সময়ের প্রেক্ষিত-বাংলার প্রতি জাপানের অন্য রকম শ্রদ্ধা by মনজুরুল হক

দেশের বাইরে প্রবাসী বাঙালি সমাজে শহীদ দিবস উদ্যাপিত হওয়ার মধ্যে এখন আর নতুনত্বের কোনো ছাপ দেখা যায় না। যদিও আমাদের ইতিহাসের খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ভিন্ন একটি মাত্রা ইদানীং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।


সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে তৈরি হয়েছে আমাদের নিজস্ব শহীদ মিনার, একুশের প্রত্যুষে যেখানে গিয়ে ফুল রেখে আসাটাও তাই এখন হয়ে উঠেছে প্রবাসীদের অনেকের জীবনের আবশ্যকীয় অংশ। সেই সঙ্গে সভা-সমিতিরও নেই কমতি, যেখানে নিয়মিতভাবে প্রবাসী নেতারা ব্যক্ত করছেন বাংলার প্রতি তাঁদের ভালোবাসার অঙ্গীকার। পাশাপাশি আরও আছে নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। ফলে গতানুগতিক ধারার সেসব অনুষ্ঠান সংবাদমূল্যের দিক থেকে হয়ে উঠেছে অনেকটাই যেন পুনরাবৃত্তিমূলক অর্থাৎ একই ছাঁচে ফেলে দিয়ে শুধু দিন-তারিখ আর ব্যক্তিবর্গের নাম-পরিচয় রদবদল করে প্রতিবছর একই সংবাদ প্রচার করে গেলেও ভুল হওয়া কিংবা বিচ্যুতির আশঙ্কা যেখানে তেমন একটা নেই। তবে এই ছাঁচেঢালা সংবাদসুলভ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যেও যে দু-একটি ব্যতিক্রম এদিকে-সেদিকে চোখে পড়ে না, তা অবশ্য নয়। আর এ রকম কিছু ব্যতিক্রম আছে বলেই দিনটি কোনো অবস্থায়ই হারিয়ে ফেলেনি এর উজ্জ্বলতা।
টোকিওতে এবারের শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সে রকম অর্থেই ছিল কিছুটা ব্যতিক্রমী, যা কিনা দিনটির গুরুত্ব ভিন্নতার সেই স্বাদ নিয়ে আরও অনেক বেশি সার্থকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে জাপানিদের সামনে। ফলে বলা যায়, ভাষাশহীদদের স্মরণ করার এই দিনটি পালনে প্রচলিত ধারা থেকে বের হয়ে এসে বাংলা ও বাঙালির প্রতি ভিন্ন এক শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অনন্য এক দৃষ্টান্ত এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেখা গেছে জাপানের রাজধানীতে। ব্যতিক্রমী সেই আয়োজন একদিকে যেমন ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি জাপানের জনগণের ভালোবাসার প্রকাশ, অন্য দিকে একই সঙ্গে এর মধ্যে দিয়ে ফুঠে উঠেছে দুই দেশের মৈত্রীর বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় ফলপ্রসূ করার এক সার্থক প্রতিফলন। সব মিলিয়ে তাই এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সম্পূর্ণ নতুন এক আঙ্গিকে জাপানে একই সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের মহান শহীদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, এবং জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৪০তম বার্ষিকী।
জাপানে যারা বাংলা ভাষার প্রচার আর প্রসারের সঙ্গে যুক্ত, তাদের অনেকের নাম আর পরিচয় আমাদের এখন আর অজানা নয়। তবে যে বাস্তবতা হয়তো অনেকেরই দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেছে, তা হলো, জাপানে নিয়মিতভাবে বাংলা ভাষার চর্চার পূর্ণাঙ্গ কোনো কোর্স দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো পর্যন্ত নেই। আর তাই বাংলা ভাষা শিখে বাংলা নিয়ে কাজ করায় যেসব জাপানি যুক্ত আছেন—অধ্যাপক ৎসুইয়োশি নারা, কিওকো নিওয়া কিংবা কাজুহিরো ওয়াতানাবের মতো সে রকম বিশিষ্টজনেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিখেছিলেন মূল ভাষা হিসেবে নয় বরং দ্বিতীয় বিদেশি ভাষা হিসেবে। তবে সেই ছাত্রজীবন থেকেই বাংলার প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিল বলেই পরবর্তী জীবনে দ্বিতীয় সেই ভাষাকেই তাঁরা মূল ভাষা মনে করে নিয়ে কাজ করে গেছেন। জাপানে ভাষাগত উচ্চশিক্ষা লাভে বাংলার এভাবে পিছিয়ে থাকা কাম্য নয়, বিশেষ করে মোট কতজন এই ভাষায় কথা বলছেন, সেই হিসাবে বাংলা এখন বিশ্বের ষষ্ঠ ভাষার অবস্থানে উঠে আসার পর। বঙ্গপ্রেমী জাপানিরাও বেশ কিছুদিন ধরে সেই ত্রুটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং সেটা সংশোধন করে নিতে হলে কী করা দরকার, সেই চেষ্টাও তাঁরা চালিয়ে গেছেন। সে রকম প্রচেষ্টার ফলে জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশেষে দেশের নেতৃস্থানীয় একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, টোকিও বিদেশি ভাষা ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে চলেছে এ বছর এপ্রিল মাস থেকে। টোকিওর শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের ব্যতিক্রমী দিকটি ছিল সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।
জাপানের এই খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন থেকে প্রতিবছর যে ১০ জন করে তরুণ-তরুণী বাংলা ভাষাকে তাদের স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করার মূল ভাষা হিসেবে বেছে নেবে, বাংলা ভাষা ও বঙ্গভাষীদের জন্য এটা হচ্ছে সত্যিকার অর্থেই সুখবর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষাঙ্গনের পাঠক্রমের ২৭তম বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রচারের দিন হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে বেছে নিয়ে টোকিওর বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে দূতাবাস এতে কেবল সম্মতিই দেয়নি, একই সঙ্গে এ উপলক্ষে বিশেষ একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তাবও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিয়েছিল, যার ফলে মহান শহীদ দিবসে টোকিওতে এবার বসেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক আয়োজন।
