কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-দগ্ধজন ভগ্ন নয় by রণজিৎ বিশ্বাস
আপনার কিছু হতাশার কথা বলুন। : আমার হতাশা খুব বেশি নেই। দু-চারটি যা আছে, তাও থাকার মতো নয়।
: থাকার মতো নয় মানে?! : থাকার মতো নয় মানে, সেগুলো আমাকে খুব ব্যতিব্যস্ত ও অস্বস্ত রাখতে পারে না। সেগুলোকে আমি ম্যানেজ করতে পারি, মোকাবিলা করতে পারি, বকা দিতে পারি, ভয় পাওয়াতে পারি, চোখ রাঙাতে পারি, শাসন করতে পারি। : তার পরও তো আপনি নিজেকে দগ্ধজন বলে প্রচার করেছেন।
: থাকার মতো নয় মানে?! : থাকার মতো নয় মানে, সেগুলো আমাকে খুব ব্যতিব্যস্ত ও অস্বস্ত রাখতে পারে না। সেগুলোকে আমি ম্যানেজ করতে পারি, মোকাবিলা করতে পারি, বকা দিতে পারি, ভয় পাওয়াতে পারি, চোখ রাঙাতে পারি, শাসন করতে পারি। : তার পরও তো আপনি নিজেকে দগ্ধজন বলে প্রচার করেছেন।
: করেছি। মিথ্যে কিছু বলিনি! যারা আমাকে পুড়তে দেখেছে, তারা জানে, কেন আমি পুড়েছি, কতটুকু পুড়েছি, কাদের হাতে পুড়েছি। তারা জানে কাকে বলে দগ্ধজন। দেহের বয়সের সঙ্গে মনের বয়সের সংগতি থাকলে আপনিও বুঝতে পারতেন।
: তাহলে আপনার কথা থেকে এগজ্যাক্টলি কী বুঝব?
: এগজ্যাক্টলি তাই বুঝবেন, যা এগজ্যাক্ট। দগ্ধজন মানেই ভগ্নজন নয়। দগ্ধজন মানেই মৃতজন নয়।
: তার পরও কি আপনি ভাবেন না_এই ছবিটি আমাকে পীড়া দিচ্ছে, এই দৃশ্যটি সরে গেলে ভালো হতো, ওই ছবিটি বসে গেলে আনন্দ জুটত, সেই মুরতির জীবনযতি প্রাণে বড় শান্তি দিত।
: ভাবি। বারবার ভাবি। ভেবে ভেবে হতাশার ওপর হুইপিং করি, তার পিঠের পরে চাবুক মারি।
: তেমন কয়েকটি হতাশার কথা বলুন, যা আপনি চাবকাতে ভালোবাসেন।
: চাবকাতে ভালোবাসি শুধু নয়, চাবকানো কর্তব্য মনে করি। কেন বেশি বেশি লোক সেগুলোকে না চাবকে অন্যের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়, আর পায়ের ওপর তুলে দেওয়া পায়ে প্যাঁচ দিয়ে মৃদু মৃদু হেসে হেসে চা-চানাচুর খায়, তাও আমি বুঝি না।
: ঠিক আছে, আর ক্ষেপামোর দরকার নেই, সেগুলোর কথাই বলুন। আমরা শুনব এবং লিপিবদ্ধ করব।
: প্রথম কথা হচ্ছে_আমরা এখনো বুঝতে পাচ্ছি না, কেরোসিনে দগ্ধ হওয়া কিংবা এসিডে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে সাম্প্রদায়িকতায়, ভেদবুদ্ধিতে ও ধর্মান্ধতায় দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা অনেক বেশি। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, যারা ওই অস্ত্রে মানুষ মারে ও মানুষ পোড়ে_তারা যে মানুষ, সমাজ ও দেশের কত ক্ষতি করতে পারে, তা এখনো আমরা দেশের সরলসোজা ও শুচিশুদ্ধ মানুষকে বুঝিয়ে দিতে পাচ্ছি না।
তৃতীয়, যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী, যারা মানবতাবিরোধী, যারা সাম্যনিরোধী ও যাদের ইয়ারদোস্তরা সব যুদ্ধাপরাধী_তারা কেন করে হুংকারচিৎকার, তা কিছু মানুষের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়।
