এ বিজয় সহজ বিজয় নয় by কাজী সিরাজ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দখলমুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর। এদিন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জে. অরোরার কাছে। তিনি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীরও অধিনায়ক ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি আরো সুন্দর ও আনন্দময় হতো, যদি তাতে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল
ওসমানী উপস্থিত থাকতেন। এ কথা সত্যি বটে, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়েছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্য যে ৯ মাসের সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয়। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বেশ প্রলম্বিত ও দীর্ঘ। পরাধীনতার শেকল ভেঙে অশ্রু-রক্ত আর জীবনের দামে যাঁরা স্বাধীনতা কিনেছেন, তাঁদের সবার ইতিহাসই অভিন্ন। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে প্রায় ২০০ বছরের শাসক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিদায় এবং পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতার বিষয় আপস আলোচনা ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে নিষ্পন্ন হলেও এর জন্যও অনেক কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়েছে, অনেক নিগ্রহ ভোগ করতে হয়েছে উপমহাদেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষকে। মুক্তির সোপানে পেঁৗছতে কত প্রাণ বলিদান হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় এখনো ইতিহাসের বিবেচনার অপেক্ষায়।
দুই. ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রায় দেড় হাজার মাইল ব্যবধানে দুটি অঞ্চল নিয়ে অসম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মের পর পরই স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে পূর্ব ও পশ্চিম। দুই অঞ্চল নিয়ে এক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান অবজ্ঞা ও বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। দুই অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর অন্য কোনো বিষয়ে মিল ছিল না। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া দুর্বল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত দুই অংশের শিথিল বন্ধনের এমন একটি রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে কি না, সে বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা সন্দিহান ছিলেন। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ হ্যান্স জে. মর্গেনথু এ প্রসঙ্গে বলেছেন, 'বাইরে থেকে শক্তিশালী মনে হলেও এর ভেতরে রয়েছে কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধি। পাকিস্তান একটি জাতি নয়, বড়জোর একটি রাষ্ট্র। এর অধিবাসীদের জাতিগত উদ্ভব, ভাষা, সভ্যতা কিংবা মানসিকতা_কোনো দিক থেকেই এক জাতি গঠনের ঐতিহাসিক কোনো যুক্তি নেই। একমাত্র হিন্দুদের আধিপত্যের ভয় ছাড়া ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দুটি জাতির এ ধরনের একটি রাষ্ট্র গঠনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।...
লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেন, 'পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। কাজেই মুসলিম জাতির উপযুক্ত রাষ্ট্রভাষাই নির্ধারণ করতে হবে। একটি জাতির জন্য একটি রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজন এবং সেই ভাষা হবে একমাত্র উর্দু_অন্য কোনো ভাষা নয়।' (গ্যাস্কোভস্কি, এ হিস্টরি অব পাকিস্তান-১৯৪৭)। ১৯৪৮ সালের মার্চে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও ঢাকায় ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বলেন, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।' ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রক্তপাতের মধ্য দিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে পাকিস্তান গণপরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয় এবং ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে তা সনি্নবেশিত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন, '৫৮ সালে সংবিধান বাতিল এবং ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি ও গণতন্ত্রের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মরণপণ লড়াইয়ের স্তর পরিবর্তন, ছয় দফা আন্দোলন, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন ও '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।
তিন.
