সফলদের স্বপ্নগাথা-সবার অধিকার সমান by রোজা পার্কস
আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে রোজা পার্কসের অবদান বিশ্বজুড়ে তাঁকে অমর করে রেখেছে। ১৯১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া আফ্রো-আমেরিকান এই মানবাধিকারকর্মী মৃত্যুবরণ করেন ২৪ অক্টোবর ২০০৫ সালে আমার শৈশব কেটেছে অনেক কিছু সহ্য করার মধ্য দিয়ে।
আমার মা ও তাঁর পরিবার আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আমার মা ছিলেন ছোট্ট একটি স্কুলের শিক্ষক, যিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমান অধিকারের আকাঙ্ক্ষাকে। বর্ণবাদ ও বৈষম্যমূলক আইনগত বিভিন্ন বাধা-নিষেধের মধ্য দিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে—সেটা তিনি কখনোই সমর্থন করতেন না। মায়ের সেই ছোট্ট স্কুলে বছরের নয় মাসের জায়গায় ক্লাস হতো পাঁচ মাস। কিন্তু আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে সে দিনগুলো। বই পড়ার প্রতি আমার নেশা ছিল প্রবল। মা-ও অবশ্য স্কুলে যাওয়ার আগে থেকেই বই পড়ার এমন আসক্তিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন।
আমি গ্রেপ্তার হই ১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর। সামনের দিকে শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত স্থান ছেড়ে না দেওয়ার জন্য। যদিও অনেকে লিখেছে এবং জানিয়েছিল যে আমি ওই দিন বাসের সামনের আসনে বসে ছিলাম, কিন্তু সেটা আসলে ঠিক না। সেদিন আমি বাসের শেষপ্রান্তে একটি সিট নিয়ে বসেছিলাম, যেখানে কিছু শ্বেতাঙ্গও ছিল। সামনের দুই-তিন স্টপেজে কোনো ঝামেলা হয়নি। ঝামেলাটা হলো যখন তৃতীয় স্টপেজ থেকে বেশ কজন শ্বেতাঙ্গ বাসে উঠল। কেউ কেউ বসার জায়গা পেল আর একজন দাঁড়িয়ে ছিল। বাস ড্রাইভার যখন সেটা লক্ষ করে, সে আমাকে উঠে দাঁড়িয়ে তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে বলল। তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ কিছু দ্বিধায় পড়ে উঠে দাঁড়াল। বাস ড্রাইভার তখন জানতে চাইল, আমি কেন দাঁড়াচ্ছি না, এর ফলে আমি কিন্তু গ্রেপ্তারও হতে পারি। আমি বলেছিলাম, আমি দাঁড়াব না এবং শেষ অবধি আমাকে গ্রেপ্তার করাও হয়।
বাস ড্রাইভার সোজা বাস থেকে নেমে পুলিশকে জানাল। কিছু কৃষ্ণাঙ্গও আমার সঙ্গে বাস থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু কোনো শ্বেতাঙ্গ সেদিন এগিয়ে আসেনি। দুজন পুলিশ ঘটনার সত্যতার পাশাপাশি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন আমি উঠে দাঁড়াইনি। আমি বলেছিলাম, আমার মনে হয়নি যে আমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে, কেনই বা আমাকে বাধ্য করা হবে? তারা জানাল, আইন আইনই এবং তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। বাস ড্রাইভার তার দায়িত্ব পালন করে, দিন শেষে আমার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে গেল।
আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলাম বৃহস্পতিবার বিকেলে। শুক্রবার বিকেলে ডেক্টর এভিনিউ ব্যাপটিস্ট চার্চে একটি সভা আহ্বান করা হয়, সেখানে ড. মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র) ছিলেন একজন যাজক। বেশ কিছু নাগরিক সুধীর কাছে আমি আমার অভিজ্ঞতা বলি, যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায়। আমার শুনানি ছিল ডিসেম্বর ৫ এবং আমাকে অপরাধী হিসেবেও বিচার শোনানো হয়। ফ্রেড গ্রে ও চার্লস ল্যাংফোর্ড একটি আপিল দায়ের করেন। আমি কিন্তু কোনো জরিমানাও দিইনি। আবারও সভা বসে হোল্ট স্ট্রিট ব্যাপটিস্ট চার্চে। সেদিন মনে হয়, পুরো শহরে অধিকাংশ মানুষ বাসে চড়েনি। এই এক দিনের প্রতিবাদ মোটামুটি স্থির করে দেয়, আমার বিরুদ্ধে চার্জ এবং ভালো কিছুর মধ্য দিয়ে এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে কেউ বাসে উঠবে না।
আমার ঠিক মনে নেই, তখন আমার অনুভূতি কেমন ছিল—রাগ না অন্য কিছু। তবে আমি দৃঢ় ছিলাম, এই সুযোগের মধ্য দিয়ে দীর্ঘকালীন আমাদের এ ভোগান্তি এবং অধিকারবঞ্চিত হওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। সেভাবেই আমরা আমাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাই। গঠন করি মন্টেগোমারি উন্নয়ন অ্যাসোসিয়েশন। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে একাত্ম হন ড. মার্টিন লুথার কিং। পরবর্তী সময়ে তিনি এই অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র এবং সভাপতি নির্বাচিত হন।
