কেমন আছে তোমার দেশের 'ওয়ার ক্রিমিনাল' by রণজিৎ বিশ্বাস

দ্রলোক জড়োসড়ো অবস্থায় বিধাতার কক্ষে প্রবেশ করলেন। ধরা যাক, তার নাম রণজিৎ বিশ্বাস। বিধাতা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।: কেমন আছো মি. রণজিৎ?: স্যার, ভালো। : কেমন ভালো?: আন্ডার দ্য গিভন কন্ডিশন, যতটুকু ভালো থাকা যায়, স্যার।: তাহলে তুমি কি বলতে চাইছো আমার এখানকার টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন তেমন ভালো নয়!
: তা আমি বলতে চাইনি স্যার! বলার ইচ্ছা হলেও কোনোদিন আমি তা বলবো না। মুখে যদি কখনও তা এসে যায়ও


আমার, ঢোক গিলে পাঠিয়ে দেব পেটের তলে।: তুমি সবসময় গোমরামুখে থাকো কেন! গোমরামুখো লোক আমি একদম পছন্দ করি না। প্রাণ খুলে হাসিবে। লাফটার ইজ দ্য বেস্ট মেডিসিন, কথাটা মনে রাখবে।
: রাখতে চেষ্টা করবো স্যার।
: চেষ্টা করবে কী! রাখবে। অবশ্যই রাখবে। নির্বিকল্পভাবে রাখবে। হ্যাভিং নো আদার অপশন, রাখবে। আন্ডার কম্পালশন, রাখবে।
: অত থ্রেট দিতে হবে না স্যার, রাখবো। আমি নিশ্চিতভাবেই রাখবো।
: তুমি হাসতে জানো না কেন?
: আমি হাসতে জানতাম। আমি নিজেও প্রচুর হাসতাম, মানুষকেও হাসাতাম। এখন আমি কোনোটাই করি না।
: তেমন কেন কর? তুমি কি জানো না_ আনন্দের ভাগ দিলে আনন্দ ডাবল হয়, দুঃখের ভাগ দিলে দুঃখ অর্ধেক হয়!
: জানি স্যার। এগুলো আমি দুনিয়ায় থাকার সময় সভায়-সমিতিতে ও লেখায়-বলায় প্রচারও করতাম। প্রচার করতে করতে দেখি প্রকৃতি নির্দিষ্ট ও মানবসৃষ্ট কিছু কারণে আমার মুখের হাসি মুছে গেছে। কিছু মানুষ; অগ্রবর্তী, অনুবর্তী ও পার্শ্ববর্তী; আমাকে বড় ভোগা ভুগিয়েছে।
: কী কারণে তারা তোমাকে ভুগিয়েছে বলে মনে হয়?
: কেউ কেউ আমাকে বলেছে_ তুমি ভুগছো তোমার নামের কারণে। তোমার নামে সবগুলোই বাংলা শব্দ। যারা মুক্তিযুদ্ধের শত্রু ও ছদ্মশত্রু তারা এ ধরনের নামের মানুষ পছন্দ করে না। আমি এ কথাটি বিশ্বাস করি না। তখনও করিনি, এখনও করি না।
: কর না কেন?
: করি না, কারণ তারা সংখ্যায় কম ও মনের দিক থেকে তারা দুর্বল। জানে যে মানুষ তাদের নিয়ে প্রতিদিন ঘৃণার ভাণ্ড বড় করে; খুব ত্রুক্রদ্ধ কেউ কেউ তাদের নামে চতুষ্পদ প্রাণীও পোষে।
: যা পোষে বা যা পোষে না, সবই যে আমার ইচ্ছায় হয়_ সেটি তুমি মানো কি মানো না?
:মানি।
: এখন তুমি বল, কয়েকদিন ধরে আমার চারপাশে তুমি ঘুরঘুর করছো কেন?
: আমি আবার একটু পৃথিবীতে যেতে চাই। মাত্র একদিনের জন্য।
: কেন যেতে চাও?
: যারা আমার মতো একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর ক্ষতি করছিল; কখনও অকারণে, কখনও অসূয়াবশত, তার দ্বাদশ ঘটিকা বাজা ছিল তাদের কথা বাদ দিন; যা আমার দেশের ও জাতির ক্ষতি করছিল এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া পবিত্র দেশটির বড় অপমান করছিল, তারা এখন কী অবস্থায় আছে, দেখতে আসতে চাচ্ছি। অবশ্য, আপনার যদি অনুমতি থাকে।
: যেও না আর পৃথিবীতে। আমার অনুমতি নেই। এখানে তেমন সিস্টেমও নেই। একবার এলে কেউ এখান থেকে যেতে পারে না। আমার কাছে শোন, ওরা কেমন আছে।
: তেমন তো শুনতে আমি পারিই স্যার।
:তাহলে?
:সিইং ইজ বিলিভিং বলে একটা কথা আছে না, স্যার!
: তা আছে। এপারে যখন চলে এসেছো, ওপারে_ কোনো কিছু তুমি আর সি করতে পারছো না। এখন হবে, হিয়ারিং ইজ বিলিভিং। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক ও ছদ্ম সাম্প্রদায়িক লোকেরা খুব ভালো আছে এবং তারা আরও ভালো থাকবে। কারণ তারা একাট্টা। তাদের অর্থবিত্ত আছে এবং পক্ষে ধৌতমস্তিষ্ক বাইসন বাহিনী আছে। মুক্তিযুদ্ধের শত্রু ও স্বাধীনতার কিছু ছদ্ম দুশমন তাদের বাঁচানোর জন্য লজ্জাশরম ছেড়ে মাঠে নেমে পড়েছে।
আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা খোপেপ্রকোষ্টে ভাগভাগ হয়ে পড়েছে। কিছু বুদ্ধিজীবী ও ব্যবহারজীবী আছে যারা নিজেদের নিরপেক্ষ নিরপেক্ষ জাহির করতে চায়, কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণ তাদের রায়টা যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় দুশমন এবং বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি অকৃতজ্ঞ মানুষগুলোর পক্ষেই যায়। আর কিছু জানতে চাও?
: চাই। যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী, অতি সাম্প্রদায়িক বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধাদের পতন হবে কবে?
: হিসেব করে বলতে হবে।
: কিসের হিসেব? আপনার আবার হিসেব কিসের?
: হিসেব হচ্ছে, ততদিন আমি বেঁচে থাকতে পারবো কি-না। ওরা যেভাবে আমাকেও সাম্প্রদায়িক করে তুলছে, একদিন হয়তো নিরুপায় অবস্থায় আমিও স্তব্ধে যাবো।

রণজিৎ বিশ্বাস :কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.