বিলেতের স্ন্যাপশট-লন্ডনের দাঙ্গা ও বাঙালিদের দুশ্চিন্তার দিন by শামীম আজাদ

ঘটনাটার শুরুই যেন করেছে পুলিশ। আর এখন পুরো লন্ডন পুড়ছে। তিন দশকের মধ্যে এমন দেখেনি কেউ। দাউ দাউ জ্বলছে ফার্নিচার, কাঠ পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে, পুড়ছে বাচ্চাদের পড়ার ঘর ও পুতুল। আগুনে মোবাইল ওয়্যারহাউস জ্বলছে। লন্ডনের লুটেরারা সব নিয়ে গেছে।


সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে নবীন বণিক থেকে শুরু করে শতবর্ষের পুরোনো বনেদি ব্যবসা ও বাড়ি। গতকাল তা ছড়িয়ে পড়েছে বিলেতের দ্বিতীয় শহর বার্মিংহাম ছাড়াও নটিংহাম, উইলবার হ্যাম্পটন ও ব্রিস্টল অবধি। সামনে অলিম্পিক, আর একি অবস্থা! কে এ শহর রক্ষা করবে?
৭ আগস্ট পুলিশ যখন শুধু সন্দেহের কারণে মার্ক ড্যাগানকে গুলি করে, তখন সে ক্যাবে করে কোথাও যাচ্ছিল। কিন্তু সে একটি বন্দুক নিয়ে গুলি করতে যাচ্ছে সন্দেহে তাকেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়। এখন শুনছি, তার কাছে কোনো বন্দুক ছিল না। আর এ বিক্ষোভেই টটেনহামে আগুন লাগল। কিন্তু এসব গ্যাংয়ের খবর তো পুলিশের ভালোই জানা। তাদের কাজ নেই, খাবার নেই, পড়াশোনা নেই, বিনোদন বলতে অনেক রাত পর্যন্ত রাস্তায় ঘোরাঘুরি। বেকার টিনএজারদের কাছে এসে গেছে ড্রাগ ও ড্যাগার। মারধর থেকে ছিঁচকে চুরি—সবই মৌচাকের মতো ঘনবদ্ধ হয়ে উঠেছে তাদের এলাকায়। আর ঝামেলার সময় পুলিশের দেখা নেই।
আজ মনে পড়ছে এলথামের প্রতিশ্রুতিশীল ১৮ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ স্টিভেন লরেন্সের কথা। সে স্থপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু তা কোনো দিনই বাস্তব হলো না বর্ণবাদী পাঁচ শ্বেতাঙ্গ যুবকের আক্রমণে। ১৯৯৩ সালে বাসের জন্য অপেক্ষারত স্টিভেনকে তারা শুধু তার গায়ের রঙের কারণে কুপিয়ে হত্যা করে। আঠারো বছরে কত কী হলো। কিন্তু পুলিশের একপেশে অনুসন্ধানে অভিযুক্ত তিনজনের আজ অবধি কোনো সাজা হয়নি। নানা আক্ষেপ মানুষের মনে ছিল। দীর্ঘদিন ধরে তাই নিয়ে পুলিশ-মানুষে লাগালাগি চলছিল।
বুঝলাম, পুলিশও যে মানুষ! কিন্তু ভুল স্বীকার না করে তা কেন্দ্র করে আগুন লাগানো ও ভাঙচুরকেই গুরুত্ব দিয়ে দণ্ডিতকেই দায়ী করা কি সঠিক হলো? প্রথমত এসব কারণেই খেপে গিয়েছিল এলাকাবাসী। মার্ক ডেগ্যানের মৃত্যুতে সবাই মিলে যখন স্থানীয় পাদরির পরিচালনায় শোক জ্ঞাপন করছিল, তখনই তারা কথা প্রসঙ্গে স্থানীয় পুলিশদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে। একপর্যায়ে সেখান থেকেই শুরু হয় বিক্ষোভ ও ভাঙচুর। এ অনেকটা আমাদের দেশে ট্রাক এসে মানুষ পিষে দিয়ে গেলে যেভাবে স্থানীয়রা ভাঙচুর শুরু করে, সে রকম। ব্যাপারটি টোটেনহামের অশ্বেতাঙ্গ-অধ্যুষিত এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু যখন মানুষের ঘরবাড়ি আর সহায়-সম্পত্তি দাউ দাউ করে পুড়ছিল, তখন সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করল পুলিশের এক অদ্ভুত নিষ্ক্রিয়তা। সে লুটপাট ও ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল একটানা তিন দিন ধরে।
