মত দ্বিমত-নতুন ব্যাংক হলে প্রতিযোগিতা বাড়বে by মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

দেশে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিতর্ক চলছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বলেছেন, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন ব্যাংক খোলার প্রয়োজন আছে কি নেই, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ও সালেহউদ্দিন আহমেদ-এর অভিমত প্রকাশ করা হলো।


দেশে নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা নিয়ে যে রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। কারণ, ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, বিষয়টি একেবারেই অর্থনৈতিক।
অস্বীকার করা যাবে না, বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি ক্রমে বাড়ছে। জনগণের মূলধনের পরিমাণও বাড়ছে; বাড়ছে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স (প্রবাসী-আয়)। আগে বিদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে প্রবাসীরা নিরুৎসাহী ছিলেন। প্রাপকের কাছে অর্থ পৌঁছাতে বিলম্ব হতো। এখন কিন্তু সে অবস্থা নেই।
অন্যান্য খাতের মতো ব্যাংকিং খাতে সুষ্ঠু ও সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে সেই প্রতিযোগিতা এখনো গড়ে ওঠেনি। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা থাকলে সুদের হার নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হতো না। প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই সুদের হার নির্ধারিত হতো। দেশে বর্তমানে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৪৭টি। এর মধ্যে বেসরকারি ৩০টি এবং বিদেশি মালিকানাধীন নয়টি। সব ব্যাংক মিলেও কিন্তু চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাত যে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, তার প্রমাণ কয়েক বছর আগেও যেসব ব্যাংক লোকসান দিত বা সামান্য মুনাফা করত, এখন তাদের কোনো কোনোটি বছরে হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত মুনাফা করছে।
দেশে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন আছে কি নেই, সেটি দেখতে হবে গ্রাহকসেবা দিয়ে। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানে যেখানে ব্যাংকের একটি শাখা ১৫ থেকে ১৬ হাজার মানুষকে সেবা দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে দিচ্ছে ২২ হাজার মানুষকে। এ সংখ্যাটি ভারত ও পাকিস্তানের পর্যায়ে নিয়ে আসতে হলেও নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। তবে আইন অনুযায়ী কাজটি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, মন্ত্রণালয় নয়।
তবে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। ব্যাংকের শাখা শহরাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হলে চলবে না। গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামো সুদৃঢ় করতে এবং মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে গ্রামাঞ্চলে আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে, নতুন নতুন শাখা খুলতে হবে। বর্তমানে যেকোনো ব্যাংকের জন্য শহরাঞ্চলে চারটি শাখা খুললে গ্রামাঞ্চলে একটি শাখা খোলা বাধ্যতামূলক। এই হার সমান সমান হওয়া উচিত। শহরাঞ্চলে একটি শাখার বিপরীতে গ্রামেও একটি শাখা খুলতে হবে।
ব্যাংকের মূলধনের অপ্রতুলতা সম্পর্কে প্রায়ই যে অভিযোগ শোনা যায়, এর কারণ ব্যাংকের সংখ্যা নয়, ব্যাংক আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। এ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে যদি একটি বা দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়, ক্ষতি নেই। অনেক দেশে দেখা যায়, দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও বা সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংককে অধিগ্রহণ করে নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যাংক অধিগ্রহণ বা একীভূত করার কোনো আইন নেই। এ আইনটি হওয়া জরুরি। তাহলে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে সরকারকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। প্রশাসক বসিয়ে লোকসানি ব্যাংক সচল রাখারও দরকার হবে না। ব্যাংকিংয়ের স্বাভাবিক নিয়মেই এগুলো যৌক্তিক পরিণতি পাবে।
বিসিসিআই ব্যাংক বন্ধের সময় আমাদের দেশ ভালো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই ব্যাংকের অনেক গ্রাহক ফতুর হলেও বাংলাদেশের সব গ্রাহকই তাঁদের সমুদয় পাওনা ফিরে পেয়েছেন।
দেশে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন আছে বলেই উদ্যোক্তারা নতুন ব্যাংক খুলতে চাইছেন। এসব ব্যাংক খোলার অনুমতি কারা পাবেন, সেসব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উদ্যোক্তাদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু তাঁরা যখন ব্যাংকিং সেবায় নিয়োজিত হবেন, তখন এর আইনকানুন মেনেই তা করবেন। নতুন ব্যাংক অনুমোদনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে আইন, মূল্যায়ন ও তদারকির ব্যবস্থা আছে, সেগুলো ঠিকমতো অনুসরণ করলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
বিগত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আমলে বেশ কিছু নতুন ব্যাংক হয়েছে এবং বেশির ভাগই ভালো ব্যবসা করছে। ১৯৯৬-২০০১ সালে যে ১২টি নতুন ব্যাংকের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, এর উদ্যোক্তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন রাজনীতির বাইরের মানুষও। সে সময়ে ব্র্যাক ব্যাংক অনুমতি পেয়েছিল, ট্রাস্ট ব্যাংক অনুমতি পেয়েছিল; সেগুলোর উদ্যোক্তারা কিন্তু আওয়ামী লীগের কেউ নন। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারেন। কিন্তু ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কাম্য নয়।
তবে আমি মনে করি, নতুন ও পুরোনো সব ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তথা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তাঁর কর্মীবাহিনীর দায়িত্ব কি, সেটি স্পষ্ট নয়। অনেক সময়ই এ নিয়ে বিরোধও লক্ষ করা যায়।
আমি মনে করি, পরিচালনা পর্ষদ নীতি নির্ধারণ করবে, দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা নেবে আর সেই নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তাঁর কর্মীবাহিনী। কিন্তু আমাদের এখানে পরিচালনা পর্ষদকে অনেক সময় ঋণ দান নিয়েই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। কিন্তু ঋণ প্রস্তাব বিবেচনার কাজ তো তাদের নয়, এটি করবে ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এবং তারা অবশ্যই পরিচালনা পর্ষদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।
দ্বিতীয়ত, সবকিছু কেন্দ্রীভূত না করে অনেক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ও ঢাকার বাইরে হতে পারে। কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় থাকার যৌক্তিকতা নেই।
আরেকটি কথা, দেশের ব্যাংকিং খাত যদি দুর্বলই হবে, তাহলে প্রতিবছর তারা এত বিপুল পরিমাণ ব্যবসা কীভাবে করে? কেবল দেশি নয়, বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোও ভালো ব্যবসা করছে। শেয়ারবাজারেও ব্যাংকগুলোর রয়েছে শক্ত অবস্থান। নতুন ব্যাংক হলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। কর্মসংস্থান বাড়বে। প্রতিযোগিতায় যারা ভালো করবে, তারা টিকে থাকবে। এতে আশঙ্কার কিছু নেই।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।

No comments

Powered by Blogger.