মুনাফা লুটে নিচ্ছে ফড়িয়ারা-সবজির দাম পাচ্ছেন না কৃষক by আলতাব হোসেন
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সবজির জন্য বিখ্যাত নরসিংদীতে দুই কেজি ওজনের ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ২ টাকায়। একই সাইজের বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৩ টাকায়। শিম বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকা আর বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা কেজি দরে। লাউ বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৮ টাকা পিস। বাজারে মুলার কোনো দাম নেই। ক্ষেত থেকে বাজারে এনে বিক্রি করলেই লোকসান। মুলা বিক্রি করে ভ্যান ভাড়াই উঠছে না কৃষকের। একই অবস্থা আলুর ক্ষেত্রেও। তারপরও প্রতিদিন এ দামে
পাইকার পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এর উল্টো চিত্র নরসিংদী থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরত্বের রাজধানী ঢাকার শাক-সবজির বাজারের। নরসিংদীর বারৈচা পাইকারি সবজির বাজারে শিম কেজিপ্রতি ১২ টাকা দরে বিক্রি হলেও গতকাল রোববার রাজধানীর মিরপুর ছয় নম্বর কাঁচাবাজারে খুচরা বিক্রি করতে দেখা গেছে ২৫ টাকা দরে। দুই কেজি ওজনের ফুলকপি দুই টাকায় বিক্রি হলেও রাজধানীতে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে। একইভাবে পাইকারি বাজারে ৬ টাকার প্রতি কেজি বেগুন ঢাকার খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়, লাউ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে
৪০ টাকা; ৪ টাকা কেজির আলু ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, উৎপাদনকারী কৃষক আর ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজি সবজিতে ফারাক হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কৃষকের উৎপাদন খরচ না উঠলেও মাঝখানে ফড়িয়ারা হাতিয়ে নিচ্ছে বিশাল মুনাফা। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে পরিবহন ভাড়া বাড়ায় সবজির দাম বাড়ছে বলে সবজি বিক্রেতারা দাবি করছেন। অথচ নরসিংদীর সবজির হাটগুলোতে একটি ট্রাক ঢাকায় আসতে ভাড়া নেয় সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতি ট্রাকে মাল নেওয়া হয় আট থেকে ১০ টন। এ হিসাবেও প্রতি কেজি সবজিতে পরিবহন খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা।
পানির দামে বিক্রি হচ্ছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, ওলকপি, পালং শাক ও শিম। কামলা খরচ করে ক্ষেত থেকে সবজি তুলে ভ্যান ভাড়া দিয়ে হাটে এনে বিক্রির পর কৃষকের হাতে কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না। পাইকারি বাজারে শাক-সবজির ন্যায্য দাম না পেয়ে হতাশ চাষিরা। সবজি চাষের এ ভরা মৌসুমে ন্যায্য মূল্যে শাক-সবজি বিক্রি করতে না পেরে প্রতিদিনই তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। অন্যদিকে খুচরা বাজারে সবজির উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাইকাররা জানিয়েছেন, দ্রুত পচনশীল হওয়ায় এবং সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ঢাকার বাইরের পাইকারি সবজির বাজারের সঙ্গে ঢাকার খুচরা বাজারের দামের ব্যাপক তারতম্য হচ্ছে।
সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মধ্যস্বত্বভোগীর উচ্চ মুনাফার মনোভাবের কারণে সবজিচাষি ও সাধারণ মানুষকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না কেউ। সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজের অভাব ও পাইকারদের সিন্ডিকেটের কারণে পানির দামে সারাদেশে বিক্রি হচ্ছে শীতের সবজি।
