মুক্তিযুদ্ধের এক অগ্রসেনার বিদায়-আবদুর রাজ্জাক by আবু সাঈদ খান
মুক্তিসংগ্রামের উপেক্ষিত, অথচ গৌরবোজ্জ্বল ধারার অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধেও রাজ্জাকের অবদান অপরিসীম। একাত্তরে মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) চার নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। স্বাধীনতা-উত্তরও আবদুর রাজ্জাকের সংগ্রামী তৎপরতা থেমে ছিল না। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে প্রথম কাতারে ছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির তিনি অন্যতম পুরোধা। এ সময়ে আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল
তৃণমূলের কোনো কর্মী যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তার পরিচয় দেওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু তার নাম ধরে বলতেন_ কেমন আছিস। একবার দু'বার দেখা হয়েছে এমন স্বল্প পরিচিতের নামধামও থাকত তার মুখস্থ। এ গুণ ছিল সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকেরও। তৃণমূলের অগণিত নেতাকর্মীর সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তিনি মনে রাখতেন তাদের নামধাম। সংগঠনই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান।
ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তিনি ১৯৬৫ থেকে '৬৭ সাল পর্যন্ত দু'বার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। দীর্ঘদিন ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৮৩ সালে যখন বাকশাল গড়েন তখনও সে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে এসেও সাধারণ সম্পাদক হয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন। আমৃত্যু তিনি সংগঠনের সঙ্গে ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি তার দলের তো বটেই, অগণিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশেছেন, তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনেছেন। রাজনৈতিক কর্মীসহ ব্যাপক মানুষের প্রিয় রাজ্জাক ভাই ছিলেন তিনি।
তিনি যে একজন বড় মাপের সংগঠক, সেটি তার একমাত্র পরিচয় নয়। একাধিকবার সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রিত্ব করেছেন, সেটিও প্রধান বিবেচ্য নয়। এসব কিছু ছাপিয়ে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯৬২ সালেই তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। সে সময়ের ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ একত্র হয়ে গড়ে তুলেছিলেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে একটি গোপন সংগঠন, যেটি স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত।
১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে পাকিস্তানের অসারতা নিয়ে অনেকেই ভেবেছেন, মতামত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তখন স্বাধীনতার জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করা এক অতিমাত্রায় সাহসী কাজ। এ পদক্ষেপ যারা নিয়েছিলেন, রাজ্জাক তাদের অন্যতম। নিউক্লিয়াস গড়েই বসে থাকেননি তারা। স্বাধীনতার মন্ত্র ছাত্র-যুবকদের মধ্যে ছড়িয়েও দিয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালে লাহোরে স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত ৬ দফা উত্থাপন করার পর শেখ মুজিব দলের মধ্যে বিপাকে পড়েছিলেন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবদুস সালাম খানসহ সিনিয়র নেতারা এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তখন ছাত্রলীগের মধ্যে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাকের সমর্থক রেডিক্যাল গ্রুপ ৬ দফার পক্ষে প্রচারাভিযান শুরু করে। মাজহারুল হক বাকী তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি, আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক। তারাই সর্বাগ্রে ৬ দফার পক্ষে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন।
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের এই স্বাধীনতাপন্থি অংশটি ৬ দফাকে এক দফার সংগ্রামের মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন এবং তৃণমূলেও সে মেসেজ পেঁৗছে দিয়েছিলেন। আমার মনে পড়ে, ১৯৬৯ সালে আমি তখন ছাত্রলীগের কর্মী, আবদুর রাজ্জাক ফরিদপুরে গিয়েছিলেন। কিছু সক্রিয় কর্মীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, ৬ দফা হলেই কি আমরা সন্তুষ্ট থাকব? না, এটি হচ্ছে সেতু। এই সেতু পেরিয়ে আমরা এক দফায় পেঁৗছব_ সেটি স্বাধীনতা। সেদিন থেকেই আমরা স্বাধীনতার অমোঘ বাণীকে ধারণ করে '৬৯-এর গণআন্দোলন এবং '৭০-এর নির্বাচনে কাজ করেছি। এভাবেই দেশের অসংখ্য কর্মীর মাঝে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তবে তখন নিউক্লিয়াস নামক শব্দটি শুনিনি। শুনেছিলাম যে, ছাত্রলীগের ভেতরে দুটি ধারা সক্রিয় রয়েছে_ স্বাধীনতাপন্থি ও ৬ দফাপন্থি। ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি ধারার নেপথ্যে যাঁরা প্রেরণা জুগিয়েছিলেন রাজ্জাক তাদের অন্যতম।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বহুল প্রচারিত তথ্য হচ্ছে_ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা '৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। এটি সত্য, কিন্তু একই সঙ্গে এও সত্য যে, দীর্ঘদিন ধরে তরুণ স্বাধীনতাকামীরা চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। ধাপে ধাপে ছয় দফার সংগ্রামকে স্বাধীনতার সিংহদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল। ইতিহাসবিদরা এ সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত।
