চলতি পথে-বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের গল্প


দ্রুতগামী বাসের বদৌলতে অল্প সময়েই গোয়ালন্দ পার হয়ে কামারখালী নামলাম আমরা। লাল-সবুজ রঙে রাঙানো একটা রিকশাভ্যানে সওয়ার হয়ে সামনে এগোলাম। এগোতে এগোতেই একটা নদী এসে সঙ্গী হলো আমাদের। পরিশীলিত, পরিমার্জিত গতিসম্পন্ন এ নদীর নাম মধুমতি। হ্যাঁ, মধুমতিকে সঙ্গে নিয়েই ফুলবাড়ীর ঋষি বটতলা অতিক্রম করলাম আমরা। গন্ধখালী সড়ক ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলেই আঁকাবাঁকা পথ এরপর।


সুদীর্ঘ সেই পথের শেষপ্রান্তে সুন্দর, ছায়াচ্ছন্ন একটি গ্রাম। কী নাম এই গ্রামটির? সালামতপুর—বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের জন্মস্থান।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের জন্ম ১৯৪৩ সালের মে মাসে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের সালামতপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মুন্সী মেহেদী হাসান, মায়ের নাম মকিদুন্নেসা বেগম। মুন্সী মেহেদী হাসানের পরিবারে সর্বগ্রাসী অভাব ছিল। এই অভাবের কারণেই মুন্সী আব্দুর রউফের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। বাবার অকালমৃত্যুর পর মা মকিদুন্নেসার অক্লান্ত চেষ্টায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করলেও সাংসারিক অনটনে বিদ্যালয়ের মায়া ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। এরপর অল্প বয়সেই শুরু করেন জীবনসংগ্রাম।
১৯৬৩ সালের ৮ মে ছোট চাচা মুন্সী মোতালেব হোসেনের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে যোগ দিলেন মুন্সী আব্দুর রউফ। শুরু হলো তাঁর সৈনিক জীবন। নতুন এ জীবনের আশীর্বাদে রউফের সংসারের অনটন সাময়িকভাবে চাপা পড়লেও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক টানাপোড়েনের মুখোমুখি হলেন মুন্সী আব্দুর রউফ। তিনি লক্ষ্য করলেন, ন্যায্য অধিকার থেকে বাঙালি জওয়ানদের কী নিদারুণভাবে বঞ্চিত করছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এ বঞ্চনার বিরুদ্ধাচরণের অদম্য ইচ্ছা থেকেই ১৯৭১ সালে যুদ্ধে যোগ দিলেন তিনি। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করলেন বিভিন্ন রণাঙ্গনে। যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁরা অবস্থান নিলেন রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের চিংড়িখালের পাড়ে। সামরিক গুরুত্ব বিবেচনায় চট্টগ্রামের নিকটবর্তী পার্বত্য অঞ্চল রাঙামাটির এ সুনির্দিষ্ট জলপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাই কোম্পানির অধিনায়ক মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে সতর্ক প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তুললেন মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল চিংড়িখালের দিকে এগিয়ে এল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সাতটি স্পিডবোট ও দুটি লঞ্চবোঝাই প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য। স্পিডবোটগুলোতে মেশিনগান, রাইফেল রয়েছে অনেক আর লঞ্চ দুটিতে রয়েছে ছয়টি মর্টার।
প্রথমে গুলি শুরু করল পাকিস্তানিরাই। মুক্তিযোদ্ধারা যোগ্য জবাব দিলেন। কিন্তু অস্ত্র ও সৈন্যবল যে বেশি পাকিস্তানিদের! গেরিলা যুদ্ধের কৌশল হিসেবে পশ্চাৎপদসরণ অনিবার্য এবার। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে পেছনে ফেরাও যে অসম্ভব প্রায়! চিন্তায় পড়লেন কোম্পানি কমান্ডার। তিনি জানালেন, একেবারে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে কেউ যদি কিছুক্ষণের জন্য ব্যস্ত রাখতে পারে পাকিস্তানিদের, তবেই তাদের পক্ষে অন্যত্র সরে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুকে মেনে নিয়ে কে গ্রহণ করবে এ দুঃসাহসী কাজের ভার? যুদ্ধের এ সংকটময় মুহূর্তে সামনে এগিয়ে এলেন মুন্সী আব্দুর রউফ। মেশিনগান নিয়ে অতর্কিতে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি হলেন তিনি। গুলি চালালেন অবিশ্রান্ত গতিতে। এই আকস্মিক আক্রমণে বিপর্যয় ঘটল পাকিস্তানিদের। অস্ত্র এবং সৈন্যসহ তাদের সাতটি স্পিডবোট ডুবে গেল চিংড়িখালের জলে। হতবিহবল হলো তারা। লঞ্চ দুটি ঘুরিয়ে দ্রুত সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে। এরপর মুন্সী আব্দুর রউফের অবস্থান লক্ষ্য করে একের পর এক মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করল পাকিস্তানিরা। মুন্সী আব্দুর রউফ প্রাণপণে ঠেকালেন পাকিস্তানিদের। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না কোনোভাবেই। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে একটি গোলা নিপতিত হলো আব্দুর রউফের ওপর। মেশিনগান ছিটকে পড়ল তাঁর হাত থেকে। শরীর বিদীর্ণ হলো গোলার আঘাতে, কিন্তু অন্তর উদ্ভাসিত হলো আনন্দ জ্যোতিতে। কারণ, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হলেন, সফল হলেন দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের কথা ভাবতে ভাবতে আমরা পা রাখলাম সালামতপুরের মাটিতে। মুন্সী আব্দুর রউফের পরিত্যক্তপ্রায় ভিটাবাড়ি ঘুরে দেখলাম। কথা বললাম আব্দুর রউফের আপন বোন জহুরা বেগমের সঙ্গে। তারপর কামারখালী ফিরে এলাম আবার।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বাকি এখনো গল্পের উপসংহার পর্ব!
কামারখালী বাজারের উল্টোদিকে অবস্থিত আড়পাড়া নামের ছোট্ট মহল্লা। ঢাকা ফেরার আগে সেই মহল্লায় প্রবেশ করলাম আমরা। কারণ এ পাড়ায় মুন্সী আব্দুর রউফের চাচাতো ভাই মুন্সী আইয়ুব আলীর বাড়িতে বাস করেন বীরশ্রেষ্ঠর গর্ভধারিণী মকিদুন্নেসা বেগম। আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, তাঁর সঙ্গে দেখা করা ছাড়া, তাঁর পদধূলিতে ললাট শুদ্ধ করা ছাড়া পরিপূর্ণতা লাভ করবে না আমাদের এ কামারখালী অভিযাত্রা।
দীপংকর চন্দ

No comments

Powered by Blogger.