চলে গেল আরেকটা বছর, তবুও-তুমি আছ, আমিও... by সুমন্ত আসলাম
বালিয়াকান্দির সুজনের কথা মনে আছে তোমার? সম্ভবত মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে তো আর কোনো মন্ত্রীর ছেলে ছিল না, ছিল না কোনো বিত্তবানের পুত্র কিংবা কোনো ক্ষমতাবানের আত্মীয়ও। ছেলে, পুত্র কিংবা আত্মীয় হলে তুমি তাকে চিনতে, মনেও রাখতে। মাথা থেকে দেহ বা দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ছালার একটা থলিতে ভরে রাখা হয়েছিল সুজনকে। সেই থলির সঙ্গে সিমেন্টের একটা বস্তা বেঁধে সেটা ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল কচুরিপানাভর্তি একটা
পানির ডোবায়। আট দিন পর সেই বস্তাটা যখন তোলা হয়, সুজন তখন গলে গেছে অনেকখানি। তার চোখের মাঝখান থেকে মণি দুটো উধাও। বিকৃত হয়ে গেছে চেহারাটাও। অথচ কোনো দোষ ছিল না আট বছর বয়সী সুজনের। কেবল তার বাবার কাছে দুই লাখ টাকা চেয়েছিল কিছু চাঁদাবাজ। সুজনের বাবা দেননি। তারপর...
ভাগ্যিস, সুজন আমাদের ছেলে ছিল না!
পঞ্চগড়ের সাবিহাকে মনে পড়ে তোমার? জানি, মনে পড়ার কথা নয়। যদি সে টিভি নাটকের নায়িকা হতো কিংবা কোনো পণ্যের মডেল হতো অথবা উপস্থাপক হতো কোনো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের, তাহলে সহজেই তাকে মনে রাখা যেত। অনেকে রাখত, তুমিও।
গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সাবিহা। তবে আমি সেটাকে আত্মহত্যা বলব না, স্রেফ হত্যা করা হয়েছিল তাকে। স্কুলে যাওয়ার পথে দুষ্ট কিছু ছেলে শিস বাজাত তাকে দেখে, কখনও কখনও অশল্গীল অঙ্গভঙ্গি করত, কখনও সামনেও এগিয়ে আসত। একদিন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলে তারা। গায়ে হাত দিয়ে বসে সাবিহার।
স্কুলে আর যাওয়া হয় না সেদিন সাবিহার। ফিরে আসে বাড়িতে। কিন্তু স্বস্তি পায় না কোনো কিছুতেই। তার মনে হয়, সবাই তাকে দেখে হাসছে। সবাই তাকে খাবলে ধরতে চাচ্ছে। বিদ্রূপ আর আনন্দ করছে।
নিজের প্রতি প্রচ ঘৃণা এসে যায় সাবিহার। চুপচাপ বসে থেকে কী যেন ভাবে সে। ভাবতে ভাবতে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে নিঃশব্দে। এরপর সত্যি সত্যি নিঃশব্দ হয়ে যায় সবকিছু।
ভাগ্যিস, আমাদের মেয়ে ছিল না সাবিহা।
আবুলে ভরে গেছে দেশ! আবুলরাই আজ অনেক কিছুর হর্তাকর্তা। অনেক আবুল আবার ইদানীং অনেক বেশি আলোচিত, উল্লসিতও। তাই সাতকানিয়ার আবুল হোসেন নামের সাধারণ মানুষটিকে আমরা চিনি না, জানি না, ভাবি না তার কথা। অথচ সুন্দর একটা জীবন ছিল তার।
হোসেনের দূর সম্পর্কের এক চাচা ছিলেন, আলতাফ হোসেন। কে বা কারা তাকে মেরে ফেলে একদিন। এরপর লাশটি রাতের আঁধারে ফেলে রেখে যায় তাদের বাড়ির সামনে। বাড়ির সবাই ছুটে যায় এলাকার চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যান শোনান নতুন কথা_ সাক্ষী হতে হবে। কয়েকজন আসামির কথা বলেন চেয়ারম্যান, যাদের সঙ্গে বিরোধ আছে তার। রাজি হন না হোসেন। এরপর চেয়ারম্যানের রোষানলে পড়ে সরাসরি জেলে।
আট বছর জেল খাটার পর মুক্তি পান তিনি। কিন্তু কী করে যেন খালাসনামাটি চাপা পড়ে যায় অনেক ফাইলের নিচে। ধুলোর আস্তরণ থেকে বের হয়ে আসে অবশেষে সেটি। ততদিনে ১৮ বছর ৪ মাস কেটে গেছে হোসেনের। 'কে ফিরিয়ে দেবে আমার যৌবন, এতগুলো বছর? আতঙ্কে কেন দিন কাটে আমার? আমার কেন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে?' জবাব দেয় না কেউ। নির্লজ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই তার সামনে। বলো, একজন সাধারণ মানুষের জীবনের একটা মুহূর্ত কেড়ে নেওয়া নির্লজ্জতা নয়! বলো, লজ্জায় কি আমাদেরই আত্মহত্যা করা উচিত নয়? হোসেনের পা ধরে মাথা ঠেকিয়ে রাখা উচিত নয় অন্তত সাতশ বছর?
