আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মশুদ্ধির বড়দিন-রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী
বছর ঘুরে আবার ফিরে এসেছে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় আনন্দোৎসব শুভ বড়দিন। খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে মানুষের জন্য আজ ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ দান তাঁর পুত্র যিশুখ্রিস্ট। আজ বিশ্বব্যাপী পরিবারে পরিবারে, গির্জায় গির্জায়, সব খ্রিস্টান কৃতজ্ঞতা ও ভক্তিতে স্মরণ করবে সব মানুষের জন্য স্রষ্টা এবং প্রেমময় পিতা ঈশ্বরের এক জাতপুত্র প্রভু যিশুকে এ জগতে মানবরূপে প্রেরণ করার কথা। বড়দিন পাপের দাসত্ব থেকে মানুষকে উদ্ধারের জন্য
ঈশ্বরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ঈশ্বরের পবিত্র প্রেম উপলব্ধি করে পাপ ও হিংসার পথ ত্যাগ করে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসায় জীবন পরিচালনা করার শপথ গ্রহণ করার দিন। পবিত্র বাইবেলে পুরনো নিয়মে মানুষের জন্য ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ আজ্ঞা_'ঈশ্বরকে সম্মান করো এবং মানুষকে নিজের মতো প্রেম করো।' যিশুখ্রিস্ট সেই আজ্ঞা সম্পূর্ণরূপে পালন করার মাধ্যমে প্রচার করেছেন। নিজের সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপ জীবন তিনি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন পাপী মানুষের আ@ি@@@ক ও সামগ্রিক মুক্তি ও কল্যাণের জন্য। সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই মানুষে-মানুষে হিংসা ও হানাহানি চলে আসছে। আজকে এর মাত্রা এবং তা চরিতার্থ করার কৌশলও বেড়েছে অনেক। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। মুসলিমদের কথায় 'আশরাফুল মাখলুকাত'। হিন্দুদের কথায় 'অমৃতের সন্তান'। খ্রিস্টীয় শিক্ষায় 'ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি, ঈশ্বরের সন্তান'। কিন্তু অতীতের সব সীমা ছাড়িয়ে লোভ, হিংসা ও অহংকারের কারণে এ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম বিকাশ ও উৎকর্ষের যুগে মানুষে-মানুষে বিভেদের প্রাচীর বড় হয়েই চলেছে। অশান্তি ও হিংসায় উন্মত্ত বর্তমান পৃথিবী। নিজ পুত্রকে দান করে ঈশ্বর আমাদের কাছে একটা আদর্শ রেখেছেন, যেন আমরাও অন্যের জন্য আমাদের নিজেদের দিতে পারি। বিশ্বজুড়ে সেবার ও পরিচর্যার অনেক কাজ আছে বটে, কিন্তু আসলে নিঃস্বার্থ সেবা কতটুকু? খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে নবী যিশাইয় মানুষের প্রতি ঈশ্বরের প্রেমের কথা এভাবে উল্লেখ করেছিলেন : 'তাহাদের সকল দুঃখে তিনি দুঃখিত হইলেন' (যিশাইয় ৬৩:৯)। মানুষের দুঃখ ও ব্যথায় ঈশ্বরও দুঃখিত হন। তিনি মানুষকে বুদ্ধি, জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে সব সৃষ্টির ওপর তাকে অধিকার দান করেছেন। কিন্তু লোভ, স্বেচ্ছাচারিতা ও অহংকারের কারণে মানুষ তার ঈশ্বরদত্ত এ অধিকার দায়িত্বহীনভাবে ব্যবহার করে চলেছে বলেই মানুষে-মানুষে এত অবিশ্বাস, হিংসা ও হানাহানি। বাইবেলের শিক্ষায় সেই প্রথম নরহত্যাটির পরই ঘাতক কইনকে ঈশ্বর শুধিয়েছিলেন, 'তোমার ভ্রাতা হেবল কোথায়? তোমার ভ্রাতার রক্ত ভূমি হইতে আমার কাছে ক্রন্দন করিতেছে' (আদিপুস্তক ৪ অধ্যায়)।
খ্রিস্ট জন্মে মানবজীবনের নতুন করে মূল্যায়ন হয়েছে। খ্রিস্টীয় বিশ্বাস এই, ঈশ্বর মানুষকে তার আদি ও আসল অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষ হয়ে জন্মেছিলেন। মানুষ তার পাপ স্বভাবের ওপর জয়লাভ করে নতুন মানুষ হতে পারে। এর জন্য চাই অন্যায় ও পাপকাজের জন্য অনুশোচনাসহ অন্তর ও মনের পরিবর্তন। খ্রিস্ট তাঁর কথা ও কাজে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পদমর্যাদাভেদে সব মানুষকে সমান চোখে দেখেছেন। পথের ভিখারি থেকে রাজপ্রাসাদের মানুষ পর্যন্ত তাঁর আশীর্বাদে গতানুগতিক জীবন থেকে নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছে। সব মানুষের মধ্যে তিনি দেখেছেন স্রষ্টার প্রতিমূর্তি ও সাদৃশ্য। যেখানেই মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়, সেখানেই সেই প্রতিমূর্তি হয় চূর্ণ-বিচূর্ণ। তা সে যে কারণেই হোক না কেন_ধর্মের নামে হোক, আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, গোত্রীয় বা যেকোনো কারণেই হোক। অন্যের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মহৎ চেতনা মানুষের এক অনন্য গুণ। যে রক্তপাত, হানাহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ আজকের পৃথিবীতে চলছে, বিবেকসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ তার জন্য দুঃখিত ও উৎকণ্ঠিত। কোটি কোটি মানুষ আজ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, আর্থসামাজিক, জাতি ও বর্ণগত বিভিন্নতার কারণে মানুষে-মানুষে কতই না দ্বন্দ্ব-বিভেদ! সাধারণ মানুষের জীবন আজ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পর্যবসিত। হিন্দুদের উৎসব ৪৪টি, মুসলমানদের ১৬টি, বৌদ্ধদের কাছে প্রতিটি পূর্ণিমায়ই একেকটি পার্বণ, খ্রিস্টানদের প্রধান উৎসব পাঁচটি। পৃথিবীতে রয়েছে আরো অনেক ধর্মমত। এত উৎসব ও ধর্মকর্ম সত্ত্বেও মানুষের শান্তি নেই। কোনো একজন বলেছেন,�We have enough faith to hate. But we do not have enough to love.� ' বলা বাহুল্য, কথাটি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি আক্ষেপের কথা। সব ধর্মেই কমবেশি নিঃস্বার্থ প্রেম, ন্যায্যতা ও শান্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মানুষের মনের পরিবর্তন যদি না হয়, তাহলে ধর্মের বুলিতে কোনো লাভ নেই। ধর্মের সূক্ষ্ম ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাসন ও শোষণের স্বার্থে। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা এই যে দুর্বলের ওপর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রয়োগ করেই সবল মানুষের বড় শান্তি ও তৃপ্তি। বিষয়টি প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সফোক্লিসের এই উক্তিতে ব্যক্ত হয়েছে :�Hard as it is to know the mind of mortal or the heart men, till he be tried in chief authority. Power shows the man.� ক্ষমতায় বসতে দিয়েই মানুষকে চেনা যায়। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মোহে যুগে যুগে মানুষ যে কত অমানবিক ও অন্যায় আচরণ করতে পারে, তার উদাহরণে ভরা মানবেতিহাস। মহাকবি মিল্টনের Paradise Lost কবিতায় শয়তানের এ কথায় ওই সত্য ব্যক্ত হয়েছে�It is better to reign in hell than to serve in heaven.� যে করেই হোক, যেভাবেই হোক_রাজত্ব করতেই তার আনন্দ!
প্রতিবছর বড়দিন ফিরে আসে আমাদের মধ্যে ঐশ-অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে, যেন আমরা মানুষের সেবা ও মঙ্গলের জন্য প্রেমের অবতার শান্তিরাজ খ্রিস্টের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে পারি। বড়দিনের আহ্বান সেই নতুনেরই আহ্বান। ডিসেম্বর মাস আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয়ের মাস। প্রায় ৯ মাস এ দেশে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা সীমাহীন অত্যাচার ও নিধনযজ্ঞ চালানো শেষে যখন মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর হাতে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের দিন এগিয়ে আসছিল, তখন বারবার তাদের ওপর মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে উর্দু ভাষায় এই নির্দেশটি প্রচার করা হয়েছিল, 'হাতিয়ার ডাল দো', অর্থাৎ 'অস্ত্র সমর্পণ করো।' অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর এল। ওই দিন তাদের সব মারণাস্ত্র সমর্পণ করে প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনা জীবনে বাঁচে। আমাদের কিছু মারাত্মক হাতিয়ার আছে। সেগুলো হচ্ছে হিংসা, অহংকার ও লোভ। ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনে শান্তি এবং সামগ্রিক কুশলের জন্য আমাদের ওই সব হাতিয়ার ত্যাগ করে প্রেম ও ন্যায়ের আদর্শে এগিয়ে যেতে হবে। আজ প্রেম ও পবিত্রতার বিষয়ে খ্রিস্টের কালজয়ী শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করুক, হোক আমাদের নতুন হৃদয় ও মন।
লেখক : ধর্ম গবেষক
