মোহনায় ত্রিমূর্তি by জগন্নাথ বিশ্বাস
ভারতের জন্য অস্ট্রেলিয়া হলো ক্রিকেটের শেষ সৌধ, যা এখনও অজেয়। শচীনরা এই সৌধের চূড়ায় উঠতে চান। ৪৫ দিনের লম্বা সফরকে তাই বিশেষ অভিযান বলা হচ্ছে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। সপ্তদশ শতাব্দীর এক ফরাসি উপন্যাস। যার নায়ক দঁ আরতাগনন। ঘরছাড়া হয়ে একদিন বেরিয়ে পড়লেন প্যারিস দেখতে। সেখানেই দেখা অ্যাথস, পারথস ও অ্যারামিসের সঙ্গে। ওরা তিন বল্পূব্দ। তিন মাস্কেটিয়ার্স। প্যারিসের ধুলা আর রাজপথ ছিল যাদের বেঁচে থাকার সরণি।
ঘটনা তাদের মিলিয়ে দেয় একসঙ্গে। এরপর সব অভিযানে আজীবন পরস্পরের সংলগ্ন থাকেন তারা।
শচীন, দ্রাবিড় ও লক্ষ্মণের সঙ্গে কি মেলে? হতে পারে ক্রিকেট ভিন্ন প্রসঙ্গ; কিন্তু কোনো এক বিশেষ অভিযান সফল করার ক্ষেত্রে এই ত্রয়ীর প্রয়াস কোথাও যেন এক বিন্দুতে মিলে যায়।
ভারতের জন্য অস্ট্রেলিয়া হলো ক্রিকেটের শেষ সৌধ, যা এখনও অজেয়। শচীনরা এই সৌধের চূড়ায় উঠতে চান। ৪৫ দিনের লম্বা সফরকে তাই বিশেষ অভিযান বলা হচ্ছে। অন্যদিকে ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে দাঁড়িয়ে আছেন শচীন, লক্ষ্মণ, দ্রাবিড়। ক্রিকেটের থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। আজ থেকে মেলবোর্নে শুরু হওয়া ক্যারিয়ারের শেষ অস্ট্রেলীয় অভিযান তারা সফল করতে মরিয়া।
অবশ্য মোহনায় পেঁৗছে যাওয়া এই ত্রয়ী ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন আলাদা সময়ে। '৯২-র অস্ট্রেলিয়া সফরে শচীনের উত্থান। তখন অন্তরালে প্রস্তুত হচ্ছিলেন দ্রাবিড় ও লক্ষ্মণ। পরে ক্রিকেটের বড় মঞ্চে আর্বিভাবের পর তিন প্রবল ধারা মিলেমিশে একাকার। এখনও যা সমান বেগবান। সামর্থ্যে উদ্বেল।
সফরের শুরুতে ব্র্যাডম্যান স্মৃতি বক্তৃতায় রাহুল দ্রাবিড় বলেছিলেন, ওয়ান ক্যান নেভার বি শিওর অ্যাবাউট টেন্ডুলকার। খুব সত্যি কথা। এবার ডনের দেশে শততম সেঞ্চুরির সামনে তিনি; কিন্তু '৯২-র শুরু থেকে '৯৯, '০৩ এবং '০৭-এর ঘটনাবহুল অস্ট্রেলিয়া সফরের কথা স্মরণ করুন, নিশ্চিতভাবেই আপনার মনে হবে শচীন যেন ক্রিকেটের 'বাসনা শিখা'। যা এখনও প্রখর উজ্জ্বলতায় দেদীপ্যমান। অথচ ১৯ বছরের কালপর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট থেকে মুছে গেছে তিনটি প্রজন্ম। প্রথম সফরে পার্থের গতি আর বাউন্সে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন ক্রেগ ম্যাকডারমট ও ব্রুস রিড। স্রেফ টোর ওপর দাঁড়িয়ে খেলা ১১৪ রানের ইনিংস দেখে বিহ্বল অ্যালান বোর্ডার বলেছিলেন, ছেলেটার ডাবল সেঞ্চুরি নেই, এই যা দুর্বলতা। পরে মার্ক টেইলর এসেছেন। ব্যাটন গেছে স্টিভ ওয়ার হাতে। ১৯৯৯ সালে তিনি লেলিয়ে দিয়েছেন ম্যাকগ্রা ও ব্রেট লিকে। ২০০৩-এ শচীনকে থামানোর জন্য লাল বল ছুড়েছেন অ্যান্ডি বিকেল ও জেসন গিলেস্পি। ২০০৭ সালে কৌশল সাজিয়েছেন রিকি পন্টিং। তুণে ঝলমলে নতুন অস্ত্র মিচেল জনসন ও স্টুয়ার্ট ক্লার্ক। আর এবার প্যাটিনসন, সিডলরা তো ম্যাকডারমটের ছেলের কথা মনে করাচ্ছেন। সত্যি ভারত যদি কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে এই সফরে কোনো ম্যাচ খেলত তাহলে শচীন হয়তো গার্ড নিতেন অ্যালিস্টার ম্যাকডারমটকে মোকাবেলা করার জন্য।
অথচ কি আশ্চর্য, দেখুন প্রায় কুড়ি বছরের বিস্মরণ আর মুছে যাওয়ার মধ্যেই এখনও ক্রিকেটের প্রতি অনন্ত জীবন তৃষ্ণা নিয়ে খেলে চলেছেন শচীন। এই অস্ট্রেলিয়াতেই মনি-মুক্তার মতো ছড়িয়ে আছে কত গল্প। পার্থের সেঞ্চুরি ও ম্যাচ জেতানো ৭১-এর পাশে সিডনির কাভার ড্রাইভ ছাড়া ডাবল সেঞ্চুরির তো এখন কিংবদন্তি। এই সময় ফরাসি উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহের মতোই পাশে পাশে ছিলেন দ্রাবিড় আর লক্ষ্মণ। প্রথম সফরে সিডনির ১৬৭ কিংবা '৯৯-তে করা ১৭৮ রানের লক্ষ্মণ স্পেশাল কে ভুলতে পারে। আর স্থিপ্রজ্ঞের মতো চিরনির্ভর দ্রাবিড়ের নাম তো খোদাই হয়ে গেছে ২০০৩ সালে অ্যাডিলেড জয়ের স্মৃতিফলকে। ১৯৮১ সালের পর ২১ বছরের অতৃপ্তি ঘোচানো জয়। যা পরের ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা জয়ে আত্মবিশ্বাসের জোগান দিয়েছিল।
এবার সমাপ্তির মোহনায় শ্রেষ্ঠ কীর্তির স্বপ্নে বিভর শচীন, দ্রাবিড় ও লক্ষ্মণ। পারবেন? উত্তর না হয় সময়ের হাতে তোলা থাক।
No comments