সরেজমিনে গত শুক্রবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বারৈচা পাইকারি সবজিবাজারে গিয়ে দেখা যায়, হাটের দিন আশপাশের গ্রাম থেকে শত শত সবজিচাষি ভ্যান ও রিকশায় করে বিভিন্ন ধরনের সবজি নিয়ে আসছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাজারে কথা হয় সবজিচাষি জয়নাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, পাইকারি ক্রেতারা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে হাট বসার আগেই আলোচনা করে একটা দাম ঠিক করে নেন। সে দামে পাইকাররা বাজার থেকে সবজি কেনেন। সিন্ডিকেটের কারণে শেষ পর্যন্ত লোকসান দিয়ে সবজি বিক্রি করতে হয়।
সবজি চাষ নরসিংদীর শিবপুর, বেলাব, মনোহরদী ও রায়পুরা এলাকার মূল অর্থনীতি। হাজারো কৃষকের মরা-বাঁচা। উৎপাদিত সবজি কেনা-বেচার জন্য রোজ হাট বসে। সবজি ওঠে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ ট্রাক। দুপুর থেকেই নিজ নিজ সবজির ভ্যান আগলে বসে থাকেন চাষিরা। ক্রেতারা সহজে হাটে নামেন না। তারা বসে থাকেন হাটের ধারে, চা স্টলে। কৃষকদের উদ্দেশ্যে পাইকাররা গল্পের ছলে বলেন, ঢাকায় সবজির বাজার ভালো না। আসলে এটা একটা কৌশল। এসব কথা বলে কৃষকদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেন পাইকাররা। এমন কৃত্রিম চাপ দিয়েই সবজির দাম কমিয়ে আনা হয়।
বেলাব উপজেলার হোসেননগর গ্রামের সফির উদ্দিন বলেন, 'সার ও কীটনাশকের দাম আকাশছোঁয়া। বাজারে দাম ঠিকমতো পাই না। শিবপুর উপজেলার কোন্দারপাড়া গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন সবজির ন্যায্য দাম না পেয়ে আক্ষেপ করে বলেন, ফলন ভালো হয়েছে, কিন্তু হাটে পাইকাররা একবার সবজির একটি দাম বললে আর বাড়তে চান না। তাই বাধ্য হয়ে কম দামে সবজি বিক্রি করতে হয়। শুধু বারৈচা নয়, গত শুক্র ও শনিবার জেলার শিবপুর, জঙ্গলি শিবপুর, যোশর, সৃষ্টিগড়, কোন্দারপাড়া সবজির হাট ও সবজির গ্রামগুলোতে ঘুরে সবজিচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় একই সমস্যা।
চর ধুকুন্দিচকে শিমক্ষেতে কীটনাশক দেওয়ার সময় কথা হয় কৃষক শাহজাহানের সঙ্গে। তিনি আড়াই বিঘা জমি এক লাখ টাকা দিয়ে লিজ নিয়ে শিম চাষ করেছেন। বৈরী আবহাওয়ার কারণে শিমের মুকুল প্রথম দিকে ঝরে পড়লেও বর্তমানে ফলন কিছুটা ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি। এ পর্যন্ত তিনি শিম বিক্রি করেছেন ৩০ হাজার টাকা। আরও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। ফলে তার লোকসান হবে ২০ হাজার টাকা। কথা হয় দেওয়ানেরচর গ্রামের কৃষক হাবিব ও মজিবুরের সঙ্গে। তারা জানান, চলতি সবজির মৌসুমে তারা তাদের জমিতে ধনেপাতা চাষ করে এ পর্যন্ত বিক্রি করেছেন ৭ হাজার টাকা। তিনি আরও বিক্রি করতে পারবেন ৩০ হাজার টাকার মতো। জমি চাষাবাদের খরচ বাদে তাদের লাভ থাকবে না।
নারায়ণপুর সবজির হাটে কথা হয় ঢাকার শ্যামবাজারের সৌরভী ট্রেডার্সের বেগুন সরবরাহকারী পাইকার ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'কৃষকের কাছ থেকে কেনা বেগুন বিভিন্ন সাইজের হয় এবং অনেক বেগুনে পোকা থাকে। এগুলো বাছাই করে সাইজ ও মান অনুযায়ী ভাগ করা হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় পরিবহন খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ। ফলে সবচেয়ে ভালো বেগুনের দাম কেজিপ্রতি ৩০ টাকা পড়ে যায়। স্থানীয় বাজারের সঙ্গে ঢাকার বাজারের এ পার্থক্যে আমাদের কোনো হাত নেই।'