চতুর্থ, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও রক্তজীবীদের বিচারে যারা বিভক্তি দেখে, তারা কেন বুঝতে পারে না যে জাতির বিভক্তিরোধ এবং ঐক্য ও সংহতিবোধের জন্যই অবিলম্বে এদের যথাপ্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে।
পঞ্চম, ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের স্বঘোষিত হোতাদের অতিবিলম্বিত প্রাপ্যটি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের ভূগোলের ভেতর আমরা এখনো ঢোকাতে পারছি না এবং এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অকল্পনীয় বিশ্বাসঘাতকতায় জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে খন্দকার মোশতাকসহ অন্তত দুইজন লোকের মরণোত্তর বিচারের ব্যবস্থা আমরা করতে পারছি না।
ষষ্ঠ, আমরা দুই নয়ানের আঁধি কেটে সবার বোধিতে এখনো পরিষ্কার করে দিতে পারিনি_প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কখনো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী হতে পারে না, কখনো সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী হতে পারে না এবং দেশের কল্যাণকামী কোনো মানবসন্তান একটি জাতির সবচেয়ে শোকের বেদনার ও ক্রন্দনের দিনে ব্যক্তিগত কোনো আনন্দদিন ফিট করে নিতে পারে না।
: তাহলে কারো আনন্দদিনে শোকের কোনো ঘটনা ঘটতে পারে না? প্রচণ্ড কোনো শোকের দিনে কিংবা ভয়াবহ কোনো নিষ্ঠুরতার দিনে কারো জীবনের আনন্দদিন পড়বে না?! এটি তো বড় জবরদস্তির কথা হলো!
: মোটেই কোনো জবরদস্তির কথা হয়নি। দয়া করে ছাগলের মতো কথা বলবেন না। মান এবং হুঁশসম্পন্ন প্রাণী মানুষের মতো কথা বলুন, নইলে আমার কক্ষের খোলা দরোজাটি ব্যবহারের জন্য বহির্মুখী হোন। একটি জাতির সবচেয়ে শোকের দিনে কারো জীবনের খুব বড় একটি আনন্দদিন পড়তে পারবে না কেন!! এক শ তিনবার পড়তে পারবে! সাত শ সাঁইত্রিশবার পড়তে পারবে! আঠারো হাজার পাঁচ শ উনিশবার পড়তে পারবে! কিন্তু, হঠাৎ করে ফিট করা যাবে না। সেটি ভদ্রতাবিরোধী, রুচিবিরোধী, সততা ও সাধুতার পরিপন্থী। যারা তেমন দিনের পালনে-উদ্যাপনে উৎসাহ জোগায় ও আনন্দভোজের 'উৎসবপিষ্টক' কর্তনের সময় ঘিরে দাঁড়িয়ে করতালিমুখর হয়, তাদের বিষয়টিও মানুষ কিভাবে অনুমোদন করে বুঝতে বড় কষ্ট হয়। তাতে সঙ্গ দেওয়ার জন্য দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের কোনো কোনো মানুষও যে কিভাবে সার বাঁধে_বোঝার চেষ্টায় আমি ব্যর্থ হই। বারবার ব্যর্থ হই, বারবার লজ্জা পাই।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, বেইজিং, গণচীন
: তাহলে আপনার কথা থেকে এগজ্যাক্টলি কী বুঝব?