টোকিও বিদেশি ভাষা ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাসের মূল মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। অনুষ্ঠানের শুরুতে দেওয়া ভাষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট নোবুও তোমিমোরি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে দিনটির সঙ্গে সম্পর্কিত বাংলাদেশের শহীদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় যে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ২৭তম ভাষা হিসেবে নিয়মিত পাঠ্যসূচিতে বাংলা ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, সেই ঘোষণা প্রচার করেন। বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বঙ্গভাষীদের মনের আবেগের সঙ্গে সম্পর্কিত বিশেষ সেই দিনটিতে এ রকম এক ঘোষণা ছিল সত্যিকার অর্থেই তৃপ্তিদায়ক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক ও বিশিষ্ট আনুবাদক অধ্যাপক কিওকো নিওয়া যে নতুন এই বাংলা বিভাগের হাল ধরেছেন, সেটাও আমরা জানতে পারি অধ্যাপক তোমিমোরির ভাষণ থেকে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাংলা বিভাগে প্রতিবছর ১০ জন করে ছাত্র ভর্তি হবে। ফলে এখন থেকে চার বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে ৪০ জন ছাত্রের দেখা পাওয়া যাবে, বাংলা ভাষা শেখায় যাঁরা নিয়োজিত। এর বাইরে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কোর্স চালু হলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত স্নাতকোত্তর পর্যায়ের গবেষকদেরও বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানাবে। ফলে টোকিওর এই সম্মানজনক বিদ্যাপীঠটি যে আগামী দিনে জাপানে বাংলাচর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে, তা সহজেই বলা যায়।
বিশেষ সেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তিনজন বিশিষ্ট জাপানি নাগরিককে, বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করার জন্য সবাই যাঁরা আমাদের পরিচিত। এঁরা হলেন—ভাষাতত্ত্বের নেতৃস্থানীয় গবেষক ও স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো বিশিষ্ট বন্ধু অধ্যাপক ৎসুইয়োশি নারা, বাংলা সাহিত্যকে জাপানে পরিচিত করে তোলায় অবদান রেখে যাওয়া গবেষক ও শিক্ষক কিওকো নিওয়া এবং রেডিও জাপানের বাংলা বিভাগের প্রধান কাজুহিরো ওয়াতানাবে। পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ বাংলায় দেওয়া ভাষণে তাঁরা সবাই জাপানে বাংলা ভাষা চর্চার নতুন সুযোগ তৈরি হওয়াকে স্বাগত জানিয়ে এ রকম আশা প্রকাশ করেন যে আগামীর জাপান তাঁদের চেয়েও আরও অনেক বেশি সুযোগ্য বঙ্গ গবেষকের দেখা পাবে, যাঁরা কিনা বাংলার সমৃদ্ধ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আরও ভালোভাবে জাপানিদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দায়িত্ব যাঁর ওপর ন্যস্ত হয়েছে, সেই অধ্যাপক নিওয়া বলেছেন, যে প্রবল ইচ্ছা তাঁর মনে এখন দেখা দিয়েছে, তা হলো, বাংলা ভাষা শেখার নতুন এই জায়গাটি যেন জাপানে বাংলা গবেষণার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে এবং বাংলা সংস্কৃতির গবেষণা ও পরিচিতি তুলে ধরার কাজ করে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাপানি আর বাঙালির সহযোগিতার দৃষ্টান্তমূলক এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় পায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া।
অন্য দিকে কাজুহির ওয়াতানাবে সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি মনে করিয়ে দেন তা হলো, ভাষার বিস্তার এবং এর সংরক্ষণে সর্বাগ্রে যাদের এগিয়ে আসতে হয়, তারা হলো সেই ভাষায় কথা বলা লোকজন। সেই সূত্রে দুঃখজনক এক অভিজ্ঞতার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন, যা থেকে আমরা জানতে পারি সে রকম কিছু প্রবাসী বঙ্গভাষীদের কথা, বাংলায় কথা বললে ভবিষ্যতে ক্যারিয়ার গড়ে নেওয়ার পথে তা বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে বলে সন্তানদের বাংলা শেখাকে যাঁরা নিরুৎসাহিত করছেন।
সবশেষে টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ড. জীবন রঞ্জন মজুমদার আলোচক ও উপস্থিত সবাইকে ব্যতিক্রমী সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে দ্বিতীয় পর্বের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগের আমন্ত্রণ জানান, প্রবাসী বাংলাদেশি শিল্পীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন জাপানি ছাত্রীও যেখানে জাপানের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র কোতোর সংগীত পরিবেশন করেন।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.