কারওয়ানবাজারের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী আইনাল হক দাবি করেন, 'কোনো সিন্ডিকেট করে সবজি কেনা হয় না। ন্যায্যমূল্য দিয়ে আমরা সবজি কিনে নিয়ে যাই। পরিবহন খরচসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে বিক্রির সময় আমাদের বেশি লাভ থাকে না।' তিনি বলেন, 'পরিবহন খরচ ছাড়াও কারওয়ানবাজারে আড়ত ভাড়া ও পথে কয়েক স্থানে পুলিশকে চাঁদা দেওয়ার কারণে সবজির দাম বেশি পড়ে।'
মরজাল এলাকার কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, গত বছর ৫০ পয়সা কেজি দরে টমেটো বিক্রি করে এবার আর টমেটো চাষ করেননি। আগামীতে বেগুন ও কপি চাষ না করার চিন্তা করছেন এখনই।
সবজির দরপতনে হতাশ যশোরের কৃষকরা : নরসিংদীর মতোই পানির দরে সবজি বিক্রি হচ্ছে যশোর অঞ্চলে। গতকাল রোববার কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের মদনডাঙ্গা সবজি হাটে ফুলকপি প্রতি মণ ৩০ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজির দাম ৭৫ থেকে এক টাকা ২৫ পয়সা মাত্র। দেড়-দু' কেজি সাইজের বাঁধাকপি প্রতি একশ' পিস বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ' থেকে তিনশ' টাকায়। এ দামে সবজি বিক্রি করে চাষির মাথায় হাত। এ হাটে সবজিচাষি শৈলকূপা উপজেলার সাধুখালী গ্রামের আবদুল আজিজ জানান, এক বিঘা জমিতে বাঁধাকপি চাষ করেছেন। খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। নিজে চাষ করেন। হাটে প্রথম এক মণ ১৫ কেজি বাঁধাকপি এনে ৯০ টাকা বিক্রি করেছেন। ভ্যান ভাড়া লেগেছে ৩৫ টাকা এবং ক্ষেত থেকে তুলতে কামলাকে দিতে হয়েছে ৫০ টাকা। তার হাতে মাত্র ৫ টাকা অবশিষ্ট আছে। তিনি জানান, গত বছর ৫ টাকা কেজি দরে বাঁধাকপি বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। আলমডাঙ্গা গ্রামের চাষি হেকমত আলী জানান, সাড়ে ৩ বিঘা জমিতে ফুল ও বাঁধাকপি চাষে তার খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। ১৭শ' গাছ আছে। প্রতি পিস ফুলকপি ১ টাকা করে বিক্রি করছেন। এবার মোটা টাকা লোকসান হবে। মামুদপুর গ্রামের চাষি আকবর আলী জানান, ভালো মানের ফুলকপি ৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন। প্রতি পিস কপি হাটে আনতে ১ টাকা ভ্যান ভাড়া দিতে হয়। পদমদী গ্রামের চাষি গোলাম মোস্তফা ও মনিরুল ইসলাম জানান, জমি লিজ নিয়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি চাষে বিঘাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এ দামে কপি বিক্রি করলে বিঘাতে ২০ হাজার টাকা লোকসান হবে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাজারে ফুল ও বাঁধাকপির সরবরাহ আরও বাড়বে বলে তারা জানান। শেখপাড়া গ্রামের সবজিচাষি আবদুর রাজ্জাক মোল্লা জানান, ১০ কাঠা জমিতে মুলা চাষে তার খরচ হয়েছে ২ হাজার টাকা। মদনডাঙ্গা হাটে ৫ মণ মুলা একশ' টাকাতে বিক্রি করেছেন। তার মধ্যে ভ্যান ভাড়া দিতে হয়েছে ৫০ টাকা।
মেহেরপুর সদর উপজেলার তেঘড়ি, উজলপুর, সবরাজপুর, ফতেপুর, ভিটের মাঠ, বালির মাঠ, কুতুবপুর, কুলবাড়ে ও মনোহরপুর গ্রামে চাষিরা ফুল ও বাঁধাকপি বিক্রি করতে পারছেন না বলে জানান। উজলপুর গ্রামের বড়চাষি বাবলু মিয়া জানান, ২ কেজি ওজনের একটি ফুলকপি মাত্র ১ টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। দু'আড়াই কেজি সাইজে এক পিস বাঁধাকপি ৩ টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। ওলকপি প্রতি কেজি ৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। উজলপুর থেকে প্রতিদিন ৪৪-৪৫ ট্রাক সবজি ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা শহরে চালান যাচ্ছে। সবজিচাষিদের এবার পুঁজি বাঁচবে না বলে তিনি জানান। যশোর সদর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের সবজিচাষি ইজাজুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকালে বারীনগর হাটে দেড় কেজি সাইজের ফুলকপি প্র্রতি পিস মাত্র ১ টাকাতে বিক্রি হয়। বলতে গেলে মুলার কোনো দাম নেই। বারীনগরে ১০ মণ মুলা বিক্রি হয়েছে মাত্র ২শ' টাকায়। যা হাটে আনতে ভ্যান ভাড়া লেগেছে ২শ' টাকা। সাদা শিম প্রতি কেজি ৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের যশোর আঞ্চলিক অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ৫২ হাজার ৭১৭ হেক্টরে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টন।
৪০ টাকা; ৪ টাকা কেজির আলু ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, উৎপাদনকারী কৃষক আর ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজি সবজিতে ফারাক হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কৃষকের উৎপাদন খরচ না উঠলেও মাঝখানে ফড়িয়ারা হাতিয়ে নিচ্ছে বিশাল মুনাফা। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে পরিবহন ভাড়া বাড়ায় সবজির দাম বাড়ছে বলে সবজি বিক্রেতারা দাবি করছেন। অথচ নরসিংদীর সবজির হাটগুলোতে একটি ট্রাক ঢাকায় আসতে ভাড়া নেয় সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতি ট্রাকে মাল নেওয়া হয় আট থেকে ১০ টন। এ হিসাবেও প্রতি কেজি সবজিতে পরিবহন খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা।
পানির দামে বিক্রি হচ্ছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, ওলকপি, পালং শাক ও শিম। কামলা খরচ করে ক্ষেত থেকে সবজি তুলে ভ্যান ভাড়া দিয়ে হাটে এনে বিক্রির পর কৃষকের হাতে কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না। পাইকারি বাজারে শাক-সবজির ন্যায্য দাম না পেয়ে হতাশ চাষিরা। সবজি চাষের এ ভরা মৌসুমে ন্যায্য মূল্যে শাক-সবজি বিক্রি করতে না পেরে প্রতিদিনই তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। অন্যদিকে খুচরা বাজারে সবজির উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাইকাররা জানিয়েছেন, দ্রুত পচনশীল হওয়ায় এবং সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ঢাকার বাইরের পাইকারি সবজির বাজারের সঙ্গে ঢাকার খুচরা বাজারের দামের ব্যাপক তারতম্য হচ্ছে।
সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মধ্যস্বত্বভোগীর উচ্চ মুনাফার মনোভাবের কারণে সবজিচাষি ও সাধারণ মানুষকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না কেউ। সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজের অভাব ও পাইকারদের সিন্ডিকেটের কারণে পানির দামে সারাদেশে বিক্রি হচ্ছে শীতের সবজি।
সরেজমিনে গত শুক্রবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বারৈচা পাইকারি সবজিবাজারে গিয়ে দেখা যায়, হাটের দিন আশপাশের গ্রাম থেকে শত শত সবজিচাষি ভ্যান ও রিকশায় করে বিভিন্ন ধরনের সবজি নিয়ে আসছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাজারে কথা হয় সবজিচাষি জয়নাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, পাইকারি ক্রেতারা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে হাট বসার আগেই আলোচনা করে একটা দাম ঠিক করে নেন। সে দামে পাইকাররা বাজার থেকে সবজি কেনেন। সিন্ডিকেটের কারণে শেষ পর্যন্ত লোকসান দিয়ে সবজি বিক্রি করতে হয়।