১৯৫৮ সাল থেকে দীর্ঘ ১০ বছর একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালালেও ১৯৬২ সাল থেকেই পূর্ব বাংলায় শরিফ কমিশন শিক্ষা রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলন সাহসী রূপ নিতে থাকে। ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবকে কেন্দ্র করে ঘটে প্রচণ্ড ছাত্র বিস্ফোরণ। পদাধিকারবলে গভর্নর মোনায়েম খান চ্যান্সেলর হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সার্টিফিকেট বিতরণ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু ছাত্রসমাজ তা রুখে দেয়। ছাত্র আন্দোলনে সঞ্চার হয় তীব্র গতিবেগ। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা পূর্ব বাংলায়। ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে পূর্ব বাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। পূর্ব বাংলায় বিপুলভাবে জনসমর্থিত হয় ছয় দফা। ক্রোধে উন্মত্ত আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন। এর প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ। সেদিন কমপক্ষে ১০ জন নিহত হন ও আহত হন অনেকে। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে রুজু করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।' বিচারের জন্য গঠিত হয় বিশেষ ট্রাইবু্যুনাল। উত্তাল হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। অন্যদিকে ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সম্মেলনে (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন) পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। কাগমারী সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেছিলেন, "পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে, সামরিক, বেসামরিক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সংখ্যাসাম্যনীতি পালিত না হইলে পূর্ব পাকিস্তান 'আসসালামু আলাইকুম' জানাইবে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে।" (জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে '৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা ২২৭)। সেই মওলানা আবার গর্জে ওঠেন '৬৮-তে, '৬৯-এ। শেখ মুজিব বন্দি, মওলানা মুক্ত। ভাসানীর নেতৃতে গড়ে ওঠে তীব্র আন্দোলন। ১১ দফাকে কেন্দ্র করে সর্বদলীয় ছাত্র আন্দোলনও তুঙ্গে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। মুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন নতুন ও চূড়ান্ত লক্ষ্যপথে ধাবিত হতে থাকে অতিদ্রুত। এই নিরাপত্তাহীনতা বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে নতুন চিন্তার উন্মেষকে আরো শাণিত করে। ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানের কেন্দ্রে ক্ষমতার পালাবদল হয়। আইয়ুব খান শাসনক্ষমতা তুলে দেন সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে। এরপর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনী ফলাফল জান্তাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের জন্য বিরাট বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। নানা টালবাহানার পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত, অপ্রস্তুত ও অসংগঠিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর। শুরু হয় প্রতিরোধ। ঘোষিত হয় স্বাধীনতা। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে ইথারে ভেসে আষে এক দৃঢ় সাহসী কণ্ঠ- আমি মেজর জিয়া বলছি...। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার যুদ্ধ।
চার. ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত লড়াইয়ের বিভিন্ন স্তরে এ দেশের অগণিত মানুষের রক্তে সিক্ত হয়েছে বাংলাদেশের মাটি। সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের পক্ষে যে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে, তাতে প্রতিফলিত হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসন ও শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তানের এককেন্দ্রিক বিজাতীয় শাসক-শোষকগোষ্ঠীর সঙ্গে সমগ্র বাঙালি জাতির দ্বন্দ্ব মীমাংসার অযোগ্য স্তরে পেঁৗছে যায়। ফয়সালার একমাত্র পথ খোলা থাকে যুদ্ধ ও স্বাধীনতা। বাংলাদেশের সমগ্র জনতা সেই পথেই গেল নির্ভয়ে, জীবন বাজি রেখে। পাকিস্তানি অবাঙালি শাসক-শোষক ও তাদের স্বার্থের পাহারাদাররাও পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিল এবং ২৩ বছর যা করেছে, ঠিক তেমন অবিবেচকের মতোই আচরণ করল। অস্ত্রশক্তি প্রয়োগ করে একটি দুর্দমনীয় জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করতে চাইল। আলোচনার নামে তারা সময়ক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুল অস্ত্রসম্ভার ও সৈন্যসামন্ত এনে শক্তি বৃদ্ধি করল। তাদের প্রতারণার ফাঁদ অনেকেই বুঝল, কিন্তু তা বুঝতে বা উপলব্ধি করতে নেতৃত্বের বিলম্বের সুযোগটা ষোলআনা কাজে লাগালো পাকিস্তানিরা। তাদের আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে হিংস্র হায়েনার মতো শান্তিপ্রিয়, নিরীহ ও ঘুমন্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দখলদার বাহিনী। গড়ে ওঠে প্রতিরোধের যুদ্ধ, মরণপণ স্বাধীনতার যুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রতিবেশী ভারত ছিল আমাদের নির্ভরযোগ্য মিত্র। তারা শুধু আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়ই দেয়নি, ক্ষুধার অন্ন আর চিকিৎসাসেবারও ব্যবস্থা করেছে। তার চেয়েও বড় বিষয়, আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যৌথ কমান্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার জওয়ান ও অফিসারও প্রাণ দিয়েছেন। দলমত-নির্বিশেষে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ১৬ ডিসেম্বর। পরিপূর্ণ বিজয় অর্জিত হয় ২৬ মার্চ শুরু হওয়া স্বাধীনতাযুদ্ধের। