প্রবাসে বাংলাদেশ-বাংলাদেশের সোস্যাল ক্যাপিটাল by এএইচএম জেহাদুল করিম
অনেকের মনে এই প্রশ্নও দেখা দিতে পারে যে, নৈতিকভাবে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের পক্ষে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করা যৌক্তিক কি-না। আমাদের যুক্তি হলো এই যে, জাতিসংঘ শান্তি মিশন যেহেতু একটি বিশ্ব সংস্থা, সেহেতু এই ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা আমাদের বিশ্ব পরিমণ্ডলে একটি বিশেষ পরিচিতি দিয়ে থাকে; সেই ক্ষেত্রে
এগুলো শান্তির দূত হিসেবে এক ধরনের শুভেচ্ছা মিশনও বটে। অন্যদিকে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জেনোসাইড, জাতি- ধর্মভিত্তিক সহিংসতা, কঠোর অন্যায় ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিশ্বে কীভাবে শান্তি বিনষ্ট করে, বাংলাদেশ তা অবলোকন
করতে সক্ষম হয়
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার গৌরবময় ভূমিকার জন্য দেশে-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে সমগ্র সেনাবাহিনীর ওপর যে কলঙ্ক লেপন করেছে, ইতিহাসে তা ক্ষমার অযোগ্য। এছাড়াও পঁচাত্তর-মধ্যবর্তী সময়ে আমাদের সেনাবাহিনীর কয়েকজন জেনারেল বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে, দেশের গণতন্ত্রকে যেভাবে বিনষ্ট করেছে তা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। তাদের এই অবৈধ ক্ষমতা দখলকে, এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের মিলিটারি জান্তার ক্ষমতা দখলের সঙ্গে তুলনা করা চলে। এসব বাদ দিলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পজিটিভ ভূমিকা, বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে তাদের অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তি পাওয়ার পর মাত্র চার বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি পায়। যদিও জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সাম্প্রতিকালের, তথাপি ইরান-ইরাক দীর্ঘ যুদ্ধের পর ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের নেতৃত্বে ৩১ জন মিলিটারি পর্যবেক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সেখানে প্রথম শান্তি মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা সেখানে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন এবং ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত পরবর্তীকালে আরও ৪৮ জন মিলিটারি পর্যবেক্ষক ও ২ হাজার ৫২২ জন সেনাসদস্যকে ইরাক-কুয়েতের সীমানায় পাঠানো হয়। ১৯৮৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তথ্য নিয়ে দেখা যায় যে, আমাদের সেনাসদস্যরা মধ্যপ্রাচ্য, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, জর্জিয়া, তাজাকিস্তন, যুগোশ্লাভিয়া, নামিবিয়া, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, সোমালিয়া ও রুয়ান্ডাসহ প্রায় একডজনেরও অধিক দেশে কৃতিত্বের সঙ্গে জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শান্তি মিশনে কাজ করেছেন।
অনেকে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই এই প্রশ্ন করতেই পারেন যে, আমাদের অর্থে প্রতিপালিত সেনাসদস্যদের শান্তি মিশনে কাজ করলে আমাদের সাধারণ মানুষের কী এমন লাভ হয়? এখানে মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি ছোট দেশ হিসেবে পরিচিত এবং এর প্রায় ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। একটি দরিদ্রতম দেশ হিসেবে এটিকে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। প্রয়াত কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার এক লেখায় বলেছিলেন যে, “Bangladesh has to pursue a ‘forward-looking’ foreign policy with a view to increasing international support for its national recovery by way of foreign aid and investment.” এইforward-looking এপ্রোচ বলতে তিনি মূলত বহুমাত্রিক কূটনীতিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন এবং শান্তি মিশনে কাজ করায় বিষয়টিও এই এপ্রোচের একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের সেনাসদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ যদি বিদেশে কর্মরত থাকেন তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার বৃদ্ধি পায় এবং সেই সঙ্গে social capital হিসেবে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা যে অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন, তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, এটিও