খ্রিস্ট জন্মে মানবজীবনের নতুন করে মূল্যায়ন হয়েছে। খ্রিস্টীয় বিশ্বাস এই, ঈশ্বর মানুষকে তার আদি ও আসল অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষ হয়ে জন্মেছিলেন। মানুষ তার পাপ স্বভাবের ওপর জয়লাভ করে নতুন মানুষ হতে পারে। এর জন্য চাই অন্যায় ও পাপকাজের জন্য অনুশোচনাসহ অন্তর ও মনের পরিবর্তন। খ্রিস্ট তাঁর কথা ও কাজে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পদমর্যাদাভেদে সব মানুষকে সমান চোখে দেখেছেন। পথের ভিখারি থেকে রাজপ্রাসাদের মানুষ পর্যন্ত তাঁর আশীর্বাদে গতানুগতিক জীবন থেকে নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছে। সব মানুষের মধ্যে তিনি দেখেছেন স্রষ্টার প্রতিমূর্তি ও সাদৃশ্য। যেখানেই মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়, সেখানেই সেই প্রতিমূর্তি হয় চূর্ণ-বিচূর্ণ। তা সে যে কারণেই হোক না কেন_ধর্মের নামে হোক, আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, গোত্রীয় বা যেকোনো কারণেই হোক। অন্যের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মহৎ চেতনা মানুষের এক অনন্য গুণ। যে রক্তপাত, হানাহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ আজকের পৃথিবীতে চলছে, বিবেকসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ তার জন্য দুঃখিত ও উৎকণ্ঠিত। কোটি কোটি মানুষ আজ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, আর্থসামাজিক, জাতি ও বর্ণগত বিভিন্নতার কারণে মানুষে-মানুষে কতই না দ্বন্দ্ব-বিভেদ! সাধারণ মানুষের জীবন আজ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পর্যবসিত। হিন্দুদের উৎসব ৪৪টি, মুসলমানদের ১৬টি, বৌদ্ধদের কাছে প্রতিটি পূর্ণিমায়ই একেকটি পার্বণ, খ্রিস্টানদের প্রধান উৎসব পাঁচটি। পৃথিবীতে রয়েছে আরো অনেক ধর্মমত। এত উৎসব ও ধর্মকর্ম সত্ত্বেও মানুষের শান্তি নেই। কোনো একজন বলেছেন,�We have enough faith to hate. But we do not have enough to love.� ' বলা বাহুল্য, কথাটি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি আক্ষেপের কথা। সব ধর্মেই কমবেশি নিঃস্বার্থ প্রেম, ন্যায্যতা ও শান্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মানুষের মনের পরিবর্তন যদি না হয়, তাহলে ধর্মের বুলিতে কোনো লাভ নেই। ধর্মের সূক্ষ্ম ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাসন ও শোষণের স্বার্থে। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা এই যে দুর্বলের ওপর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রয়োগ করেই সবল মানুষের বড় শান্তি ও তৃপ্তি। বিষয়টি প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সফোক্লিসের এই উক্তিতে ব্যক্ত হয়েছে :�Hard as it is to know the mind of mortal or the heart men, till he be tried in chief authority. Power shows the man.� ক্ষমতায় বসতে দিয়েই মানুষকে চেনা যায়। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মোহে যুগে যুগে মানুষ যে কত অমানবিক ও অন্যায় আচরণ করতে পারে, তার উদাহরণে ভরা মানবেতিহাস। মহাকবি মিল্টনের Paradise Lost কবিতায় শয়তানের এ কথায় ওই সত্য ব্যক্ত হয়েছে�It is better to reign in hell than to serve in heaven.� যে করেই হোক, যেভাবেই হোক_রাজত্ব করতেই তার আনন্দ!
প্রতিবছর বড়দিন ফিরে আসে আমাদের মধ্যে ঐশ-অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে, যেন আমরা মানুষের সেবা ও মঙ্গলের জন্য প্রেমের অবতার শান্তিরাজ খ্রিস্টের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে পারি। বড়দিনের আহ্বান সেই নতুনেরই আহ্বান। ডিসেম্বর মাস আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয়ের মাস। প্রায় ৯ মাস এ দেশে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা সীমাহীন অত্যাচার ও নিধনযজ্ঞ চালানো শেষে যখন মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর হাতে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের দিন এগিয়ে আসছিল, তখন বারবার তাদের ওপর মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে উর্দু ভাষায় এই নির্দেশটি প্রচার করা হয়েছিল, 'হাতিয়ার ডাল দো', অর্থাৎ 'অস্ত্র সমর্পণ করো।' অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর এল। ওই দিন তাদের সব মারণাস্ত্র সমর্পণ করে প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনা জীবনে বাঁচে। আমাদের কিছু মারাত্মক হাতিয়ার আছে। সেগুলো হচ্ছে হিংসা, অহংকার ও লোভ। ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনে শান্তি এবং সামগ্রিক কুশলের জন্য আমাদের ওই সব হাতিয়ার ত্যাগ করে প্রেম ও ন্যায়ের আদর্শে এগিয়ে যেতে হবে। আজ প্রেম ও পবিত্রতার বিষয়ে খ্রিস্টের কালজয়ী শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করুক, হোক আমাদের নতুন হৃদয় ও মন।
লেখক : ধর্ম গবেষক
No comments