একে একে লুইশাম, ক্রয়ডন, এনফিল্ড, নিউহাম, পেকাম, বেথনাল গ্রিন পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আগুন জ্বলছে, লুটপাট চলছে—আশপাশে একটি পুলিশ নেই। খবর পেয়ে এক-দেড় ঘণ্টা পর পুলিশ আসছে। আর যখন পুলিশ আসছে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছে। শহরটা কার বোঝা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, নগর পিতা মেয়র হলিডেতে। পুরো লন্ডন লুটেরাদের দখলে আর তারা নিরোর মতো বাঁশি বাজাচ্ছেন বিলেতের কোনো বেলাভূমিতে। পুলিশের সামনে ব্যাংকের ক্যাশ মেশিন ভাঙছে মানুষ, টেসকো ডেবেনহাম লুট করছে। এরা পরিণত বয়সেরও না। বেশির ভাগেরই বয়স আঠারোর নিচে। এখন গ্রীষ্মের ছুটি। কাজ নেই। সুবিধাবঞ্চিতদের সব সুবিধা কাটতে কাটতে এমন অবস্থা যে তারা আজ রাস্তায় নেমেছে। লুটেরাদের মাথায় হুড, চোখে গগলস, পায়ে ভারী বুট। হাতে রড আর পকেটে মোবাইল। ওই মোবাইলেই টুইটারে টুইটারে তারা মেসেজ পাঠায়। এক জায়গায় পুলিশ দেখলে অন্য স্থানে শ শ একসঙ্গে হয়ে চালিয়েছে এই লুট। ল্যাপটপ, টেলিভিশন, ঘড়ি যা পাচ্ছে তা-ই নিয়ে গেছে। দেখে মনে হয়েছে, ওরাও জানে, পুলিশ আসলে তাদের ধরবে না।
পুলিশের কথা, ছয় হাজার লন্ডন পুলিশের সঙ্গে এসেক্স ও সাফোক্স থেকে আসা বাড়তি সতেরো শ পরিস্থিতি মোকাবিলার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করলে তা এভাবে ছড়ায়? অভিবাসী সম্প্রদায় এলাকাগুলোতেই কেন তারা ট্যাকল করতে পারল না? বোতল, ইট, রড, লাঠি নিয়ে এক শ থেকে পাঁচ শ টিনএজার ও তরুণের বিপরীতে পাঁচ হাজার প্রশিক্ষিত পরিণত বয়সী পুলিশ কিছু করতে পারল না, এটা ভাবতে কষ্ট হয়। তার চেয়ে বরং বর্তমান টোরি পার্টির অভ্যন্তরের ও অন্তরের নীতিমালার কারণে এটা হয়েছে ভাবা অনেক সহজ। ঘটনা ঘটার পর থেকেই পুলিশের সাফাই শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে টেলিভিশন বন্ধ করেছি। আজব ব্যাপার, হলিডে থেকে দ্রুত ফিরে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টেরেসা মেও তাই বলছেন। ‘পুলিশ অনেক সাহসী কাজ করেছে, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, তাদের একজন মারাও গেছে, আমরা খতিয়ে দেখছি কী কী ব্যবস্থা কার্যপ্রসূ হবে। তদন্ত করছি। আজই প্রধানমন্ত্রী এসে জরুরি মিটিংয়ে বসছেন...’ ইত্যাদি ইত্যাদি!
তাহলে ঘটনাটা কী দাঁড়াল—ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদেরই রক্ষা করে, যারা তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। এ সরকার অভিবাসীদের বন্ধু না, ভিন্ন রঙের মানুষকে এরা সমান চোখে দেখে না। ত্বকের রং ঘন হলেই তাদের তরুণদের যখন তখন ‘স্টপ অ্যান্ড সার্চ’ করে হাজতে পাঠায়।
এখন পর্যন্ত বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকা বলতে বেথনালগ্রিনের টেসকো পর্যন্ত লুট হয়েছে। শুনছি আমাদের হোয়াইট চ্যাপেলের সোনা ও শাড়ির দোকান লুট করতে পারে। আগে থেকেই আমরা ইংলিশ ডিফেন্স লীগের বর্ণবাদী কার্যক্রমের হুমকির মুখে ছিলাম। আজকের দিন আমাদের জন্য বড়ই দুশ্চিন্তার।
এত বড় কাণ্ড হয়ে গেল, প্রধানমন্ত্রী হলিডে থেকে টুঁ শব্দ করেননি। ঠিক নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ভ্র-এর ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারির সময় যেমন সাউথ আফ্রিকা থেকে করেছেন। তখন তার ঘনিষ্ঠ সহচর কোলসন আর রেবেকা ব্রুককে নিয়ে মহা চাপে পড়ে একসময় দেশে ফিরে আসেন। আজ তিনি দেশে—কিন্তু কী করবেন, কিছু করবেন কি!
লন্ডন ৯ আগস্ট ২০১১
শামীম আজাদ: কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.