নিঃসন্দেহে একটি পজিটিভ দিক। সেনাসদস্য ও শ্রমিক ভাইয়েরা ছাড়া অন্যান্য প্রফেশনাল শ্রেণী যেমন ডাক্তার, নার্স, অধ্যাপক এবং অন্যান্য প্রফেশনের মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ যদি সাময়িকভাবে বিদেশে অবস্থান করেন, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ইমেজও বৃদ্ধি পায়। সেনাসদস্যদের শান্তি মিশনে কাজ করার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শান্তি মিশনগুলোতে কাজ করার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক বৃহৎ শক্তির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে এবং একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আমাদের কাছে অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রতীয়মান হবে। ১৯৯৪ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশনে নিয়োজিত মোট ৭৩ হাজার সামরিক সদস্যের মধ্যে ৫.৩১ ভাগ অর্থাৎ ৩ হাজার ৮৭৬ জন বাংলাদেশি। এই ক্ষেত্রে ব্রিটেন ৫.১১%, রাশিয়া ২.০২%, চীন ০.০৯% আমেরিকা ১.৩৪% এবং কানাডার অংশগ্রহণ হলো ৩.৫%। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র দেশ যেটি ৫ হাজার ৪৫০ সামরিক বাহিনীর ব্যক্তিকে বিদেশে প্রেরণ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, সামরিক বাহিনীর বাইরেও বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বেসামরিক ব্যক্তি ও পুলিশ সদস্যদেরও প্রেরণ করেছে, যারা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
অনেকের মনে এই প্রশ্নও দেখা দিতে পারে যে, নৈতিকভাবে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের পক্ষে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করা যৌক্তিক কি-না। আমাদের যুক্তি হলো এই যে, জাতিসংঘ শান্তি মিশন যেহেতু একটি বিশ্ব সংস্থা, সেহেতু এই ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা আমাদের বিশ্ব পরিমণ্ডলে একটি বিশেষ পরিচিতি দিয়ে থাকে; সেই ক্ষেত্রে এগুলো শান্তির দূত হিসেবে এক ধরনের শুভেচ্ছা মিশনও বটে। অন্যদিকে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জেনোসাইড, জাতি-ধর্মভিত্তিক সহিংসতা, কঠোর অন্যায় ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিশ্বে কীভাবে শান্তি বিনষ্ট করে, বাংলাদেশ তা অবলোকন করতে সক্ষম হয়। বিশ্বের অনেক দেশই বাংলাদেশকে একটি উদারনৈতিক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকে এবং সে কারণেই শান্তি মিশনে আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয় ও অঙ্গীকার বিশ্বে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। এছাড়াও আমাদের সেনাবাহিনীতে কঠোর নিয়মতান্ত্রিক রিক্রুটমেন্ট পলিসি থাকার কারণে অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তিরাই সেখানে নিয়োগ পেয়ে থাকেন বলে ধারণা করা যায়। বিভিন্ন কারণে প্রফেশনাল দিক থেকেও আমাদের দেশে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার একটি মর্যাদা রয়েছে এবং সঙ্গত কারণেই অনেক মেধাবী ছাত্র এই পেশায় আকৃষ্ট হন।
বিদেশে কর্মরত অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদস্যদের সম্পর্কে একটি বিষয় বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেগেটিভলি আলোচিত হয়ে থাকে এবং সেটি হলো এই যে, আমাদের সেনাসদস্যদের মধ্যে অনেকেই স্বচ্ছ ইংরেজিতে বা অন্য কোনো ভাষায় কথা বলতে পারেন না। এটি সম্ভবত সামরিক অফিসারদের ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য হবে না। কেননা আমাদের সামরিক বাহিনীর কমিশন্ড অফিসাররা স্পোকেন ইংরেজিতে বেশ ভালো। তবে সাধারণ জওয়ানদের মধ্যে শান্তি মিশনে যাওয়ার পূর্বে অন্তত বছরখানেক নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণভাবে তাদের স্পোকেন ইংরেজি এবং অন্য দু'একটি বিদেশি ভাষায় দক্ষ করে তোলা যায়। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সম্পৃক্ত হতে গেলে দেশের সেনাবাহিনীকে অত্যন্ত দক্ষ ও বিনয়ী হতে হয়। বহির্বিশ্বে তাদের সম্পর্কে এমনও ধারণা পোষণ করা হয় যে, তারা অনেক সময়ই দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে থাকে। এই বিষয়গুলো সাধারণভাবে যেমন ঘৃণিত, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও সম্পূর্ণ অগ্রহণীয়; যা বিদেশে আমাদের দেশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করে। আইনবহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখল করার কারণেই সম্ভবত ১৯৯৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশকে জাতিসংঘ মিশনগুলোতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
