ডাক বিভাগের বিবর্ণ চিত্র by মযহারুল ইসলাম বাবলা
অনেক মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল চিঠি। সব ধরনের যোগাযোগ-কুশলাদি জানার, ভাব বিনিময়সহ সার্বিক প্রয়োজনে চিঠির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। চিঠির কোনো বিকল্প ছিল না। মনের কথা, প্রাণের কথা, ভাব-চিন্তার কথা প্রকাশের একমাত্র অবলম্বন ছিল চিঠি। চিঠিতে প্রকাশ পেত মানুষের তাবৎ মনের নানা কথা।
পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সব যোগাযোগ-প্রয়োজন মেটাত চিঠি। আমাদের সাহিত্যের সব শাখায় চিঠিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য সাহিত্য। বাস্তবে চিঠি ছিল আমাদের জীবনেরই অংশবিশেষ। আজকের বাস্তবতায় সেই চিরচেনা চিঠি কেবল উপেক্ষিতই নয়, প্রায় বিলুপ্তির পথে।
চিঠির ভাষা ও শব্দ প্রয়োগে সৃজনশীলতা নিয়ে একরকম প্রতিযোগিতা পর্যন্ত ছিল। আত্মীয়-পরিজন ছাড়াও পত্রবন্ধুদের সঙ্গে পত্রালাপের সংস্কৃতিও ছিল। যা কালের গর্ভে আজ বিলীন। চিঠি লেখার মধ্য দিয়ে ভাষাজ্ঞান ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করার সুযোগ ছিল। ভাষাজ্ঞান, শব্দ গঠন ও প্রয়োগে চিঠির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। একটি চিঠিকে অনেকবার খসড়া করে তবেই চূড়ান্ত করে প্রাপকের কাছে পাঠানো হতো। চিঠির সর্বজনীন ব্যবহার যেমন ছিল, তেমনি ছিল এর রোমান্টিক আবেদন। চিঠিকে কেন্দ্র করে নানা হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটত। তবে আজকাল বিজ্ঞানের আশীর্বাদে প্রিয়জন বা নিকটজনের সংবাদ জানতে চিঠির জন্য ব্যাকুল হয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় না। প্রেরক এবং প্রাপক_কাউকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনতে হয় না। প্রয়োজন হয় না সময়ক্ষেপণের ক্লান্তিকর প্রতীক্ষার। তাৎক্ষণিকভাবে কাঙ্ক্ষিত যে কারো সঙ্গে মুহূর্তে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করা যায় কথাও। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এই যান্ত্রিক যুগে সব কিছু তাৎক্ষণিকভাবেই মানুষের নাগালে। আমাদের চিরচেনা চিঠির সংস্কৃতি এখন সোনালি অতীত। আমাদের অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিকের রচনার হাতেখড়ি ছিল চিঠি লেখা, যা তাঁরা অনেকে স্বীকারও করে গেছেন। আজকের প্রজন্মের কাছে চিঠির প্রয়োজন-গুরুত্ব কোনোটিই নেই। থাকার কথাও নয়। তারা অনায়াসে মুহূর্তে যেখানে ইচ্ছে নম্বর টিপে কথা বলতে পারছে। কেন অকারণে সময় অপচয় করবে! বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রায় এত ইতির পাশাপাশি নেতির দিকটি যে নেই, তা কিন্তু নয়। নেতির দিকটি কি আমরা বিবেচনা করছি? আজকের প্রজন্ম মোবাইল ফোন, ওয়েব, ই-মেইল, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট সংস্কৃতিতে ডুবে আছে। তাদের মেধা ও মনন বিকাশে যান্ত্রিকতার বিরূপ প্রভাব অস্বীকার করি কিভাবে? চিঠি লেখার অনভ্যস্ততায় কর্মজীবনের প্রাতিষ্ঠানিক কাজে চিঠি লিখতে তাদের যে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না_এ সত্যটি কি অস্বীকার করা যাবে? যান্ত্রিকতার ভিড়ে তাদের মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও জ্ঞানার্জনের পাঠাভ্যাস কি সৃষ্টির উপায় আছে? সেটা কি ভাবনার কারণ নয়?