সবজি চাষ নরসিংদীর শিবপুর, বেলাব, মনোহরদী ও রায়পুরা এলাকার মূল অর্থনীতি। হাজারো কৃষকের মরা-বাঁচা। উৎপাদিত সবজি কেনা-বেচার জন্য রোজ হাট বসে। সবজি ওঠে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ ট্রাক। দুপুর থেকেই নিজ নিজ সবজির ভ্যান আগলে বসে থাকেন চাষিরা। ক্রেতারা সহজে হাটে নামেন না। তারা বসে থাকেন হাটের ধারে, চা স্টলে। কৃষকদের উদ্দেশ্যে পাইকাররা গল্পের ছলে বলেন, ঢাকায় সবজির বাজার ভালো না। আসলে এটা একটা কৌশল। এসব কথা বলে কৃষকদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেন পাইকাররা। এমন কৃত্রিম চাপ দিয়েই সবজির দাম কমিয়ে আনা হয়।
বেলাব উপজেলার হোসেননগর গ্রামের সফির উদ্দিন বলেন, 'সার ও কীটনাশকের দাম আকাশছোঁয়া। বাজারে দাম ঠিকমতো পাই না। শিবপুর উপজেলার কোন্দারপাড়া গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন সবজির ন্যায্য দাম না পেয়ে আক্ষেপ করে বলেন, ফলন ভালো হয়েছে, কিন্তু হাটে পাইকাররা একবার সবজির একটি দাম বললে আর বাড়তে চান না। তাই বাধ্য হয়ে কম দামে সবজি বিক্রি করতে হয়। শুধু বারৈচা নয়, গত শুক্র ও শনিবার জেলার শিবপুর, জঙ্গলি শিবপুর, যোশর, সৃষ্টিগড়, কোন্দারপাড়া সবজির হাট ও সবজির গ্রামগুলোতে ঘুরে সবজিচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় একই সমস্যা।
চর ধুকুন্দিচকে শিমক্ষেতে কীটনাশক দেওয়ার সময় কথা হয় কৃষক শাহজাহানের সঙ্গে। তিনি আড়াই বিঘা জমি এক লাখ টাকা দিয়ে লিজ নিয়ে শিম চাষ করেছেন। বৈরী আবহাওয়ার কারণে শিমের মুকুল প্রথম দিকে ঝরে পড়লেও বর্তমানে ফলন কিছুটা ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি। এ পর্যন্ত তিনি শিম বিক্রি করেছেন ৩০ হাজার টাকা। আরও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। ফলে তার লোকসান হবে ২০ হাজার টাকা। কথা হয় দেওয়ানেরচর গ্রামের কৃষক হাবিব ও মজিবুরের সঙ্গে। তারা জানান, চলতি সবজির মৌসুমে তারা তাদের জমিতে ধনেপাতা চাষ করে এ পর্যন্ত বিক্রি করেছেন ৭ হাজার টাকা। তিনি আরও বিক্রি করতে পারবেন ৩০ হাজার টাকার মতো। জমি চাষাবাদের খরচ বাদে তাদের লাভ থাকবে না।
নারায়ণপুর সবজির হাটে কথা হয় ঢাকার শ্যামবাজারের সৌরভী ট্রেডার্সের বেগুন সরবরাহকারী পাইকার ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'কৃষকের কাছ থেকে কেনা বেগুন বিভিন্ন সাইজের হয় এবং অনেক বেগুনে পোকা থাকে। এগুলো বাছাই করে সাইজ ও মান অনুযায়ী ভাগ করা হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় পরিবহন খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ। ফলে সবচেয়ে ভালো বেগুনের দাম কেজিপ্রতি ৩০ টাকা পড়ে যায়। স্থানীয় বাজারের সঙ্গে ঢাকার বাজারের এ পার্থক্যে আমাদের কোনো হাত নেই।'
কারওয়ানবাজারের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী আইনাল হক দাবি করেন, 'কোনো সিন্ডিকেট করে সবজি কেনা হয় না। ন্যায্যমূল্য দিয়ে আমরা সবজি কিনে নিয়ে যাই। পরিবহন খরচসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে বিক্রির সময় আমাদের বেশি লাভ থাকে না।' তিনি বলেন, 'পরিবহন খরচ ছাড়াও কারওয়ানবাজারে আড়ত ভাড়া ও পথে কয়েক স্থানে পুলিশকে চাঁদা দেওয়ার কারণে সবজির দাম বেশি পড়ে।'
মরজাল এলাকার কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, গত বছর ৫০ পয়সা কেজি দরে টমেটো বিক্রি করে এবার আর টমেটো চাষ করেননি। আগামীতে বেগুন ও কপি চাষ না করার চিন্তা করছেন এখনই।
