মানুষের মুখ-হাঁটছেন হাতেম আলী by আজাদুর রহমান
মনের জোর বাড়াতে যাঁরা চুলে কলপ করেন, রঙিন চশমায় বয়স আটকাতে চান, হাতেম আলী তাঁদের মতো নন। চুল-দাড়ির সঙ্গে পীড়াপীড়ি করে লাভ নেই। শরীরে কালের দাগ পড়বেই। চুল আপনিতেই পেকে যাবে। নড়বড়ে দাঁত সময়ে খুলেও যাবে।
অহেতুক চিন্তায় মাথা খারাপ করে লাভ কী! নিয়মের অমোঘ হাতে সবকিছুই বিদায় জানাবে একদিন শরীর থেকে। ছানি চোখে নিয়ে হাতেম আলী তাই ভাবেন না। মানুষের মেলা তাঁর ভালো লাগে। মুখে রসাল পান আর লাল-নীল রকমারি কাগুজে তোড়া লাঠিতে গেঁথে তিনি বাড়ি থেকে বের হন। মাথায় বলয় তোলা হ্যাট। কাঁধে ঝুলন্ত কাপড়ের ব্যাগভর্তি হরেক খেলনা। বৃদ্ধ বয়সেও তাঁকে ঠিক রঙিলাই লাগে।
মানুষের ময়দানে ঘুরে ঘুরে চলে ঝকমারি বেচা-বিক্রি। আনন্দ লাগে যখন বাচ্চারা বায়না ধরে। নেড়েচেড়ে বলে, বাহ্, খুব সুন্দর তো! কেউ আবার পাশে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলেন। সারা দিন দুপায়ে দাঁড়িয়ে আনন্দ বিলি করে তিনি ফিরে যান নিজের গর্তে, মানে মুজিবনগরের ভবেরপাড়ায়। রুটিন করা পেশা। নিজেই সব বানান। স্ত্রী রমেনাও পুরোদমে হাত লাগান। হাতের তালুতে তৈরি হয় কাগজের নৌকো। বাহারি সাপ আর নানা জাতের ফুল। ফুলের কারবার করতে করতে লোকে বলে ফুলওয়ালা।
প্রাচীনরা পরিচয় করায় দরজি বলে। হাতেম আলী অর্ধেক জীবন পার করেছেন দরজিগিরি করে। পুরোনো কথা ভালোই মনে আছে তার, ‘দরজিগিরি কত্তাম। শোনেন, যেমন শার্টের মেরুদণ্ড হলো বুকপকেট আর কলার। দুইটার ওপরই মানুষের নজর পড়ে। অন্যদিকে ফুলপ্যান্টের হিপ-পকেট আর বেল্টের কাজটাই কঠিন। বাদবাকি সাধারণ জ্ঞানে, মনে করেন লুঙ্গি সেলাই করার মতো।’ ছাড়লেন কেন, প্রশ্ন করলাম। ‘পঁচিশ বছর একটানে চালাতে গিয়ে চোখ আর চলল না। সেলাইয়ের লাইন ধরতে পারলাম না। কিন্তু কাজ ছাড়া তো আমার কোনো পথ নেই। রুজির পথ খুঁজতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে একদিন এক মেলায় ঢুকে পড়লাম। রঙিন খেলনা আর কাগজের কারুকাজ দেখে মনটা ছলছল করে উঠল। কাগুজে ফুল কিনে নিজেই বানাতে বসলাম। ইচ্ছে থাকলে সব পারে মানুষ।’
হাতেম একটানা বলেই যাচ্ছিলেন। থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম, ওস্তাদ ছাড়া কাগজের সাপ, গোলাপ, শাপলা, ফল, ছাতা, পাখি—এত সব বানালেন কী করে। ‘যেমন ধরেন, ময়নার খাঁচাটা যে বানাইছি, এ তো এক দিনে হয়নি। এসবের জন্য অন্তর চোখ লাগে। দুই ধরনের ওস্তাদ আছে। বাহ্যিক আর আন্তরিক ওস্তাদ। বাহ্যিক ওস্তাদের কাছে ছবিটা কেবল দেখিয়ে নিতে হয়। মূল কাজ হলো ভেতরে ভেতরে, মানে আন্তরিক ওস্তাদ দিয়ে করতে হয়। তবে যিনি বাহ্যিক গুরু, তাঁকে অমান্য করি না। তাঁকে খুব সম্মানে রাখি।’