এটি অনুধাবনযোগ্য যে, '৭১-এর মার্চে যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আলোচনা চলছে, তখন রাজপথে ধ্বনিত হচ্ছে স্বাধীনতার সপক্ষে বিভিন্ন স্লোগান_ ৬ দফার আসল কথা/স্বাধীনতা স্বাধীনতা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, পিণ্ডি না ঢাকা/ঢাকা ঢাকা ইত্যাদি। এ স্লোগানগুলো '৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় উচ্চারিত হতো। তবে '৭০-এর নির্বাচনের পর তা হয়ে ওঠে আরও অর্থবহ।
এ প্রসঙ্গে '৭০ সালের ১২ আগস্ট অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভার প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। ওই সভায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্বপন কুমার চৌধুরী 'স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ' প্রস্তাব উত্থাপন করলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তা গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবটি রেডিক্যাল গ্রুপের কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর।
'৭০-এর নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি ও ৬ দফাপন্থি উভয় ধারা এক মোহনায় মিলিত হয়। স্বাধীনতাই মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ওই পরিষদের পক্ষ থেকে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন এবং ৩ মার্চ পল্টনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে এবং রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলাকে জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করে।
১৯৭১ সালের ২ ও ৩ মার্চ এবং ২৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার যে পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল সে পতাকাটি তৈরি হয়েছিল ১৯৭০ সালেই। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের শাহাদাতবার্ষিকীতে জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ছাত্রনেতারা।
স্বাধীনতার লক্ষ্যে তারুণ্যের এ কর্মকাণ্ডকে আড়াল করে রাখা হয়েছে। সামনে আনা হচ্ছে না_ ষাটের দশকে নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা সৈনিকদের কর্মকাণ্ডও। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সবকিছুকেই পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতে ইতিহাস খর্বিত হচ্ছে। স্বাধীনতার লক্ষ্যে সব বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে সামনে তুলে ধরার মধ্য দিয়েই মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পূর্ণতা পাবে, জাতীয় গৌরবগাথা হবে আরও উদ্ভাসিত।
মুক্তিসংগ্রামের উপেক্ষিত, অথচ গৌরবোজ্জ্বল ধারার অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধেও রাজ্জাকের অবদান অপরিসীম। একাত্তরে মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) চার নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। স্বাধীনতা-উত্তরও আবদুর রাজ্জাকের সংগ্রামী তৎপরতা থেমে ছিল না। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে প্রথম কাতারে ছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির তিনি অন্যতম পুরোধা। এ সময়ে আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তখন দেখেছি, তিনি নিরলসভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম রচনায় কাজ করেছেন। বিভিন্ন দল-মতের সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গড়ে ওঠার পাশাপাশি আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান চৌধুরী, আব্দুল আহাদ চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি। যখন আন্দোলনের মাঠ থেকে দুই কমিটি একত্রীকরণের দাবি ওঠে, তখন প্রশ্ন উঠেছিল কে এর নেতৃত্ব দেবেন। সেদিন আবদুর রাজ্জাক জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে যদি উদারতার পরিচয় না দিতেন তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন বেগবান হতো না। এটি ছিল আবদুর রাজ্জাকের প্রজ্ঞার পরিচায়ক। সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু এর সমাপ্তি দেখে যেতে পারলেন না একাত্তরের এই বীর। অনেক ক্ষোভ-অভিমান নিয়ে তিনি চলে গেলেন। তার নিরলস শ্রম ও ত্যাগে গড়া আওয়ামী লীগে তিনি উপেক্ষিত ছিলেন সাম্প্রতিক সময়ে। কী তার অপরাধ? কোনো অভিযোগও আনা হয়নি। তারপরও তাকে উপেক্ষা করা হলো, মহাজোট সরকারে এ অভিজ্ঞ নেতার ভূমিকা রাখার সুযোগ হলো না।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কর্ণধার তাজউদ্দীন আহমদের প্রসঙ্গ এসে যায়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ গড়ার কাজে তিনি নিবেদিত হতে পারেননি। তিনি ছিলেন নিজ ভূমে নির্বাসিত। নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রণা থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়েছিল ঘাতকরা। তবে একাত্তরের বিজয়ী জাতি তাজউদ্দীন আহমদকে ভুলে যায়নি, কোনোদিন ভুলবে না। ভুলবে না স্বাধীনতার সংগঠক আবদুর রাজ্জাককেও।
