লাদেন যুগের অবসান

অবশেষে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হলেন ওসামা বিন লাদেন। বিশ্বের এক নম্বর ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ধনাঢ্য সৌদি পরিবারের সন্তান হয়েও পরিবারের বাইরে গিয়ে তিনি গড়ে তোলেন আল-কায়েদা নামের জঙ্গি সংগঠন।


গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মার্কিন স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে আফগানিস্তানে এসে তালেবান শাসনের ছায়ায় আফগানিস্তানজুড়ে তিনি গড়ে তোলেন আল-কায়েদার তালেবানি প্রশিক্ষণ শিবির। সেই প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে আল-কায়েদার সদস্যরা। ছড়িয়ে যায় ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। ওসামা বিন লাদেনের তত্ত্বাবধানেই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বিস্তৃত হয় বিশ্বে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে এসেছিল ওসামা বিন লাদেনের নাম। এর পর থেকেই ওসামা বিন লাদেন ছিলেন 'মোস্ট ওয়ান্টেড'। তাঁকে জীবিত অথবা মৃত আটক করার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল তৎকালীন বুশ সরকার। কিন্তু ওসামা বিন লাদেনকে পাওয়া যায়নি কোথাও। তাঁকে হত্যার জন্য একের পর এক আক্রমণ করা হয়েছে আফগানিস্তানে। কিন্তু সব সময়ই অক্ষত থেকে গেছেন ওসামা। দীর্ঘ একটি দশক নিজেকে আড়াল করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তাঁকে হত্যার জন্য বিভিন্ন আক্রমণ যখন হয়েছে, তার পর পরই গোপন স্থান থেকে ভিডিও বক্তৃতার মাধ্যমে ওসামা বিন লাদেন জানান দিয়েছেন তাঁর অস্তিত্ব। এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে তাঁর ৬০টি ভিডিও। শুরু থেকেই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের পক্ষে কাজ করেছেন ওসামা বিন লাদেন। যদিও তিনি বার বারই বলেছেন, তাঁর লড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, আসলে তিনি মুক্ত মতবাদ মেনে নিতে পারেননি। ধর্মীয় গোঁড়ামিকে পুঁজি করেই ওসামা বিন লাদেন এগিয়ে গেছেন। আফগানিস্তানে তালেবানি শাসনের অবসান হলেও সেখানে তালেবান দমনের লড়াই এখনো চলছে। অন্যদিকে তালেবানরা ছড়িয়ে পড়েছে উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও গড়ে ওঠে আল-কায়েদার শাখা। শুধু আফগানিস্তান নয়, সারা বিশ্বেই নিজের মতবাদ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিলেন মুক্তবুদ্ধির মানুষের জন্য।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু হয়েছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, ওসামার মৃতদেহ তাদের কাছে। কিন্তু ওসামার মৃত্যু হয়েছে বলেই তালেবানি যুগের অবসান হয়ে গেছে_এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সারা বিশ্বে এখন একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে বিদায় নিতে হচ্ছে। সরে যাচ্ছে একনায়কতন্ত্র। পাল্টে যেতে শুরু করেছে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের চিন্তাধারাও। মৌলবাদী চিন্তাধারার যে অসুস্থ ব্যবস্থা অশিক্ষা ও কুশিক্ষার সুযোগে চেপে বসতে চেয়েছিল, সেখানেও পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন আর চাপিয়ে দেওয়া কোনো ব্যবস্থা মেনে নিতে চায় না। মানুষ এখন মানবিকতাকেই সবার ওপরে তুলে ধরতে চায়।
'সবার উপরে মানুষ সত্য' কিংবা 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নহে কিছু মহীয়ান'_এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই মানুষ এগোতে চায়। লাদেনের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে মৌলবাদী শক্তির একটি অধ্যায় শেষ হয়েছে। কিন্তু তারা একেবারে শেষ হয়ে যাবে না। হয়তো নতুন কোনো লাদেনের নেতৃত্বে তারা আবার মানবতাবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে তৎপর হবে। সেই শক্তির একটি অশুভ ধারা আমাদের দেশেও চলে এসেছে। এদের সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.