পাকিস্তান-গিলানি সরকারের ব্যর্থতাই ইমরানের শক্তি by ফারহান বোখারি

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি গত সপ্তাহে তাঁর গণতান্ত্রিক সরকারের পতনের জন্য ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি করলেও পুরোটা বোধগম্য হয়নি। গিলানির সরকারের চতুর্থ বছর চলছে। সরকারকে ঘিরে ব্যাপক হতাশার পটভূমিতে ২০১৩ সালের গোড়ায় সফলভাবে মেয়াদ শেষ করায় তারা অসামর্থ্য বলেই মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যদিও ক্ষমতাসীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগে সরাসরি সেনাবাহিনীর নাম করলেও এটা বলেছেন যে


সেনাবাহিনীকে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে এবং তারা রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটি রাষ্ট্রের মতো আচরণ করতে পারে না। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এমন একসময়ে গিলানি এ কথা তুলেছেন, যখন পাকিস্তানের ইতিহাসের কঠিন এক সময় যাচ্ছে এবং তাঁর সরকার মানুষের হাস্যরসের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই সরকারের মেয়াদ শুরু হয় ২০০৮ সালের গোড়ার নির্বাচনের পর। তাঁদের পুরো আমলটার দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, কঠিন নিরাপত্তাহীনতা ও বিপর্যস্ত অর্থনীতি মিলিয়ে যেসব কঠিন চ্যালেঞ্জ পাকিস্তানের সামনে উপস্থিত হয়েছে, সেগুলো মোকাবিলার কোনো সূত্রপাত তাঁরা করতে পারেনি।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন হওয়ার চার বছরের মাথায় পাকিস্তান গিয়ে পড়েছে শাসকগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ বিবাদের পাকে-চক্রে। শীর্ষ মহলের দুর্নীতি ক্রমেই দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হচ্ছে এবং মনে হচ্ছে, এ রকমটা চলতে থাকা নিয়ে সরকারের কোনো সমস্যা নেই।
প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের ভেতরকার ‘অগণতান্ত্রিক’ চরিত্রগুলোর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন, তাঁর কথায়, যারা গণতন্ত্রের ক্ষতি করতে উন্মুখ, তখন তাঁর উচিত ছিল তাঁর সরকারের বহু ব্যর্থতার কথাও স্বীকার করা।
এ বিষয়ে বা অন্য কোনো বিষয়ে সরকারের অবস্থানটা কী তা পর্যালোচনার আগে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য একটা চিত্র তুলে ধরা দরকার। অবশ্যই সাধারণ পাকিস্তানিরা এখনো রুটি-মাখনের বিষয় দিয়েই তাদের শাসকদের বিচার করে থাকে।
এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সমর্থকদের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং জীবনের নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ নতুন বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। একই সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে অর্থনীতির শক্তি শুষে নিচ্ছে, তারও একটা বিহিত করার চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে। সাধারণ মানুষের জন্য আবশ্যকীয় সেবাগুলো যেমন—রেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহব্যবস্থা দিনকে দিন অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাসের নামে পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক সামাজিক-অর্থনৈতিক খাতে বরাদ্দ কমানো।
অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের আরেকটি বড় কারণ হলো শাসককুলের শীর্ষ লোকদের ব্যাপক দুর্নীতিতে গা ভাসানো। সরকারের জন্য বড় দুর্নামের কারণ হয়েছিল ‘হজ-দুর্নীতি’। ক্ষমতাসীনদের একটি অংশ সৌদি আরবে হজে যাওয়া পাকিস্তানিদের থাকার বন্দোবস্ত থেকে বিরাট আকারের অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করে।
অন্য একটি ঘটনাও সামনে চলে আসে। সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারা যাতে সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির দুর্নীতির মামলাটি নতুন করে চালানোর জন্য আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানায়। কিন্তু সরকার আদেশটি অমান্য করে।
এ রকম মন্দ রেকর্ড যে সরকারের, অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এ অবস্থায় বেশির ভাগ পাকিস্তানি ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া ইমরান খানের সঙ্গে হাত মেলাবে। ইমরান তাঁর ১৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় জনসভাটি করাচিতে করতে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানের জনগণ যে পরিবর্তনের জন্য অধীর, তারই প্রমাণ ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি। পাকিস্তানি রাজনীতিকে যেসব শক্তি দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে, তাদের ব্যাপারে মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দৃশ্যত নতুন দল হলেও অনেক বেশি আস্থাভাজন হচ্ছে ইমরানের দল। ইমরানের রাজনৈতিক খ্যাতি আরও তুঙ্গে ওঠার একটা কারণ হচ্ছে, একটি ক্যানসার হাসপাতাল এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
গিলানির জন্য অনেক বেশি দরকার হলো, তাঁর সরকারকে ঘিরে যেসব অভিযোগ ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে, সেগুলোর প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া। তাঁর জন্য উচিত কাজ হবে, কল্পিত ষড়যন্ত্র নিয়ে ব্যাকুল হওয়ার চেয়ে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। তা না হলে তিনিসহ পাকিস্তানের শাসক মহল ঘটনাক্রমে পতিত হবেন। কারণ, তাঁরা পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে আস্থার অনুভব জাগাতে পারেননি। কারণ, পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটময় সময়ে তাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে হাল ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

গালফ নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ফারহান বোখারি: পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.