ভাগিস্য, আমাদের কোনো ভাই নন হোসেন!
হাওয়া আক্তারকে আমরা অবশ্য চিনি, ক'দিন আগে যার হাতের আঙুল কেটে ফেলেছে তার স্বামী রফিকুল ইসলাম। বিয়ের পরপরই স্ত্রীকে লেখাপড়া করতে নিষেধ করেছিল রফিক, এবং একসময় সত্যি সত্যি লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে দুবাই চলে যায়। এসএসসির ফল বের হয়, হাওয়া পাস করেন। লেখাপড়া করার তাগিদটা জেগে ওঠে তার ভেতর প্রবল হয়ে। ভর্তি হয়ে যান তিনি কলেজে।
দুবাই থেকে ফেরত আসে রফিক। মিথ্যা কথা বলে স্ত্রীকে ডেকে আনে ঢাকায় বোনের বাসায়। এরপর হাওয়াকে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ওড়না দিয়ে চোখ বাঁধে তার, মুখে লাগায় স্কচটেপ, চাপাতি দিয়ে কেটে ফেলে ডান হাতের আঙুল! রফিকুল ইসলাম হয়ে যায় বর্বর রফিক!
ভাগ্যিস, আঙুল কাটা হাওয়া আক্তার আমাদের কোনো বোন নন!
চলে যাচ্ছে আরেকটি বছর। চলে যাচ্ছে সময়। কিন্তু নিয়ে যাচ্ছে কী? আমরা না হয় সেটা না-ই ভাবি। বরং যা রেখে যাচ্ছে, সেটা আমরা বলি। ভোরের পাখি এখনও আমাদের ঘুম ভাঙায়; লিবিয়া, ইরাক কিংবা সিরিয়ায় পাখি তার ডাক ভুলে গেছে। বটবৃক্ষের ছায়া এখনও আমাদের শীতল করে; ইথিওপিয়া, উগান্ডার মানুষেরা সবুজ কী জিনিস ভুলে গেছে। নদীর কুলকুল শব্দ আমাদের এখনও ঘুম এনে দেয় চোখে; মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মানুষ তো দূরের কথা, শাসকদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
এখনও পথের কোনো অবহেলিত ফুল দেখে আমরা থমকে দাঁড়াই, সবুজ একটা পাতা দেখে উদ্বেলিত হই, শিশিরের নিঃশব্দতায় নিজেরাও মৌন হই। আমরা এখনও মায়ের পরশ পাই, বাবার আদর পাই, ভাইবোনের অকৃত্রিম স্নেহ পাই। আমরা এখনও একে অন্যের দুঃখে ব্যথিত হই, সুখে হই আনন্দিত। আমাদের মানবিকতা এখনও বেঁচে আছে, মনুষ্যত্ব টিকে আছে। আমরা এখনও সম্মান করতে ভুল করি না, এখনও ভালোবাসতে কার্পণ্য করি না, নিজেকে উজাড় করে দিতে দ্বিধা করি না।
যদি তা-ই না হবে, শিশুর কান্নায় এখনও জল আনি কেন আমরা চোখে, তার নিটোল হাসিতে হেসে ফেলে কেন আমাদের হৃদয়, মন, সত্তা! আমরা সবাই অমানুষ হয়ে যাইনি, কেউ কেউ এখনও মানুষ হয়েই আছেন।
তারা আছেন, তুমি আছ, আমিও...! হ
No comments