মত দ্বিমত-নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন আপাতত নেই by সালেহউদ্দিন আহমেদ

দেশে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিতর্ক চলছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বলেছেন, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন ব্যাংক খোলার প্রয়োজন আছে কি নেই, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ও সালেহউদ্দিন আহমেদ-এর অভিমত প্রকাশ করা হলো।


নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, সেটা দেখতে হবে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কেননা, নতুন ব্যাংক চাহিদার ভিত্তিতে হতে হবে। যাচাইবাছাই করে দেখার পরই এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিধি বা ব্যাপ্তি (জিডিপি ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো) যেভাবে বাড়ছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
আমাদের এখন ৪৭টি তফসিলি ব্যাংক আছে। এর মধ্যে চারটা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক, চারটা বিশেষায়িত, ৩০টা বেসরকারি ও নয়টি বিদেশি ব্যাংক। যারা ব্যাংকের আওতার বাইরে আছে, সেসব লোককে ব্যাংকের আওতায় নিয়ে আসা নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু নতুন ব্যাংক স্থাপনই কি এর সমাধান? সেটা বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারে। বিশেষায়িত দিকগুলো দেখার জন্যও ব্যাংক আছে। এদের পণ্য বাড়ানো এবং কাজের বিস্তার ঘটানোর এখনো অনেক সুযোগ আছে।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন বহুমুখী কাজ করছে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এরা সরকারি ব্যাংকগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। আর তারা নতুন নতুন জায়গায় যাচ্ছে, ব্যবসা, শিল্পে বিনিয়োগ করছে। এখন যদি মনে করা হয়, যেহেতু অর্থনীতির পরিধি বাড়ছে, নতুন নতুন কাজ হচ্ছে, নতুন নতুন ব্যাংক দরকার—এ যুক্তি তেমন শক্তিশালী নয়। কারণ, বিদ্যমান ব্যাংকগুলো দিয়েই সে কাজ করানো যায়।
অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন, আমাদের ব্যাংকের যে সংখ্যা এবং তাদের যে তহবিল, তা অনেক জায়গায় যাচ্ছে না, গ্রামাঞ্চলে বিনিয়োগ হচ্ছে না ইত্যাদি। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান তো নতুন ব্যাংক তৈরি করে হবে না। যেসব জায়গায় ব্যাংক যেতে পারছে না, সেখানে নতুন ব্যাংকের পক্ষে অল্প সময়ের মধ্যে তা করা সম্ভব হবে না। বরং বর্তমানে যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলো বিকশিত করা দরকার।
আমাদের দেশে ব্যাংকগুলো এখনো ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ কাভার করে, আর বেশির ভাগ কাভার করে এনজিও ও কো-অপারেটিভ, ক্রেডিট ইউনিয়ন, ক্রেডিট সোসাইটি। তাই, যতই নতুন ব্যাংক দেওয়া হোক না কেন, তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুবিবেচনাসম্বন্ধীয় মান বা ব্যবস্থাপনাগত মানদণ্ড মেনে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ইচ্ছামতো যেখানে-সেখানে যাওয়া, ঋণ দেওয়া ইত্যাদি করা যায় না। নতুন ব্যাংক দিয়েই আউটরিচ বাড়াতে হবে এমন তো নয়। বরং যেসব এনজিও ভালো কাজ করছে (যেমন ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে), এ ছাড়া ক্ষুদ্রঋণের রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ ২৯৮টি লাইসেন্স দিয়েছে কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য—তারাও বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অবদান রাখতে পারে। তাদের কাজটা তাদেরই করতে দেওয়া হোক। তাদের একটা কাঠামোয় নিয়ে আসা বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সম্পূরক ভূমিকা তো তারাও পালন করতে পারে। ব্যাংককেই সবকিছু করতে হবে—এর তো মানে হয় না। পুরো আর্থিক খাতে অর্থায়ন করবে ব্যাংক, এটা সম্ভব নয়। অন্য আধা-আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলোও শক্তিশালী করা হোক।
বাংলাদেশে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান করার ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সংস্থানের জন্য দরকার হয় পুঁজিবাজার। ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভর করে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোনো দেশে হয় না। পুঁজিবাজার শক্তিশালী ও অস্থিতিশীল অবস্থা দূর করা জরুরি। পুঁজিবাজার থেকে অর্থ আহরণের সুবিধা হলো, তাতে ইক্যুয়িটি বাড়বে, মালিকদের স্টেক বাড়বে।
সরকার ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা যাচাইবাছাই করে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে পারে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে নতুন ব্যাংকের সম্ভাবনা যাচাই করা হয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, নতুন কোনো ব্যাংক স্থাপনের প্রয়োজন নেই। ছয়-সাত বছর নতুন কোনো ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সেই পরিপ্রেক্ষিতের বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার পক্ষে খুব বাস্তবসম্মত যুক্তি থাকতে হবে। রূপরেখা, ভবিষ্যতের ভিশন (‘আশা করছি, এ রকম হবে’)—এ ধরনের ভাসা ভাসা, অস্পষ্ট লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে নতুন ব্যাংক খোলার কোনো অর্থ নেই।
সরকার নতুন ব্যাংকের অনুমতি দেওয়ার নির্দেশ দিলে তা সঠিক হবে না। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বকীয়তা, তার স্বায়ত্তশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ করা হবে। যদি সরকার মনে করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নয়, আইন করে নতুন ব্যাংক স্থাপন করবে, সেটা তো সরকার করতেই পারে। আইন করে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অসুবিধা হলো, এতে ব্যাংকিংয়ের ডিসিপ্লিন, সেবার মান যথাযথ না হওয়ারই আশঙ্কা থাকে।
সম্প্রতি বিশ্বে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, সেদিকে তাকালে দেখা যাবে, সংকটের শুরু মূলত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে। পরে তা ছড়িয়ে পরে বিভিন্ন খাতে এবং বিভিন্ন দেশে। পশ্চিমা দেশগুলোতে সংকট এখনো কাটেনি। তাই ব্যাংকের যদি খুব ভালো পুঁজি ভিত্তি না থাকে, সেবার মান ভালো না হয়, ভালো ব্যবস্থাপনা ও ভালো সম্পদ না থাকে, তাহলে দেশের ভেতরের ঘাত-প্রতিঘাত কিংবা বাইরের সংকটের অভিঘাত সে সহ্য করতে পারবে না। এদিকটাও ভেবে দেখতে হবে। ছোট ছোট ব্যাংক, ছোট ছোট আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে একটা ইকোনমিক সাইজে যাওয়ার নীতি অনুসৃত হলে সুফল লাভ করা যায়। ‘ইকোনমি অব স্কেল’ বিবেচনা করে করলে তখন সেবার মান ও কার্যকারিতা বাড়ে কিন্তু ব্যয় কমে। ছোট ছোট দুর্বল ব্যাংক ইকোনমি অব স্কেলের সুফল অর্জন করতে পারে না। তা ছাড়া, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাধিক্যের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কাজে গুণগত মান বজায় রাখাও বেশ কষ্টসাধ্য হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।

No comments

Powered by Blogger.