ইতিহাসে তাঁর স্থান নির্ধারিত by করুণাময় গোস্বামী
দূর লন্ডনে আবদুর রাজ্জাক এমপির মৃত্যু হলো। অনেক দিন ধরে তিনি অসুখে ভুগছিলেন। শেষ পর্যন্ত অসুখ জয়ী হলো এবং তাঁর জীবনদীপ নিভে গেল। তিনি একেবারে আমাদের সমবয়সী ছিলেন। একই সালে আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময়কার ছাত্র আমরা। তিনি পলিটিক্যাল সায়েন্সে ও আমি ইংরেজিতে পড়েছি। আমরা যখন ছাত্র, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির একটা তুঙ্গ অবস্থা। ১৯৬২ সালের ছাত্র
আন্দোলনের শেষে পূর্ব পাকিস্তানে বা বর্তমান বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতিসহ সামগ্রিক রাজনীতির একটা প্রচণ্ড গুণগত পরিবর্তন এসেছে। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ ঘটছিল, তার একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা গড়ে উঠছিল ১৯৬২ সালের পর থেকে, যদিও ১৯৫৪-এর পর থেকেই এ চিন্তাধারাটি পর্যায়ক্রমিক রূপ পাচ্ছিল। ১৯৬২ সালের আন্দোলন ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে পূর্বাপর গড়ে ওঠা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতি ঐতিহাসিক সংগ্রামী সমর্থন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। দুটি ধারা তখন জোরদার হয়ে কাজ করছিল। যদিও একটি ধারার মানসিক জোর ছিল কম, তার তুলনায় শারীরিক জোর ছিল বেশি। সে ধারাটি ছিল সরকারি মদদপুষ্ট পাকিস্তানবাদী ধারা। আর যে ধারাটি মানসিকভাবে বা প্রগতিশীল, দার্শনিকভাবে অনেক জোরদার ছিল, সে ছিল পাকিস্তানবাদবিরোধী বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা, যে ধারার কেন্দ্রীয় চিন্তার প্রধান উপাদান ছিল বাংলাদেশের মানুষের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি। এই দ্বিতীয় ধারার একজন উল্লেখযোগ্য ছাত্রনেতা ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। আমাদের সময় ছাত্রনেতাদের একটা প্রধান গুণ ছিল চমৎকার বক্তৃতা করা। বক্তা হিসেবে ছাত্রমহলে তখন প্রচণ্ড খ্যাতির অধিকারী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তাঁকে বলা হতো অগি্নকন্যা। আমি হলফ করে বলতে পারি, এটা কোনো অতিশয়োক্তি ছিল না। তিনি সত্যি সত্যি শ্রোতার মনে প্রচণ্ড তাপ সৃষ্টি করার মতো বক্তৃতা করতে পারতেন। আবদুর রাজ্জাকও অত্যন্ত সুবক্তা ছিলেন। রাজনৈতিক বক্তৃতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, সে একাডেমিক বক্তৃতার মতো নয়। রাজনৈতিক বক্তৃতার সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অসামান্য জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর এবং সেই সঙ্গে অবারিত শব্দমালার উত্থান-পতন রাজনৈতিক বক্তৃতার ইতিহাসে এক মহাদৃষ্টান্তস্থানীয় ঘটনা। তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁর কণ্ঠস্বরে যদি তাঁর বাংলায় বক্তৃতাটি ইংরেজি বা পৃথিবীর অন্যান্য প্রধান ভাষায় অনুবাদ করে গ্রথিত করে দেওয়া যায়, সেটা সম্ভব কি না সে আমি বুঝি না, তাহলে এক অসামান্য কাজ সাধন করা যায়। আবদুর রাজ্জাক তাঁর বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করতেন। তিনি তাঁর বক্তৃতাকে একটি পর্যায়ে উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ছয় দফার আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি যাবতীয় আন্দোলনে আবদুর রাজ্জাকের একটি প্রচণ্ড সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ছাত্রনেতা, যুবনেতা ও পরিণত নেতা হিসেবে আবদুর রাজ্জাক নিজের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য স্থান রচনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস রাখা যায়, এমন একটি অবস্থান তিনি ছাত্রনেতা হিসেবেই।
আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ অনেক দলনেতা শোক প্রকাশ করেছেন। মৃত্যু মানুষকে একত্র করে। শোকেরও একটা প্রচণ্ড শক্তি আছে মানুষকে মেলানোর। এই শক্তিটা ঠিক যে কিসের, তা আমরা জানি না। তবে মনে হয়, এ শক্তির উৎস হচ্ছে সেই তীব্র বেদনাবোধ যে কারো জীবন স্থায়ী নয়। মানুষ বাঁচতে চায়, আবার বাঁচতে পারে না। এই বাঁচা না বাঁচার দ্বৈরথে না বাঁচাই জয়ী হয়। এই না বাঁচার জয়ই মানুষকে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে একত্র করে। এই একতার বোধটি পবিত্র ও মহৎ। বাংলাদেশে বা পৃথিবীর সব দেশেই মানুষের মধ্যে এই পবিত্র একত্ববোধ কাজ করলে ভালো। সমাজ এগোয় একত্র শক্তির জোরে। মানুষের সামূহিক শক্তি যদি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন থাকে, তাহলে মানুষ যেমনটা চায় তেমনটা এগোতে পারে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে বিজয়, তা অগণিত মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত। আমাদের ভোলা উচিত নয় যে মানুষের প্রিয়তম বস্তু হচ্ছে প্রাণ। অগণিত মানুষ তাঁদের অগণিত প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গেলেন, যাতে তাঁদের অগণিততর দেশবাসী স্বাধীন হতে পারেন, সুখী জীবন যাপন করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রেখে বাংলাদেশের মানুষ যেন একতাবদ্ধ থাকে, এর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার চেয়ে আর কোনো বড় দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায় না। মানুষের ইতিহাসে এর চেয়ে মহৎ কোনো দৃষ্টান্ত নেই। আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুশোক যদি বাংলাদেশের মানুষকে সেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শস্নাত ঐক্যের দিকে নিয়ে যায়, তাহলে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শনের একটি প্রয়োজনীয় কাজ হয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ অনেক দলনেতা শোক প্রকাশ করেছেন। মৃত্যু মানুষকে একত্র করে। শোকেরও একটা প্রচণ্ড শক্তি আছে মানুষকে মেলানোর। এই শক্তিটা ঠিক যে কিসের, তা আমরা জানি না। তবে মনে হয়, এ শক্তির উৎস হচ্ছে সেই তীব্র বেদনাবোধ যে কারো জীবন স্থায়ী নয়। মানুষ বাঁচতে চায়, আবার বাঁচতে পারে না। এই বাঁচা না বাঁচার দ্বৈরথে না বাঁচাই জয়ী হয়। এই না বাঁচার জয়ই মানুষকে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে একত্র করে। এই একতার বোধটি পবিত্র ও মহৎ। বাংলাদেশে বা পৃথিবীর সব দেশেই মানুষের মধ্যে এই পবিত্র একত্ববোধ কাজ করলে ভালো। সমাজ এগোয় একত্র শক্তির জোরে। মানুষের সামূহিক শক্তি যদি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন থাকে, তাহলে মানুষ যেমনটা চায় তেমনটা এগোতে পারে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে বিজয়, তা অগণিত মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত। আমাদের ভোলা উচিত নয় যে মানুষের প্রিয়তম বস্তু হচ্ছে প্রাণ। অগণিত মানুষ তাঁদের অগণিত প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গেলেন, যাতে তাঁদের অগণিততর দেশবাসী স্বাধীন হতে পারেন, সুখী জীবন যাপন করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রেখে বাংলাদেশের মানুষ যেন একতাবদ্ধ থাকে, এর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার চেয়ে আর কোনো বড় দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায় না। মানুষের ইতিহাসে এর চেয়ে মহৎ কোনো দৃষ্টান্ত নেই। আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুশোক যদি বাংলাদেশের মানুষকে সেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শস্নাত ঐক্যের দিকে নিয়ে যায়, তাহলে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শনের একটি প্রয়োজনীয় কাজ হয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
No comments