পঁচাত্তর ও আশির দশকে আমাদের কয়েকজন জেনারেল যেভাবে সামরিক বাহিনীকে অমর্যাদাকর অবস্থানে নিয়ে গেছেন তাতে দেশের ভাবমূর্তি সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক সামরিক অফিসারকে এসব বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অন্যায় অভ্যুত্থানের কারণে জীবন দিতে হয়েছে। এটির পুনরাবৃত্তি যেন আর কখনও না ঘটে এবং গণতান্ত্রিক সরকারকে তাই আইন করে এ ধরনের সামরিক অভ্যুত্থানকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
এটি নিঃসন্দেহে সঠিক যে, শিক্ষা ও সভ্যতায় অগ্রসরমান দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধকালে এবং জরুরি অবস্থা ব্যতীত কখনোই সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করা হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশগুলোতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করানো রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য মর্যাদাকর মনে করা হয়। অনেক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক সিভিল সার্ভেন্সদের রাজনীতিতে naturalize করানো আমাদের দেশে এক ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শবিবর্জিত, আর্থিক সচ্ছলতার জন্য যারা রাজনীতিতে প্রবেশ করছেন তারা সত্যিকারের নিবেদিতপ্রাণ এবং স্বচ্ছ রাজনীতিবিদদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। এটি কিছুতেই কাম্য নয়। তবে এর জন্য কিছু কিছু রাজনীতিবিদের অদক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাব অনেকাংশে দায়ী। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জনকারী পরিশীলিত রাজনীতিবিদরাই রাজনীতিতে থাকবেন; এটাই স্বাভাবিক। তবে এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের হতে হবে শিক্ষিত, মার্জিত ও অভিজ্ঞ। আদর্শবিবর্জিত, অরুচিশীল ও দুর্নীতিগ্রস্ত এবং শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে রাজনীতিচর্চা অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই দেশের মানুষ চাইবে না, এটি মনে রাখতে হবে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকে অন্য প্রফেশনালদের তাদের বশংবদ মনে করে থাকেন; এই নীতি পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
ড. এএইচএম জেহাদুল করিম : বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্তন সদস্য; বর্তমানে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন
ahmzkarim@yahoo.com
করতে সক্ষম হয়
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার গৌরবময় ভূমিকার জন্য দেশে-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে সমগ্র সেনাবাহিনীর ওপর যে কলঙ্ক লেপন করেছে, ইতিহাসে তা ক্ষমার অযোগ্য। এছাড়াও পঁচাত্তর-মধ্যবর্তী সময়ে আমাদের সেনাবাহিনীর কয়েকজন জেনারেল বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে, দেশের গণতন্ত্রকে যেভাবে বিনষ্ট করেছে তা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। তাদের এই অবৈধ ক্ষমতা দখলকে, এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের মিলিটারি জান্তার ক্ষমতা দখলের সঙ্গে তুলনা করা চলে। এসব বাদ দিলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পজিটিভ ভূমিকা, বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে তাদের অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তি পাওয়ার পর মাত্র চার বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি পায়। যদিও জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সাম্প্রতিকালের, তথাপি ইরান-ইরাক দীর্ঘ যুদ্ধের পর ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের নেতৃত্বে ৩১ জন মিলিটারি পর্যবেক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সেখানে প্রথম শান্তি মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা সেখানে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন এবং ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত পরবর্তীকালে আরও ৪৮ জন মিলিটারি পর্যবেক্ষক ও ২ হাজার ৫২২ জন সেনাসদস্যকে ইরাক-কুয়েতের সীমানায় পাঠানো হয়। ১৯৮৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তথ্য নিয়ে দেখা যায় যে, আমাদের সেনাসদস্যরা মধ্যপ্রাচ্য, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, জর্জিয়া, তাজাকিস্তন, যুগোশ্লাভিয়া, নামিবিয়া, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, সোমালিয়া ও রুয়ান্ডাসহ প্রায় একডজনেরও অধিক দেশে কৃতিত্বের সঙ্গে জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শান্তি মিশনে কাজ করেছেন।
