আবদুর রাজ্জাক স্মরণে-বর্ণাঢ্য জীবনের মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ by হারুন হাবীব
চিরতরে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক আবদুর রাজ্জাক। এভাবেই চলে যাচ্ছেন সেই সব মানুষ, যাঁরা এই বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে তাঁদের জীবনের সবটুকু নিবেদন করেছিলেন। দীর্ঘদিন রোগে ভুগেছেন তিনি। মাঝেমধ্যে এর-ওর কাছে খবর পেয়েছি তাঁর অসুস্থতার। ভেবেছি, নিশ্চয়ই সেরে উঠবেন, আবারও সচল হবেন। কিন্তু আর হলেন না। রোগটি যে রাজ্জাক ভাইকে চিরদিনের মতো এভাবে গ্রাস করবে_পৃথিবী থেকেও তুলে নেবে_এমনটা
কখনোই আমার মনে হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা বড় নির্মম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য এবং একান্ত অনুগত আবদুর রাজ্জাক বয়সে আমাদের বেশ বড়। আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, রাজ্জাক ভাই তখন ছাত্রত্ব পেরিয়ে আওয়ামী লীগের তরুণ তুর্কি, যাঁরা একাত্তরের পটভূমি তৈরিতে দলের হয়ে রাতদিন কাজ করে যাচ্ছিলেন। গোটা পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র-জনতার যে অবিস্মরণীয় জাগরণ ঘটেছিল ষাটের দশকের শুরু থেকে, সেই অবিস্মরণীয় গণজাগরণের অন্যতম নিষ্ঠাবান নেতা ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক হিসেবে তাঁকে দেখেছি মুজিব বাহিনীর অন্যতম পুরোধা হিসেবে। নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সূচিত আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক এবং গণ-আদালতের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর ভূমিকা চিরস্মরণীয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে দলকে তিনি নতুন জীবন দান করেছিলেন। পরে 'বাকশাল' নামে আলাদা দল নিয়ে বেশ কয়েক বছর পথ চলেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন নয়। বাকশাল আওয়ামী লীগে একীভূত হয়ে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে। এরপর চলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, যার পুরোভাগে থাকেন জননেতা আবদুর রাজ্জাক। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারে পানিসম্পদমন্ত্রী হন তিনি। ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর তাঁর জীবনের একটি বড় অধ্যায়। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর আওয়ামী লীগের যে কয়জন নেতা 'সংস্কারপন্থী' হিসেবে পরিচিতি পান, আবদুর রাজ্জাক ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এরপর ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলেও মন্ত্রিসভায় স্থান হয়নি তাঁর। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আমাদের ছাত্রাবস্থা থেকেই জেনেছি, অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর এই বিরল ক্ষমতা একদিকে যেমন তাঁকে অনন্য যোগ্যতার অধিকারী করেছিল, তেমনি অন্যদিকে দলকে উপহার দিয়েছিল বিরল শক্তি। কাজেই তাঁর মৃত্যুসংবাদে শোকের ছায়া নেমে আসবে_এটাই তো স্বাভাবিক।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে মূলত আবদুর রাজ্জাককে আর সক্রিয় দেখা যায়নি। তাঁকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বানানো হয়। মনে পড়ে, তাঁরই নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সংসদীয় প্রতিনিধিদল ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প পরিদর্শন করে। এর পর থেকে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান তিনি। অসুস্থতাও হয়তো তাঁর সচল জীবনে বাদ সাধে। যে আবদুর রাজ্জাককে সারা জীবন ব্যস্ত-কর্মচঞ্চল দেখা গেছে, সেই আবদুর রাজ্জাক রাজনীতির দৃশ্যমান মঞ্চ থেকে অনেকটাই হারিয়ে যান। তিন মাস ধরে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মূলত তখনই জানা গেল, তাঁর রোগটি বড় রকমের। শুনেছি, কিংস কলেজ হাসপাতালে তিন দিন ধরে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাঁকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী এমন একটি রাজনৈতিক সংগঠন, যার অসীম সাফল্য পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ তৈরিতে। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক বা তার পরের প্রজন্মের নেতা, যাঁরা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখেন, তাঁদের প্রায় সবাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। পঁচাত্তরের রক্তপাতে গেছেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। এরপর গেছেন আবদুল মালেক উকিলসহ আরো কয়েকজন। এবার গেলেন আবদুর রাজ্জাক। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুম তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রাখা সংগ্রামী নেতা আবদুর রাজ্জাক নেতৃত্ব দিয়েছেন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন এবং স্বাধীনতার পর সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে। ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধপূর্ব গণসংগ্রামে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয় সৈনিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক ছিলেন মুজিব বাহিনীর অন্যতম রূপকার এবং মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে আজীবন লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন অনন্যসাধারণ এই নেতা। রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে এ কারণেই এই রাজনীতিবিদকে আমার শ্রদ্ধা। ১৯৬০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন তিনি। ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পর পর দুইবার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আবদুর রাজ্জাক ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন বাকশালের সম্পাদক। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বড় দুর্দিনে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে বাকশাল গঠন করেন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাকশালের সাধারণ সম্পাদক থাকেন। ১৯৯১ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সক্রিয় নেতা আবদুর রাজ্জাক নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গোলাম আযমসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর বিচারে সৃষ্ট গণ-আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ে রাজপথের লড়াকু এই সৈনিককে বহুবার কারাগারে যেতে হয়েছে। আইয়ুব শাসনামলে ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। এরপর ছয় দফা আন্দোলনের জন্য ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারারুদ্ধ ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দি ছিলেন। এরশাদের শাসনামলে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জন্য ১৯৮৭ সালে আবারও গ্রেপ্তার হন।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আবদুর রাজ্জাক মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ, যাঁকে মনে রাখতে হবে। ষাটের দশকের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র আবদুর রাজ্জাক নিজেকে কখনো নেতা ভাবতেন না, দাবি করতেন একজন কর্মী হিসেবে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর কাছ থেকে তিনি অনেক লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। জানাশোনা থাকলেও খুব একটা যোগাযোগ ছিল না আমার সঙ্গে। তবে জানতাম, তিনি অতি সাধারণ এবং অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সন্তান, ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্র সংগঠক এবং মুজিব বাহিনী ও বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের অন্যতম পুরোধা এই বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব মনেপ্রাণে কর্মী অন্তঃপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। শুধু ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগেই বিপুল সমাদৃত ছিলেন না তিনি, ছিলেন অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং প্রতিপক্ষের কাছেও সজ্জন ও শ্রদ্ধেয়। একজন রাজনীতিবিদের জন্য এই পাওনা কম নয়। জীবিতাবস্থায় কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া এই মানুষটি তৃণমূল থেকে উঠে এসে হয়েছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। হয়েছেন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী। সব অবস্থানেই তাঁর দ্বার ছিল কর্মীদের জন্য অবারিত। তিনি ছিলেন বিনয়ী সব দল ও মতের অনুসারীদের কাছে। কিন্তু অনেকটাই নিভৃতে, প্রায় সবার অগোচরে চলে যেতে হলো আবদুর রাজ্জাককে। যতটা জেনেছি, চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত টাকাও জোগাড় করতে পারেনি তাঁর পরিবার। এই লজ্জা কার? শুধু এটুকু জানি, জাতি হিসেবে আমরা আবদুর রাজ্জাকের মতো একজন নেতাকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে দলকে তিনি নতুন জীবন দান করেছিলেন। পরে 'বাকশাল' নামে আলাদা দল নিয়ে বেশ কয়েক বছর পথ চলেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন নয়। বাকশাল আওয়ামী লীগে একীভূত হয়ে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে। এরপর চলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, যার পুরোভাগে থাকেন জননেতা আবদুর রাজ্জাক। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারে পানিসম্পদমন্ত্রী হন তিনি। ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর তাঁর জীবনের একটি বড় অধ্যায়। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর আওয়ামী লীগের যে কয়জন নেতা 'সংস্কারপন্থী' হিসেবে পরিচিতি পান, আবদুর রাজ্জাক ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এরপর ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলেও মন্ত্রিসভায় স্থান হয়নি তাঁর। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আমাদের ছাত্রাবস্থা থেকেই জেনেছি, অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর এই বিরল ক্ষমতা একদিকে যেমন তাঁকে অনন্য যোগ্যতার অধিকারী করেছিল, তেমনি অন্যদিকে দলকে উপহার দিয়েছিল বিরল শক্তি। কাজেই তাঁর মৃত্যুসংবাদে শোকের ছায়া নেমে আসবে_এটাই তো স্বাভাবিক।