আমি জননেতা আবদুর রাজ্জাককে সশ্রদ্ধ বিদায়ী অভিবাদন জানাই।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
তৃণমূলের কোনো কর্মী যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তার পরিচয় দেওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু তার নাম ধরে বলতেন_ কেমন আছিস। একবার দু'বার দেখা হয়েছে এমন স্বল্প পরিচিতের নামধামও থাকত তার মুখস্থ। এ গুণ ছিল সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকেরও। তৃণমূলের অগণিত নেতাকর্মীর সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তিনি মনে রাখতেন তাদের নামধাম। সংগঠনই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান।
ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তিনি ১৯৬৫ থেকে '৬৭ সাল পর্যন্ত দু'বার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। দীর্ঘদিন ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৮৩ সালে যখন বাকশাল গড়েন তখনও সে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে এসেও সাধারণ সম্পাদক হয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন। আমৃত্যু তিনি সংগঠনের সঙ্গে ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি তার দলের তো বটেই, অগণিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশেছেন, তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনেছেন। রাজনৈতিক কর্মীসহ ব্যাপক মানুষের প্রিয় রাজ্জাক ভাই ছিলেন তিনি।
তিনি যে একজন বড় মাপের সংগঠক, সেটি তার একমাত্র পরিচয় নয়। একাধিকবার সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রিত্ব করেছেন, সেটিও প্রধান বিবেচ্য নয়। এসব কিছু ছাপিয়ে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯৬২ সালেই তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। সে সময়ের ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ একত্র হয়ে গড়ে তুলেছিলেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে একটি গোপন সংগঠন, যেটি স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত।
১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে পাকিস্তানের অসারতা নিয়ে অনেকেই ভেবেছেন, মতামত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তখন স্বাধীনতার জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করা এক অতিমাত্রায় সাহসী কাজ। এ পদক্ষেপ যারা নিয়েছিলেন, রাজ্জাক তাদের অন্যতম। নিউক্লিয়াস গড়েই বসে থাকেননি তারা। স্বাধীনতার মন্ত্র ছাত্র-যুবকদের মধ্যে ছড়িয়েও দিয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালে লাহোরে স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত ৬ দফা উত্থাপন করার পর শেখ মুজিব দলের মধ্যে বিপাকে পড়েছিলেন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবদুস সালাম খানসহ সিনিয়র নেতারা এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তখন ছাত্রলীগের মধ্যে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাকের সমর্থক রেডিক্যাল গ্রুপ ৬ দফার পক্ষে প্রচারাভিযান শুরু করে। মাজহারুল হক বাকী তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি, আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক। তারাই সর্বাগ্রে ৬ দফার পক্ষে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন।
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের এই স্বাধীনতাপন্থি অংশটি ৬ দফাকে এক দফার সংগ্রামের মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন এবং তৃণমূলেও সে মেসেজ পেঁৗছে দিয়েছিলেন। আমার মনে পড়ে, ১৯৬৯ সালে আমি তখন ছাত্রলীগের কর্মী, আবদুর রাজ্জাক ফরিদপুরে গিয়েছিলেন। কিছু সক্রিয় কর্মীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, ৬ দফা হলেই কি আমরা সন্তুষ্ট থাকব? না, এটি হচ্ছে সেতু। এই সেতু পেরিয়ে আমরা এক দফায় পেঁৗছব_ সেটি স্বাধীনতা। সেদিন থেকেই আমরা স্বাধীনতার অমোঘ বাণীকে ধারণ করে '৬৯-এর গণআন্দোলন এবং '৭০-এর নির্বাচনে কাজ করেছি। এভাবেই দেশের অসংখ্য কর্মীর মাঝে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তবে তখন নিউক্লিয়াস নামক শব্দটি শুনিনি। শুনেছিলাম যে, ছাত্রলীগের ভেতরে দুটি ধারা সক্রিয় রয়েছে_ স্বাধীনতাপন্থি ও ৬ দফাপন্থি। ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি ধারার নেপথ্যে যাঁরা প্রেরণা জুগিয়েছিলেন রাজ্জাক তাদের অন্যতম।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বহুল প্রচারিত তথ্য হচ্ছে_ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা '৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। এটি সত্য, কিন্তু একই সঙ্গে এও সত্য যে, দীর্ঘদিন ধরে তরুণ স্বাধীনতাকামীরা চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। ধাপে ধাপে ছয় দফার সংগ্রামকে স্বাধীনতার সিংহদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল। ইতিহাসবিদরা এ সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত।