শুনতে শুনতে কৌতূহলী হলাম, এই বয়সেও এমন বোহেমিয়ান, আনন্দ-ভাব! এমন কথা শুনে হাতেম যেন আরও চঞ্চল হলেন, ‘সব হলো মনের ব্যাপার, বাপ। একদিন তো মরেই যাব। মনের দিক থেকে ছোট হয়ে লাভ কী? আনন্দে থাকাই তো ভালো। তা ছাড়া নামাজ পড়ি। সর্বদা আল্লাহর নাম স্মরণে রাখি। বড় কথা হলো, আমার মিছে কথা বলার দরকার হয় না। মিথ্যে পথে যন্ত্রণা আছে। আমার কাছে কোনো ডুপ্লিকেট কথা পাবেন না। আমি তো কারও কারবারে নাই।’
শিল্পকে মধুরভাবে ভালোবাসেন হাতেম। সৃষ্টিশীল যেকোনো কারুকাজকেই বড় করে দেখেন তিনি, ‘যেসব ছেলেপিলে ছবি আঁকে, তারা খুব জ্ঞানদার। জ্ঞানবান ভালো ভালো ছেলেমেয়েই তো ছবি আঁকে।’
স্ত্রীর কথা বলতে বলতে নিজ থেকেই হাহাকার করে উঠলেন, ‘বাবাজি, তোমার চাচির জন্য খুব আনন্দে আছি। শান্তিতে আছি। সেও তো আমার জন্যি শান্ত আছে। কে যে কার বড় কোনো হিসেব নেই। নিজে বললে তো আকর্ষণ হয় না। তবুও কেছো কথা বলতে হয়। আমাদের ঘরে যদি পানিও পড়ে তাতেও শান্তি। কোনো জ্বালা নেই। স্ত্রীর গুণাগুণের কাছে আমি কিছু না। বড় ঘরের মেয়ে, কোনো অহংকার নেই।’ খামোখাই প্রশ্ন করলাম, একটাই বিয়ে করেছেন? হাতেম আলী বেজার হলেন না, সুন্দর করে ব্যাখ্যা করলেন, ‘ঊনচল্লিশ সেরে তো মণ হয় না। চল্লিশ সেরে মণ। মনটা পুরো দিয়ে দিলে তো আর কিছু থাকে না বাপ।’
একসময় মনের আনন্দে শিল্পের কাজ ধরেছিলেন। কিন্তু এখন সত্তর বছরে দাঁড়িয়ে তিনি আর পারেন না। চোখের সমস্যা হয়। অভাবের কথায় গিয়ে আফসোস করে ওঠেন তিনি, ‘মনে চায় কেউ যদি বলত, দুবালতি পানি এনে দাও, ছাগল চড়াও কিংবা বাগানবাড়ি দেখাশোনা করো, তাহলে বড় ভালো হয়। বুড়ো বয়সে পরিশ্রমের কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। নিরাশায় বসে আছি। যদি চাল ডাল কিছু পাওয়া যেত, তাহলে খুব ভালো হতো।’
আজাদুর রহমান
মানুষের ময়দানে ঘুরে ঘুরে চলে ঝকমারি বেচা-বিক্রি। আনন্দ লাগে যখন বাচ্চারা বায়না ধরে। নেড়েচেড়ে বলে, বাহ্, খুব সুন্দর তো! কেউ আবার পাশে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলেন। সারা দিন দুপায়ে দাঁড়িয়ে আনন্দ বিলি করে তিনি ফিরে যান নিজের গর্তে, মানে মুজিবনগরের ভবেরপাড়ায়। রুটিন করা পেশা। নিজেই সব বানান। স্ত্রী রমেনাও পুরোদমে হাত লাগান। হাতের তালুতে তৈরি হয় কাগজের নৌকো। বাহারি সাপ আর নানা জাতের ফুল। ফুলের কারবার করতে করতে লোকে বলে ফুলওয়ালা।
প্রাচীনরা পরিচয় করায় দরজি বলে। হাতেম আলী অর্ধেক জীবন পার করেছেন দরজিগিরি করে। পুরোনো কথা ভালোই মনে আছে তার, ‘দরজিগিরি কত্তাম। শোনেন, যেমন শার্টের মেরুদণ্ড হলো বুকপকেট আর কলার। দুইটার ওপরই মানুষের নজর পড়ে। অন্যদিকে ফুলপ্যান্টের হিপ-পকেট আর বেল্টের কাজটাই কঠিন। বাদবাকি সাধারণ জ্ঞানে, মনে করেন লুঙ্গি সেলাই করার মতো।’ ছাড়লেন কেন, প্রশ্ন করলাম। ‘পঁচিশ বছর একটানে চালাতে গিয়ে চোখ আর চলল না। সেলাইয়ের লাইন ধরতে পারলাম না। কিন্তু কাজ ছাড়া তো আমার কোনো পথ নেই। রুজির পথ খুঁজতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে একদিন এক মেলায় ঢুকে পড়লাম। রঙিন খেলনা আর কাগজের কারুকাজ দেখে মনটা ছলছল করে উঠল। কাগুজে ফুল কিনে নিজেই বানাতে বসলাম। ইচ্ছে থাকলে সব পারে মানুষ।’