যখন আমি সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে যাই, আমার অনুতাপ নয়, ভেতরে অসম্ভবভাবে যা আন্দোলিত করে তা হলো, কেন এমন একটি অধিকার প্রতিষ্ঠায় একত্র হতে এত সময় লাগল। সবাইকে সমান অধিকার ও সম্মান দেওয়ার জন্য আমরা কেন এত দীর্ঘ সময় লাগালাম।
বড় হওয়ার পর মন্টেগোমারির বর্ণবৈষম্যবাদ আইনি বিধিনিষেধে আমার জীবন কাটছিল কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আমি অনুভব করেছি, একটি স্বাধীন ও বীরের দেশেও আমাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। আমার সেই এক দিনের প্রতিবাদই সবার মধ্যে অধিকার-সচেতনতা তৈরি করেছে। তারা নাগরিক অধিকার আদায়ে পরবর্তী এক বছরে দেশে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। আমি সেই দিনগুলোতে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে আনন্দিত, যা মানুষকে স্বাধীনতাবোধ জাগাতে সাহায্য করেছে—যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যান্য দেশেও।
১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় পার্ক ইনস্টিটিউট। এখানে আমরা কাজ করি ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী তরুণদের নিয়ে। আমাদের মূল লক্ষ্য, সবার জন্য স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া, যাকে নিয়ে আমরা কাজ করছি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। আমরা তাদের অধিকার-সচেতন করে গড়ে তুলতে চাই। তারা জানবে নিজেদের ইতিহাস ও গৌরবময় আন্দোলনকে এবং জাগিয়ে তুলবে অন্তরাত্মাকে।
তরুণদের জন্য আমার আহ্বান, নিজেদের সব ধরনের পক্ষপাত থেকে ঊর্ধ্বে রাখা। অন্যের জন্য নিবেদিত করে দিতে হবে নিজেদের এবং অবশ্যই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের জীবনকে গড়ে নেওয়ার জন্য সুযোগ তৈরি করে নিতে হবে। আমাদের দিনগুলোতে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। বর্তমানে তরুণদের সুযোগের অভাব নেই, যার যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করে নিতে হবে তাদেরই। জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন, সর্বদা ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে, ভাবতে হবে অন্যদের নিয়ে। কখনোই অনুভূতিপ্রবণতায় নেশার প্রতি আশক্ত হওয়া চলবে না। নিজেদের চিন্তাশীল করে তুলতে সময় দাও নিজের মন-মানসিকতাকে।
একাডেমি অব অ্যাচিভমেন্ট থেকে পাওয়া, ১৯৯৫ সালের সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ: শিখ্তী সানী
আমি গ্রেপ্তার হই ১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর। সামনের দিকে শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত স্থান ছেড়ে না দেওয়ার জন্য। যদিও অনেকে লিখেছে এবং জানিয়েছিল যে আমি ওই দিন বাসের সামনের আসনে বসে ছিলাম, কিন্তু সেটা আসলে ঠিক না। সেদিন আমি বাসের শেষপ্রান্তে একটি সিট নিয়ে বসেছিলাম, যেখানে কিছু শ্বেতাঙ্গও ছিল। সামনের দুই-তিন স্টপেজে কোনো ঝামেলা হয়নি। ঝামেলাটা হলো যখন তৃতীয় স্টপেজ থেকে বেশ কজন শ্বেতাঙ্গ বাসে উঠল। কেউ কেউ বসার জায়গা পেল আর একজন দাঁড়িয়ে ছিল। বাস ড্রাইভার যখন সেটা লক্ষ করে, সে আমাকে উঠে দাঁড়িয়ে তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে বলল। তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ কিছু দ্বিধায় পড়ে উঠে দাঁড়াল। বাস ড্রাইভার তখন জানতে চাইল, আমি কেন দাঁড়াচ্ছি না, এর ফলে আমি কিন্তু গ্রেপ্তারও হতে পারি। আমি বলেছিলাম, আমি দাঁড়াব না এবং শেষ অবধি আমাকে গ্রেপ্তার করাও হয়।
বাস ড্রাইভার সোজা বাস থেকে নেমে পুলিশকে জানাল। কিছু কৃষ্ণাঙ্গও আমার সঙ্গে বাস থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু কোনো শ্বেতাঙ্গ সেদিন এগিয়ে আসেনি। দুজন পুলিশ ঘটনার সত্যতার পাশাপাশি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন আমি উঠে দাঁড়াইনি। আমি বলেছিলাম, আমার মনে হয়নি যে আমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে, কেনই বা আমাকে বাধ্য করা হবে? তারা জানাল, আইন আইনই এবং তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। বাস ড্রাইভার তার দায়িত্ব পালন করে, দিন শেষে আমার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে গেল।
আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলাম বৃহস্পতিবার বিকেলে। শুক্রবার বিকেলে ডেক্টর এভিনিউ ব্যাপটিস্ট চার্চে একটি সভা আহ্বান করা হয়, সেখানে ড. মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র) ছিলেন একজন যাজক। বেশ কিছু নাগরিক সুধীর কাছে আমি আমার অভিজ্ঞতা বলি, যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায়। আমার শুনানি ছিল ডিসেম্বর ৫ এবং আমাকে অপরাধী হিসেবেও বিচার শোনানো হয়। ফ্রেড গ্রে ও চার্লস ল্যাংফোর্ড একটি আপিল দায়ের করেন। আমি কিন্তু কোনো জরিমানাও দিইনি। আবারও সভা বসে হোল্ট স্ট্রিট ব্যাপটিস্ট চার্চে। সেদিন মনে হয়, পুরো শহরে অধিকাংশ মানুষ বাসে চড়েনি। এই এক দিনের প্রতিবাদ মোটামুটি স্থির করে দেয়, আমার বিরুদ্ধে চার্জ এবং ভালো কিছুর মধ্য দিয়ে এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে কেউ বাসে উঠবে না।
আমার ঠিক মনে নেই, তখন আমার অনুভূতি কেমন ছিল—রাগ না অন্য কিছু। তবে আমি দৃঢ় ছিলাম, এই সুযোগের মধ্য দিয়ে দীর্ঘকালীন আমাদের এ ভোগান্তি এবং অধিকারবঞ্চিত হওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। সেভাবেই আমরা আমাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাই। গঠন করি মন্টেগোমারি উন্নয়ন অ্যাসোসিয়েশন। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে একাত্ম হন ড. মার্টিন লুথার কিং। পরবর্তী সময়ে তিনি এই অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র এবং সভাপতি নির্বাচিত হন।
যখন আমি সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে যাই, আমার অনুতাপ নয়, ভেতরে অসম্ভবভাবে যা আন্দোলিত করে তা হলো, কেন এমন একটি অধিকার প্রতিষ্ঠায় একত্র হতে এত সময় লাগল। সবাইকে সমান অধিকার ও সম্মান দেওয়ার জন্য আমরা কেন এত দীর্ঘ সময় লাগালাম।
বড় হওয়ার পর মন্টেগোমারির বর্ণবৈষম্যবাদ আইনি বিধিনিষেধে আমার জীবন কাটছিল কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আমি অনুভব করেছি, একটি স্বাধীন ও বীরের দেশেও আমাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। আমার সেই এক দিনের প্রতিবাদই সবার মধ্যে অধিকার-সচেতনতা তৈরি করেছে। তারা নাগরিক অধিকার আদায়ে পরবর্তী এক বছরে দেশে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। আমি সেই দিনগুলোতে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে আনন্দিত, যা মানুষকে স্বাধীনতাবোধ জাগাতে সাহায্য করেছে—যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যান্য দেশেও।
১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় পার্ক ইনস্টিটিউট। এখানে আমরা কাজ করি ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী তরুণদের নিয়ে। আমাদের মূল লক্ষ্য, সবার জন্য স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া, যাকে নিয়ে আমরা কাজ করছি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। আমরা তাদের অধিকার-সচেতন করে গড়ে তুলতে চাই। তারা জানবে নিজেদের ইতিহাস ও গৌরবময় আন্দোলনকে এবং জাগিয়ে তুলবে অন্তরাত্মাকে।
তরুণদের জন্য আমার আহ্বান, নিজেদের সব ধরনের পক্ষপাত থেকে ঊর্ধ্বে রাখা। অন্যের জন্য নিবেদিত করে দিতে হবে নিজেদের এবং অবশ্যই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের জীবনকে গড়ে নেওয়ার জন্য সুযোগ তৈরি করে নিতে হবে। আমাদের দিনগুলোতে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। বর্তমানে তরুণদের সুযোগের অভাব নেই, যার যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করে নিতে হবে তাদেরই। জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন, সর্বদা ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে, ভাবতে হবে অন্যদের নিয়ে। কখনোই অনুভূতিপ্রবণতায় নেশার প্রতি আশক্ত হওয়া চলবে না। নিজেদের চিন্তাশীল করে তুলতে সময় দাও নিজের মন-মানসিকতাকে।
একাডেমি অব অ্যাচিভমেন্ট থেকে পাওয়া, ১৯৯৫ সালের সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ: শিখ্তী সানী
No comments