এটি অনুধাবনযোগ্য যে, '৭১-এর মার্চে যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আলোচনা চলছে, তখন রাজপথে ধ্বনিত হচ্ছে স্বাধীনতার সপক্ষে বিভিন্ন স্লোগান_ ৬ দফার আসল কথা/স্বাধীনতা স্বাধীনতা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, পিণ্ডি না ঢাকা/ঢাকা ঢাকা ইত্যাদি। এ স্লোগানগুলো '৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় উচ্চারিত হতো। তবে '৭০-এর নির্বাচনের পর তা হয়ে ওঠে আরও অর্থবহ।
এ প্রসঙ্গে '৭০ সালের ১২ আগস্ট অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভার প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। ওই সভায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্বপন কুমার চৌধুরী 'স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ' প্রস্তাব উত্থাপন করলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তা গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবটি রেডিক্যাল গ্রুপের কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর।
'৭০-এর নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি ও ৬ দফাপন্থি উভয় ধারা এক মোহনায় মিলিত হয়। স্বাধীনতাই মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ওই পরিষদের পক্ষ থেকে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন এবং ৩ মার্চ পল্টনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে এবং রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলাকে জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করে।
১৯৭১ সালের ২ ও ৩ মার্চ এবং ২৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার যে পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল সে পতাকাটি তৈরি হয়েছিল ১৯৭০ সালেই। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের শাহাদাতবার্ষিকীতে জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ছাত্রনেতারা।
স্বাধীনতার লক্ষ্যে তারুণ্যের এ কর্মকাণ্ডকে আড়াল করে রাখা হয়েছে। সামনে আনা হচ্ছে না_ ষাটের দশকে নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা সৈনিকদের কর্মকাণ্ডও। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সবকিছুকেই পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতে ইতিহাস খর্বিত হচ্ছে। স্বাধীনতার লক্ষ্যে সব বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে সামনে তুলে ধরার মধ্য দিয়েই মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পূর্ণতা পাবে, জাতীয় গৌরবগাথা হবে আরও উদ্ভাসিত।
মুক্তিসংগ্রামের উপেক্ষিত, অথচ গৌরবোজ্জ্বল ধারার অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধেও রাজ্জাকের অবদান অপরিসীম। একাত্তরে মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) চার নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। স্বাধীনতা-উত্তরও আবদুর রাজ্জাকের সংগ্রামী তৎপরতা থেমে ছিল না। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে প্রথম কাতারে ছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির তিনি অন্যতম পুরোধা। এ সময়ে আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তখন দেখেছি, তিনি নিরলসভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম রচনায় কাজ করেছেন। বিভিন্ন দল-মতের সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গড়ে ওঠার পাশাপাশি আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান চৌধুরী, আব্দুল আহাদ চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি। যখন আন্দোলনের মাঠ থেকে দুই কমিটি একত্রীকরণের দাবি ওঠে, তখন প্রশ্ন উঠেছিল কে এর নেতৃত্ব দেবেন। সেদিন আবদুর রাজ্জাক জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে যদি উদারতার পরিচয় না দিতেন তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন বেগবান হতো না। এটি ছিল আবদুর রাজ্জাকের প্রজ্ঞার পরিচায়ক। সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু এর সমাপ্তি দেখে যেতে পারলেন না একাত্তরের এই বীর। অনেক ক্ষোভ-অভিমান নিয়ে তিনি চলে গেলেন। তার নিরলস শ্রম ও ত্যাগে গড়া আওয়ামী লীগে তিনি উপেক্ষিত ছিলেন সাম্প্রতিক সময়ে। কী তার অপরাধ? কোনো অভিযোগও আনা হয়নি। তারপরও তাকে উপেক্ষা করা হলো, মহাজোট সরকারে এ অভিজ্ঞ নেতার ভূমিকা রাখার সুযোগ হলো না।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কর্ণধার তাজউদ্দীন আহমদের প্রসঙ্গ এসে যায়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ গড়ার কাজে তিনি নিবেদিত হতে পারেননি। তিনি ছিলেন নিজ ভূমে নির্বাসিত। নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রণা থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়েছিল ঘাতকরা। তবে একাত্তরের বিজয়ী জাতি তাজউদ্দীন আহমদকে ভুলে যায়নি, কোনোদিন ভুলবে না। ভুলবে না স্বাধীনতার সংগঠক আবদুর রাজ্জাককেও।
আমি জননেতা আবদুর রাজ্জাককে সশ্রদ্ধ বিদায়ী অভিবাদন জানাই।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments