা ২০ বছর ছদ্মবেশী পাকিস্তানি শাসনে এবং ২০০১ সালের পর জামায়াতি সংশ্লেষে অনেকটা সরাসরি দেশদ্রোহীদের অপশাসনের দেশে বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ বিভক্তি কিন্তু ক্ষমতাসীনদের। জনতার নয়। জনতা বিভক্ত হয়নি। প্রমাণ ২০০৮ সালের নির্বাচন। সত্তরের নির্বাচনের মতো। অর্থ দাঁড়ায়, সত্তরের জনতা আর ২০০৮ সালের জনতা, একই মতাবলম্বী। এদের মধ্যে বিভেদ নেই। মতান্তর নেই। শাসনক্ষমতায় জনতার অংশগ্রহণ বাড়লেই বিভক্তি হ্রাস পেতে পেতে লোপ পাবে। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে এবং ৯০ শতাংশ লোক অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা পেলে বছর দশকের মধ্যে জনসক্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। নারীনীতি বাস্তবায়িত হলে, নারীর ক্ষমতায়ন হলে জনসক্রিয়তা আরো বাড়বে। শর্ত একটাই, এ সময়টাতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ সরকার থাকতে হবে। দেশদ্রোহীরা ছদ্মবেশে ক্ষমতায় প্রবেশ করতে পারে না।
গণ-ঐক্য দৃশ্যমান সংস্কৃতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। পহেলা বৈশাখ সেই ইঙ্গিতই পুনর্বার দিয়ে গেল। এ জন্য একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। নাগরিক সমাজ ও সরকার সম্মিলিতভাবে এ আন্দোলনটি পরিচালনা করতে পারে। প্রথম পর্যায়ে কয়েকটি পদক্ষেপ বিবেচনাযোগ্য। প্রতিটি শিক্ষালয়ে (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইংরেজি ও অন্যান্য) আবৃত্তি ও সংগীতচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য একটি সিডি প্লেয়ার, হারমোনিয়াম ও তবলার জন্য বরাদ্দ দিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের সময় সংগীত জানা প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিটি স্কুলে অন্তত একজন গানের শিক্ষক থাকার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। তিনি শুধু সংগীতশিক্ষক হবেন না, গণিত, বাংলা বা যেকোনো বিষয়ের শিক্ষক হয়েও গান শেখানোর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন। তবে প্রথাগত গান শেখানোর দরকার নেই। চর্চা হবে শুধু মুক্তিযুদ্ধের গান, দেশাত্মবোধক গান, একুশের গান, মরমি বাংলা গান প্রভৃতি। বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ হতে পারে রবীন্দ্র-নজরুলগীতি। আবৃত্তিতে থাকতে পারে দেশাত্মবোধক ছড়া, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা প্রভৃতি। সপ্তাহে এক দিন হাফ-ডে ক্লাস করে, বাকি অর্ধদিবসে আবৃত্তি-সংগীতচর্চার জন্য রুটিনে নির্ধারিত রাখা যায়। প্রত্যেক শিক্ষালয়ে সরকার কয়েকটি সিডি-ক্যাসেট দান করবে, যার মধ্যে থাকবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের গান, জাগরণের গান, স্বদেশের গান, নৈতিকতার গান, গ্রামবাংলার গান। এ গানগুলো শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বিনোদন ও চরিত্র গঠনে সহায়ক হবে। ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা হবে। সম্ভব হলে ফিচার ফিল্ম দেখানো হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাব, সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মরত সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আর্থিক সহায়তা দেবে। এটি শিল্পকলা একাডেমীর মাধ্যমেও দেওয়া যেতে পারে। তৃতীয় প্রস্তাব, গ্রামগঞ্জে স্থানীয়ভাবে সুপরিচিত কবিয়ালদের প্রত্যেককে মাসিক সম্মানী দিতে হবে। সম্মানীর বিনিময়ে তাঁরা ঘুরে ঘুরে বিকেলে-সন্ধ্যায় গান শোনাবেন। নিজেরাই গান তৈরি করবেন। তবে গানগুলো হবে মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় শহীদদের নিয়ে, জাতীয় পর্যায়ের যোদ্ধাদের (তাজউদ্দীন, নজরুল, ভাসানী প্রমুখ) নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। ১৫ আগস্ট কারবালার শোকগাথার মতো করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বপ্নকে নিয়ে। আবহমান বাংলাকে নিয়ে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ কাজগুলো করলে দরিদ্র সাংস্কৃতিককর্মী, কবিয়াল, নাট্যদলগুলো বিকাশ লাভ করতে পারে। নিরানন্দ গ্রামীণ জীবনে আনন্দের ছোঁয়া লাগতে পারে। সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে জনতার ঐক্য শুধু দৃঢ়তা পাবে না, দৃশ্যমানও হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি যেমন জেগে উঠেছিল, সংস্কৃতির মাঝে বাঙালি আবার তার আত্মপরিচয় খুঁজে পাবে, প্রত্যয়ী হয়ে উঠবে। বিভক্তি কেটে যাবে। সংহতি সংহত হবে। সংস্কৃতি হয়ে উঠুক সংহতির হাতিয়ার। গর্জে উঠুক মুক্তিযুদ্ধের মতো আরেকবার।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
No comments