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে মূলত আবদুর রাজ্জাককে আর সক্রিয় দেখা যায়নি। তাঁকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বানানো হয়। মনে পড়ে, তাঁরই নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সংসদীয় প্রতিনিধিদল ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প পরিদর্শন করে। এর পর থেকে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান তিনি। অসুস্থতাও হয়তো তাঁর সচল জীবনে বাদ সাধে। যে আবদুর রাজ্জাককে সারা জীবন ব্যস্ত-কর্মচঞ্চল দেখা গেছে, সেই আবদুর রাজ্জাক রাজনীতির দৃশ্যমান মঞ্চ থেকে অনেকটাই হারিয়ে যান। তিন মাস ধরে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মূলত তখনই জানা গেল, তাঁর রোগটি বড় রকমের। শুনেছি, কিংস কলেজ হাসপাতালে তিন দিন ধরে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাঁকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী এমন একটি রাজনৈতিক সংগঠন, যার অসীম সাফল্য পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ তৈরিতে। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক বা তার পরের প্রজন্মের নেতা, যাঁরা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখেন, তাঁদের প্রায় সবাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। পঁচাত্তরের রক্তপাতে গেছেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। এরপর গেছেন আবদুল মালেক উকিলসহ আরো কয়েকজন। এবার গেলেন আবদুর রাজ্জাক। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুম তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রাখা সংগ্রামী নেতা আবদুর রাজ্জাক নেতৃত্ব দিয়েছেন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন এবং স্বাধীনতার পর সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে। ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধপূর্ব গণসংগ্রামে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয় সৈনিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক ছিলেন মুজিব বাহিনীর অন্যতম রূপকার এবং মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে আজীবন লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন অনন্যসাধারণ এই নেতা। রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে এ কারণেই এই রাজনীতিবিদকে আমার শ্রদ্ধা। ১৯৬০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন তিনি। ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পর পর দুইবার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আবদুর রাজ্জাক ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন বাকশালের সম্পাদক। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বড় দুর্দিনে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে বাকশাল গঠন করেন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাকশালের সাধারণ সম্পাদক থাকেন। ১৯৯১ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সক্রিয় নেতা আবদুর রাজ্জাক নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গোলাম আযমসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর বিচারে সৃষ্ট গণ-আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ে রাজপথের লড়াকু এই সৈনিককে বহুবার কারাগারে যেতে হয়েছে। আইয়ুব শাসনামলে ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। এরপর ছয় দফা আন্দোলনের জন্য ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারারুদ্ধ ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দি ছিলেন। এরশাদের শাসনামলে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জন্য ১৯৮৭ সালে আবারও গ্রেপ্তার হন।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আবদুর রাজ্জাক মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ, যাঁকে মনে রাখতে হবে। ষাটের দশকের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র আবদুর রাজ্জাক নিজেকে কখনো নেতা ভাবতেন না, দাবি করতেন একজন কর্মী হিসেবে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর কাছ থেকে তিনি অনেক লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। জানাশোনা থাকলেও খুব একটা যোগাযোগ ছিল না আমার সঙ্গে। তবে জানতাম, তিনি অতি সাধারণ এবং অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সন্তান, ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্র সংগঠক এবং মুজিব বাহিনী ও বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের অন্যতম পুরোধা এই বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব মনেপ্রাণে কর্মী অন্তঃপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। শুধু ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগেই বিপুল সমাদৃত ছিলেন না তিনি, ছিলেন অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং প্রতিপক্ষের কাছেও সজ্জন ও শ্রদ্ধেয়। একজন রাজনীতিবিদের জন্য এই পাওনা কম নয়। জীবিতাবস্থায় কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া এই মানুষটি তৃণমূল থেকে উঠে এসে হয়েছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। হয়েছেন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী। সব অবস্থানেই তাঁর দ্বার ছিল কর্মীদের জন্য অবারিত। তিনি ছিলেন বিনয়ী সব দল ও মতের অনুসারীদের কাছে। কিন্তু অনেকটাই নিভৃতে, প্রায় সবার অগোচরে চলে যেতে হলো আবদুর রাজ্জাককে। যতটা জেনেছি, চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত টাকাও জোগাড় করতে পারেনি তাঁর পরিবার। এই লজ্জা কার? শুধু এটুকু জানি, জাতি হিসেবে আমরা আবদুর রাজ্জাকের মতো একজন নেতাকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
No comments