: এগজ্যাক্টলি তাই বুঝবেন, যা এগজ্যাক্ট। দগ্ধজন মানেই ভগ্নজন নয়। দগ্ধজন মানেই মৃতজন নয়।
: তার পরও কি আপনি ভাবেন না_এই ছবিটি আমাকে পীড়া দিচ্ছে, এই দৃশ্যটি সরে গেলে ভালো হতো, ওই ছবিটি বসে গেলে আনন্দ জুটত, সেই মুরতির জীবনযতি প্রাণে বড় শান্তি দিত।
: ভাবি। বারবার ভাবি। ভেবে ভেবে হতাশার ওপর হুইপিং করি, তার পিঠের পরে চাবুক মারি।
: তেমন কয়েকটি হতাশার কথা বলুন, যা আপনি চাবকাতে ভালোবাসেন।
: চাবকাতে ভালোবাসি শুধু নয়, চাবকানো কর্তব্য মনে করি। কেন বেশি বেশি লোক সেগুলোকে না চাবকে অন্যের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়, আর পায়ের ওপর তুলে দেওয়া পায়ে প্যাঁচ দিয়ে মৃদু মৃদু হেসে হেসে চা-চানাচুর খায়, তাও আমি বুঝি না।
: ঠিক আছে, আর ক্ষেপামোর দরকার নেই, সেগুলোর কথাই বলুন। আমরা শুনব এবং লিপিবদ্ধ করব।
: প্রথম কথা হচ্ছে_আমরা এখনো বুঝতে পাচ্ছি না, কেরোসিনে দগ্ধ হওয়া কিংবা এসিডে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে সাম্প্রদায়িকতায়, ভেদবুদ্ধিতে ও ধর্মান্ধতায় দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা অনেক বেশি। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, যারা ওই অস্ত্রে মানুষ মারে ও মানুষ পোড়ে_তারা যে মানুষ, সমাজ ও দেশের কত ক্ষতি করতে পারে, তা এখনো আমরা দেশের সরলসোজা ও শুচিশুদ্ধ মানুষকে বুঝিয়ে দিতে পাচ্ছি না।
তৃতীয়, যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী, যারা মানবতাবিরোধী, যারা সাম্যনিরোধী ও যাদের ইয়ারদোস্তরা সব যুদ্ধাপরাধী_তারা কেন করে হুংকারচিৎকার, তা কিছু মানুষের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়।
চতুর্থ, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও রক্তজীবীদের বিচারে যারা বিভক্তি দেখে, তারা কেন বুঝতে পারে না যে জাতির বিভক্তিরোধ এবং ঐক্য ও সংহতিবোধের জন্যই অবিলম্বে এদের যথাপ্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে।
পঞ্চম, ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের স্বঘোষিত হোতাদের অতিবিলম্বিত প্রাপ্যটি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের ভূগোলের ভেতর আমরা এখনো ঢোকাতে পারছি না এবং এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অকল্পনীয় বিশ্বাসঘাতকতায় জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে খন্দকার মোশতাকসহ অন্তত দুইজন লোকের মরণোত্তর বিচারের ব্যবস্থা আমরা করতে পারছি না।
ষষ্ঠ, আমরা দুই নয়ানের আঁধি কেটে সবার বোধিতে এখনো পরিষ্কার করে দিতে পারিনি_প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কখনো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী হতে পারে না, কখনো সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী হতে পারে না এবং দেশের কল্যাণকামী কোনো মানবসন্তান একটি জাতির সবচেয়ে শোকের বেদনার ও ক্রন্দনের দিনে ব্যক্তিগত কোনো আনন্দদিন ফিট করে নিতে পারে না।
: তাহলে কারো আনন্দদিনে শোকের কোনো ঘটনা ঘটতে পারে না? প্রচণ্ড কোনো শোকের দিনে কিংবা ভয়াবহ কোনো নিষ্ঠুরতার দিনে কারো জীবনের আনন্দদিন পড়বে না?! এটি তো বড় জবরদস্তির কথা হলো!
: মোটেই কোনো জবরদস্তির কথা হয়নি। দয়া করে ছাগলের মতো কথা বলবেন না। মান এবং হুঁশসম্পন্ন প্রাণী মানুষের মতো কথা বলুন, নইলে আমার কক্ষের খোলা দরোজাটি ব্যবহারের জন্য বহির্মুখী হোন। একটি জাতির সবচেয়ে শোকের দিনে কারো জীবনের খুব বড় একটি আনন্দদিন পড়তে পারবে না কেন!! এক শ তিনবার পড়তে পারবে! সাত শ সাঁইত্রিশবার পড়তে পারবে! আঠারো হাজার পাঁচ শ উনিশবার পড়তে পারবে! কিন্তু, হঠাৎ করে ফিট করা যাবে না। সেটি ভদ্রতাবিরোধী, রুচিবিরোধী, সততা ও সাধুতার পরিপন্থী। যারা তেমন দিনের পালনে-উদ্যাপনে উৎসাহ জোগায় ও আনন্দভোজের 'উৎসবপিষ্টক' কর্তনের সময় ঘিরে দাঁড়িয়ে করতালিমুখর হয়, তাদের বিষয়টিও মানুষ কিভাবে অনুমোদন করে বুঝতে বড় কষ্ট হয়। তাতে সঙ্গ দেওয়ার জন্য দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের কোনো কোনো মানুষও যে কিভাবে সার বাঁধে_বোঝার চেষ্টায় আমি ব্যর্থ হই। বারবার ব্যর্থ হই, বারবার লজ্জা পাই।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, বেইজিং, গণচীন
No comments