নিকট অতীতেও সংগত কারণেই ডাক বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা না রাখার উপায় ছিল না। বিকল্প ব্যবস্থার অভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও ডাক বিভাগের ওপরই বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হতো। কিন্তু আজ আধুনিক প্রযুক্তির আগমনে ই-মেইল, ফ্যাঙ্ েচিঠি যেমন প্রেরিত হয়, পাশাপাশি হয় বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও। বেসরকারি কুরিয়ার বিকল্প ডাক হিসেবে ডাক বিভাগের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। ডাক বিভাগের বিকল্প হিসেবে মানুষের আস্থাও অর্জন করেছে। চিঠি, ডকুমেন্ট, পার্সেল, অর্থ প্রেরণসহ ডাক বিভাগের তাবৎ কর্মের বিকল্প হিসেবে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো মানুষের কাছে আস্থাশীল হয়ে উঠেছে। ফলে বর্তমানে ডাক বিভাগের কর্মপরিধি সংকুচিত এবং হুমকির মুখে। স্বেচ্ছাচারিতার মাসুল এখন গুনতে হচ্ছে খোদ ডাক বিভাগকেই। রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের দ্বিগুণ খরচে মানুষ বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসে নির্ভর হয়ে উঠেছে। বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে বিশাল ডাক বিভাগ এখন অন্তিম প্রহর গুনছে। ডাক বিভাগের সেবার মান অতি নিম্নমানের এবং বিড়ম্বনাময় বলেই মানুষের আস্থা-ভরসা তারা হারিয়েছে। পাঁচ টাকা খরচে একটি চিঠি নির্দিষ্ট সময়ে প্রাপকের হাতে পেঁৗছবে কিংবা আদৌ পেঁৗছবে কি না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ এর দ্বিগুণ খরচে বেসরকারি কুরিয়ার পরের দিনই নির্দিষ্ট প্রাপকের হাতে ডাক পেঁৗছে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। আমাদের দেশের কোনো সরকারই ডাক বিভাগের আধুনিকায়নসহ সংস্কার করেনি। সেকেলে ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি যুগোপযোগী হয়নি। তাই যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ বিভাগটি এগোতে পারেনি। ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বোধ-বিবেচনার সামান্য পরিবর্তন হয়নি। তাঁরা অতীতমুখী। বর্তমানে ডাক বিভাগ কেবল অলাভজনকই নয়, রাষ্ট্রের আর্থিক ভর্তুকির এক নজরকাড়া প্রতিষ্ঠান। যা রাষ্ট্রের জন্য অনভিপ্রেত বোঝা।
লেখক : প্রাবন্ধিক
চিঠির ভাষা ও শব্দ প্রয়োগে সৃজনশীলতা নিয়ে একরকম প্রতিযোগিতা পর্যন্ত ছিল। আত্মীয়-পরিজন ছাড়াও পত্রবন্ধুদের সঙ্গে পত্রালাপের সংস্কৃতিও ছিল। যা কালের গর্ভে আজ বিলীন। চিঠি লেখার মধ্য দিয়ে ভাষাজ্ঞান ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করার সুযোগ ছিল। ভাষাজ্ঞান, শব্দ গঠন ও প্রয়োগে চিঠির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। একটি চিঠিকে অনেকবার খসড়া করে তবেই চূড়ান্ত করে প্রাপকের কাছে পাঠানো হতো। চিঠির সর্বজনীন ব্যবহার যেমন ছিল, তেমনি ছিল এর রোমান্টিক আবেদন। চিঠিকে কেন্দ্র করে নানা হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটত। তবে আজকাল বিজ্ঞানের আশীর্বাদে প্রিয়জন বা নিকটজনের সংবাদ জানতে চিঠির জন্য ব্যাকুল হয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় না। প্রেরক এবং প্রাপক_কাউকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনতে হয় না। প্রয়োজন হয় না সময়ক্ষেপণের ক্লান্তিকর প্রতীক্ষার। তাৎক্ষণিকভাবে কাঙ্ক্ষিত যে কারো সঙ্গে মুহূর্তে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করা যায় কথাও। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এই যান্ত্রিক যুগে সব কিছু তাৎক্ষণিকভাবেই মানুষের নাগালে। আমাদের চিরচেনা চিঠির সংস্কৃতি এখন সোনালি অতীত। আমাদের অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিকের রচনার হাতেখড়ি ছিল চিঠি লেখা, যা তাঁরা অনেকে স্বীকারও করে গেছেন। আজকের প্রজন্মের কাছে চিঠির প্রয়োজন-গুরুত্ব কোনোটিই নেই। থাকার কথাও নয়। তারা অনায়াসে মুহূর্তে যেখানে ইচ্ছে নম্বর টিপে কথা বলতে পারছে। কেন অকারণে সময় অপচয় করবে! বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রায় এত ইতির পাশাপাশি নেতির দিকটি যে নেই, তা কিন্তু নয়। নেতির দিকটি কি আমরা বিবেচনা করছি? আজকের প্রজন্ম মোবাইল ফোন, ওয়েব, ই-মেইল, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট সংস্কৃতিতে ডুবে আছে। তাদের মেধা ও মনন বিকাশে যান্ত্রিকতার বিরূপ প্রভাব অস্বীকার করি কিভাবে? চিঠি লেখার অনভ্যস্ততায় কর্মজীবনের প্রাতিষ্ঠানিক কাজে চিঠি লিখতে তাদের যে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না_এ সত্যটি কি অস্বীকার করা যাবে? যান্ত্রিকতার ভিড়ে তাদের মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও জ্ঞানার্জনের পাঠাভ্যাস কি সৃষ্টির উপায় আছে? সেটা কি ভাবনার কারণ নয়?
নিকট অতীতেও সংগত কারণেই ডাক বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা না রাখার উপায় ছিল না। বিকল্প ব্যবস্থার অভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও ডাক বিভাগের ওপরই বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হতো। কিন্তু আজ আধুনিক প্রযুক্তির আগমনে ই-মেইল, ফ্যাঙ্ েচিঠি যেমন প্রেরিত হয়, পাশাপাশি হয় বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও। বেসরকারি কুরিয়ার বিকল্প ডাক হিসেবে ডাক বিভাগের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। ডাক বিভাগের বিকল্প হিসেবে মানুষের আস্থাও অর্জন করেছে। চিঠি, ডকুমেন্ট, পার্সেল, অর্থ প্রেরণসহ ডাক বিভাগের তাবৎ কর্মের বিকল্প হিসেবে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো মানুষের কাছে আস্থাশীল হয়ে উঠেছে। ফলে বর্তমানে ডাক বিভাগের কর্মপরিধি সংকুচিত এবং হুমকির মুখে। স্বেচ্ছাচারিতার মাসুল এখন গুনতে হচ্ছে খোদ ডাক বিভাগকেই। রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের দ্বিগুণ খরচে মানুষ বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসে নির্ভর হয়ে উঠেছে। বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে বিশাল ডাক বিভাগ এখন অন্তিম প্রহর গুনছে। ডাক বিভাগের সেবার মান অতি নিম্নমানের এবং বিড়ম্বনাময় বলেই মানুষের আস্থা-ভরসা তারা হারিয়েছে। পাঁচ টাকা খরচে একটি চিঠি নির্দিষ্ট সময়ে প্রাপকের হাতে পেঁৗছবে কিংবা আদৌ পেঁৗছবে কি না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ এর দ্বিগুণ খরচে বেসরকারি কুরিয়ার পরের দিনই নির্দিষ্ট প্রাপকের হাতে ডাক পেঁৗছে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। আমাদের দেশের কোনো সরকারই ডাক বিভাগের আধুনিকায়নসহ সংস্কার করেনি। সেকেলে ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি যুগোপযোগী হয়নি। তাই যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ বিভাগটি এগোতে পারেনি। ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বোধ-বিবেচনার সামান্য পরিবর্তন হয়নি। তাঁরা অতীতমুখী। বর্তমানে ডাক বিভাগ কেবল অলাভজনকই নয়, রাষ্ট্রের আর্থিক ভর্তুকির এক নজরকাড়া প্রতিষ্ঠান। যা রাষ্ট্রের জন্য অনভিপ্রেত বোঝা।
লেখক : প্রাবন্ধিক
No comments