সবজির দরপতনে হতাশ যশোরের কৃষকরা : নরসিংদীর মতোই পানির দরে সবজি বিক্রি হচ্ছে যশোর অঞ্চলে। গতকাল রোববার কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের মদনডাঙ্গা সবজি হাটে ফুলকপি প্রতি মণ ৩০ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজির দাম ৭৫ থেকে এক টাকা ২৫ পয়সা মাত্র। দেড়-দু' কেজি সাইজের বাঁধাকপি প্রতি একশ' পিস বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ' থেকে তিনশ' টাকায়। এ দামে সবজি বিক্রি করে চাষির মাথায় হাত। এ হাটে সবজিচাষি শৈলকূপা উপজেলার সাধুখালী গ্রামের আবদুল আজিজ জানান, এক বিঘা জমিতে বাঁধাকপি চাষ করেছেন। খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। নিজে চাষ করেন। হাটে প্রথম এক মণ ১৫ কেজি বাঁধাকপি এনে ৯০ টাকা বিক্রি করেছেন। ভ্যান ভাড়া লেগেছে ৩৫ টাকা এবং ক্ষেত থেকে তুলতে কামলাকে দিতে হয়েছে ৫০ টাকা। তার হাতে মাত্র ৫ টাকা অবশিষ্ট আছে। তিনি জানান, গত বছর ৫ টাকা কেজি দরে বাঁধাকপি বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। আলমডাঙ্গা গ্রামের চাষি হেকমত আলী জানান, সাড়ে ৩ বিঘা জমিতে ফুল ও বাঁধাকপি চাষে তার খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। ১৭শ' গাছ আছে। প্রতি পিস ফুলকপি ১ টাকা করে বিক্রি করছেন। এবার মোটা টাকা লোকসান হবে। মামুদপুর গ্রামের চাষি আকবর আলী জানান, ভালো মানের ফুলকপি ৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন। প্রতি পিস কপি হাটে আনতে ১ টাকা ভ্যান ভাড়া দিতে হয়। পদমদী গ্রামের চাষি গোলাম মোস্তফা ও মনিরুল ইসলাম জানান, জমি লিজ নিয়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি চাষে বিঘাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এ দামে কপি বিক্রি করলে বিঘাতে ২০ হাজার টাকা লোকসান হবে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাজারে ফুল ও বাঁধাকপির সরবরাহ আরও বাড়বে বলে তারা জানান। শেখপাড়া গ্রামের সবজিচাষি আবদুর রাজ্জাক মোল্লা জানান, ১০ কাঠা জমিতে মুলা চাষে তার খরচ হয়েছে ২ হাজার টাকা। মদনডাঙ্গা হাটে ৫ মণ মুলা একশ' টাকাতে বিক্রি করেছেন। তার মধ্যে ভ্যান ভাড়া দিতে হয়েছে ৫০ টাকা।
মেহেরপুর সদর উপজেলার তেঘড়ি, উজলপুর, সবরাজপুর, ফতেপুর, ভিটের মাঠ, বালির মাঠ, কুতুবপুর, কুলবাড়ে ও মনোহরপুর গ্রামে চাষিরা ফুল ও বাঁধাকপি বিক্রি করতে পারছেন না বলে জানান। উজলপুর গ্রামের বড়চাষি বাবলু মিয়া জানান, ২ কেজি ওজনের একটি ফুলকপি মাত্র ১ টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। দু'আড়াই কেজি সাইজে এক পিস বাঁধাকপি ৩ টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। ওলকপি প্রতি কেজি ৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। উজলপুর থেকে প্রতিদিন ৪৪-৪৫ ট্রাক সবজি ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা শহরে চালান যাচ্ছে। সবজিচাষিদের এবার পুঁজি বাঁচবে না বলে তিনি জানান। যশোর সদর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের সবজিচাষি ইজাজুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকালে বারীনগর হাটে দেড় কেজি সাইজের ফুলকপি প্র্রতি পিস মাত্র ১ টাকাতে বিক্রি হয়। বলতে গেলে মুলার কোনো দাম নেই। বারীনগরে ১০ মণ মুলা বিক্রি হয়েছে মাত্র ২শ' টাকায়। যা হাটে আনতে ভ্যান ভাড়া লেগেছে ২শ' টাকা। সাদা শিম প্রতি কেজি ৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের যশোর আঞ্চলিক অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ৫২ হাজার ৭১৭ হেক্টরে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টন।
No comments