অনেকে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই এই প্রশ্ন করতেই পারেন যে, আমাদের অর্থে প্রতিপালিত সেনাসদস্যদের শান্তি মিশনে কাজ করলে আমাদের সাধারণ মানুষের কী এমন লাভ হয়? এখানে মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি ছোট দেশ হিসেবে পরিচিত এবং এর প্রায় ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। একটি দরিদ্রতম দেশ হিসেবে এটিকে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। প্রয়াত কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার এক লেখায় বলেছিলেন যে, “Bangladesh has to pursue a ‘forward-looking’ foreign policy with a view to increasing international support for its national recovery by way of foreign aid and investment.” এইforward-looking এপ্রোচ বলতে তিনি মূলত বহুমাত্রিক কূটনীতিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন এবং শান্তি মিশনে কাজ করায় বিষয়টিও এই এপ্রোচের একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের সেনাসদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ যদি বিদেশে কর্মরত থাকেন তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার বৃদ্ধি পায় এবং সেই সঙ্গে social capital হিসেবে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা যে অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন, তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, এটিও নিঃসন্দেহে একটি পজিটিভ দিক। সেনাসদস্য ও শ্রমিক ভাইয়েরা ছাড়া অন্যান্য প্রফেশনাল শ্রেণী যেমন ডাক্তার, নার্স, অধ্যাপক এবং অন্যান্য প্রফেশনের মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ যদি সাময়িকভাবে বিদেশে অবস্থান করেন, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ইমেজও বৃদ্ধি পায়। সেনাসদস্যদের শান্তি মিশনে কাজ করার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শান্তি মিশনগুলোতে কাজ করার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক বৃহৎ শক্তির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে এবং একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আমাদের কাছে অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রতীয়মান হবে। ১৯৯৪ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশনে নিয়োজিত মোট ৭৩ হাজার সামরিক সদস্যের মধ্যে ৫.৩১ ভাগ অর্থাৎ ৩ হাজার ৮৭৬ জন বাংলাদেশি। এই ক্ষেত্রে ব্রিটেন ৫.১১%, রাশিয়া ২.০২%, চীন ০.০৯% আমেরিকা ১.৩৪% এবং কানাডার অংশগ্রহণ হলো ৩.৫%। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র দেশ যেটি ৫ হাজার ৪৫০ সামরিক বাহিনীর ব্যক্তিকে বিদেশে প্রেরণ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, সামরিক বাহিনীর বাইরেও বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বেসামরিক ব্যক্তি ও পুলিশ সদস্যদেরও প্রেরণ করেছে, যারা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
অনেকের মনে এই প্রশ্নও দেখা দিতে পারে যে, নৈতিকভাবে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের পক্ষে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করা যৌক্তিক কি-না। আমাদের যুক্তি হলো এই যে, জাতিসংঘ শান্তি মিশন যেহেতু একটি বিশ্ব সংস্থা, সেহেতু এই ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা আমাদের বিশ্ব পরিমণ্ডলে একটি বিশেষ পরিচিতি দিয়ে থাকে; সেই ক্ষেত্রে এগুলো শান্তির দূত হিসেবে এক ধরনের শুভেচ্ছা মিশনও বটে। অন্যদিকে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জেনোসাইড, জাতি-ধর্মভিত্তিক সহিংসতা, কঠোর অন্যায় ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিশ্বে কীভাবে শান্তি বিনষ্ট করে, বাংলাদেশ তা অবলোকন করতে সক্ষম হয়। বিশ্বের অনেক দেশই বাংলাদেশকে একটি উদারনৈতিক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকে এবং সে কারণেই শান্তি মিশনে আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয় ও অঙ্গীকার বিশ্বে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। এছাড়াও আমাদের সেনাবাহিনীতে কঠোর নিয়মতান্ত্রিক রিক্রুটমেন্ট পলিসি থাকার কারণে অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তিরাই সেখানে নিয়োগ পেয়ে থাকেন বলে ধারণা করা যায়। বিভিন্ন কারণে প্রফেশনাল দিক থেকেও আমাদের দেশে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার একটি মর্যাদা রয়েছে এবং সঙ্গত কারণেই অনেক মেধাবী ছাত্র এই পেশায় আকৃষ্ট হন।
বিদেশে কর্মরত অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদস্যদের সম্পর্কে একটি বিষয় বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেগেটিভলি আলোচিত হয়ে থাকে এবং সেটি হলো এই যে, আমাদের সেনাসদস্যদের মধ্যে অনেকেই স্বচ্ছ ইংরেজিতে বা অন্য কোনো ভাষায় কথা বলতে পারেন না। এটি সম্ভবত সামরিক অফিসারদের ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য হবে না। কেননা আমাদের সামরিক বাহিনীর কমিশন্ড অফিসাররা স্পোকেন ইংরেজিতে বেশ ভালো। তবে সাধারণ জওয়ানদের মধ্যে শান্তি মিশনে যাওয়ার পূর্বে অন্তত বছরখানেক নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণভাবে তাদের স্পোকেন ইংরেজি এবং অন্য দু'একটি বিদেশি ভাষায় দক্ষ করে তোলা যায়। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সম্পৃক্ত হতে গেলে দেশের সেনাবাহিনীকে অত্যন্ত দক্ষ ও বিনয়ী হতে হয়। বহির্বিশ্বে তাদের সম্পর্কে এমনও ধারণা পোষণ করা হয় যে, তারা অনেক সময়ই দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে থাকে। এই বিষয়গুলো সাধারণভাবে যেমন ঘৃণিত, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও সম্পূর্ণ অগ্রহণীয়; যা বিদেশে আমাদের দেশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করে। আইনবহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখল করার কারণেই সম্ভবত ১৯৯৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশকে জাতিসংঘ মিশনগুলোতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
পঁচাত্তর ও আশির দশকে আমাদের কয়েকজন জেনারেল যেভাবে সামরিক বাহিনীকে অমর্যাদাকর অবস্থানে নিয়ে গেছেন তাতে দেশের ভাবমূর্তি সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক সামরিক অফিসারকে এসব বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অন্যায় অভ্যুত্থানের কারণে জীবন দিতে হয়েছে। এটির পুনরাবৃত্তি যেন আর কখনও না ঘটে এবং গণতান্ত্রিক সরকারকে তাই আইন করে এ ধরনের সামরিক অভ্যুত্থানকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
এটি নিঃসন্দেহে সঠিক যে, শিক্ষা ও সভ্যতায় অগ্রসরমান দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধকালে এবং জরুরি অবস্থা ব্যতীত কখনোই সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করা হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশগুলোতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করানো রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য মর্যাদাকর মনে করা হয়। অনেক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক সিভিল সার্ভেন্সদের রাজনীতিতে naturalize করানো আমাদের দেশে এক ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শবিবর্জিত, আর্থিক সচ্ছলতার জন্য যারা রাজনীতিতে প্রবেশ করছেন তারা সত্যিকারের নিবেদিতপ্রাণ এবং স্বচ্ছ রাজনীতিবিদদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। এটি কিছুতেই কাম্য নয়। তবে এর জন্য কিছু কিছু রাজনীতিবিদের অদক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাব অনেকাংশে দায়ী। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জনকারী পরিশীলিত রাজনীতিবিদরাই রাজনীতিতে থাকবেন; এটাই স্বাভাবিক। তবে এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের হতে হবে শিক্ষিত, মার্জিত ও অভিজ্ঞ। আদর্শবিবর্জিত, অরুচিশীল ও দুর্নীতিগ্রস্ত এবং শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে রাজনীতিচর্চা অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই দেশের মানুষ চাইবে না, এটি মনে রাখতে হবে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকে অন্য প্রফেশনালদের তাদের বশংবদ মনে করে থাকেন; এই নীতি পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
ড. এএইচএম জেহাদুল করিম : বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্তন সদস্য; বর্তমানে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন
ahmzkarim@yahoo.com
No comments