হাতেম একটানা বলেই যাচ্ছিলেন। থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম, ওস্তাদ ছাড়া কাগজের সাপ, গোলাপ, শাপলা, ফল, ছাতা, পাখি—এত সব বানালেন কী করে। ‘যেমন ধরেন, ময়নার খাঁচাটা যে বানাইছি, এ তো এক দিনে হয়নি। এসবের জন্য অন্তর চোখ লাগে। দুই ধরনের ওস্তাদ আছে। বাহ্যিক আর আন্তরিক ওস্তাদ। বাহ্যিক ওস্তাদের কাছে ছবিটা কেবল দেখিয়ে নিতে হয়। মূল কাজ হলো ভেতরে ভেতরে, মানে আন্তরিক ওস্তাদ দিয়ে করতে হয়। তবে যিনি বাহ্যিক গুরু, তাঁকে অমান্য করি না। তাঁকে খুব সম্মানে রাখি।’
শুনতে শুনতে কৌতূহলী হলাম, এই বয়সেও এমন বোহেমিয়ান, আনন্দ-ভাব! এমন কথা শুনে হাতেম যেন আরও চঞ্চল হলেন, ‘সব হলো মনের ব্যাপার, বাপ। একদিন তো মরেই যাব। মনের দিক থেকে ছোট হয়ে লাভ কী? আনন্দে থাকাই তো ভালো। তা ছাড়া নামাজ পড়ি। সর্বদা আল্লাহর নাম স্মরণে রাখি। বড় কথা হলো, আমার মিছে কথা বলার দরকার হয় না। মিথ্যে পথে যন্ত্রণা আছে। আমার কাছে কোনো ডুপ্লিকেট কথা পাবেন না। আমি তো কারও কারবারে নাই।’
শিল্পকে মধুরভাবে ভালোবাসেন হাতেম। সৃষ্টিশীল যেকোনো কারুকাজকেই বড় করে দেখেন তিনি, ‘যেসব ছেলেপিলে ছবি আঁকে, তারা খুব জ্ঞানদার। জ্ঞানবান ভালো ভালো ছেলেমেয়েই তো ছবি আঁকে।’
স্ত্রীর কথা বলতে বলতে নিজ থেকেই হাহাকার করে উঠলেন, ‘বাবাজি, তোমার চাচির জন্য খুব আনন্দে আছি। শান্তিতে আছি। সেও তো আমার জন্যি শান্ত আছে। কে যে কার বড় কোনো হিসেব নেই। নিজে বললে তো আকর্ষণ হয় না। তবুও কেছো কথা বলতে হয়। আমাদের ঘরে যদি পানিও পড়ে তাতেও শান্তি। কোনো জ্বালা নেই। স্ত্রীর গুণাগুণের কাছে আমি কিছু না। বড় ঘরের মেয়ে, কোনো অহংকার নেই।’ খামোখাই প্রশ্ন করলাম, একটাই বিয়ে করেছেন? হাতেম আলী বেজার হলেন না, সুন্দর করে ব্যাখ্যা করলেন, ‘ঊনচল্লিশ সেরে তো মণ হয় না। চল্লিশ সেরে মণ। মনটা পুরো দিয়ে দিলে তো আর কিছু থাকে না বাপ।’
একসময় মনের আনন্দে শিল্পের কাজ ধরেছিলেন। কিন্তু এখন সত্তর বছরে দাঁড়িয়ে তিনি আর পারেন না। চোখের সমস্যা হয়। অভাবের কথায় গিয়ে আফসোস করে ওঠেন তিনি, ‘মনে চায় কেউ যদি বলত, দুবালতি পানি এনে দাও, ছাগল চড়াও কিংবা বাগানবাড়ি দেখাশোনা করো, তাহলে বড় ভালো হয়। বুড়ো বয়সে পরিশ্রমের কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। নিরাশায় বসে আছি। যদি চাল ডাল কিছু পাওয়া যেত, তাহলে খুব ভালো হতো।’
আজাদুর রহমান
No comments