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, অসংখ্য মা-বোনের লুণ্ঠিত সম্ভ্রম এবং লাখো বিরান ভূমির বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা, আমাদের এ বিজয়। এটা কারো দয়ার দান নয়, আমাদের অর্জন। এর সঙ্গে আছে দীর্ঘ ২৩ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনে অগণিত শহীদের রক্ত। সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তধারায় অর্জিত বিজয় ও স্বাধীনতা আমাদের পবিত্র আমানত এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার। মহান বিজয়ের স্মৃতি চির অম্লান।
লেখক : সাংবাদিক
দুই. ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রায় দেড় হাজার মাইল ব্যবধানে দুটি অঞ্চল নিয়ে অসম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মের পর পরই স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে পূর্ব ও পশ্চিম। দুই অঞ্চল নিয়ে এক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান অবজ্ঞা ও বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। দুই অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর অন্য কোনো বিষয়ে মিল ছিল না। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া দুর্বল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত দুই অংশের শিথিল বন্ধনের এমন একটি রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে কি না, সে বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা সন্দিহান ছিলেন। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ হ্যান্স জে. মর্গেনথু এ প্রসঙ্গে বলেছেন, 'বাইরে থেকে শক্তিশালী মনে হলেও এর ভেতরে রয়েছে কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধি। পাকিস্তান একটি জাতি নয়, বড়জোর একটি রাষ্ট্র। এর অধিবাসীদের জাতিগত উদ্ভব, ভাষা, সভ্যতা কিংবা মানসিকতা_কোনো দিক থেকেই এক জাতি গঠনের ঐতিহাসিক কোনো যুক্তি নেই। একমাত্র হিন্দুদের আধিপত্যের ভয় ছাড়া ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দুটি জাতির এ ধরনের একটি রাষ্ট্র গঠনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।...
লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেন, 'পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। কাজেই মুসলিম জাতির উপযুক্ত রাষ্ট্রভাষাই নির্ধারণ করতে হবে। একটি জাতির জন্য একটি রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজন এবং সেই ভাষা হবে একমাত্র উর্দু_অন্য কোনো ভাষা নয়।' (গ্যাস্কোভস্কি, এ হিস্টরি অব পাকিস্তান-১৯৪৭)। ১৯৪৮ সালের মার্চে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও ঢাকায় ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বলেন, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।' ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রক্তপাতের মধ্য দিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে পাকিস্তান গণপরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয় এবং ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে তা সনি্নবেশিত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন, '৫৮ সালে সংবিধান বাতিল এবং ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি ও গণতন্ত্রের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মরণপণ লড়াইয়ের স্তর পরিবর্তন, ছয় দফা আন্দোলন, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন ও '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।
তিন.
১৯৫৮ সাল থেকে দীর্ঘ ১০ বছর একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালালেও ১৯৬২ সাল থেকেই পূর্ব বাংলায় শরিফ কমিশন শিক্ষা রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলন সাহসী রূপ নিতে থাকে। ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবকে কেন্দ্র করে ঘটে প্রচণ্ড ছাত্র বিস্ফোরণ। পদাধিকারবলে গভর্নর মোনায়েম খান চ্যান্সেলর হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সার্টিফিকেট বিতরণ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু ছাত্রসমাজ তা রুখে দেয়। ছাত্র আন্দোলনে সঞ্চার হয় তীব্র গতিবেগ। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা পূর্ব বাংলায়। ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে পূর্ব বাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। পূর্ব বাংলায় বিপুলভাবে জনসমর্থিত হয় ছয় দফা। ক্রোধে উন্মত্ত আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন। এর প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ। সেদিন কমপক্ষে ১০ জন নিহত হন ও আহত হন অনেকে। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে রুজু করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।' বিচারের জন্য গঠিত হয় বিশেষ ট্রাইবু্যুনাল। উত্তাল হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। অন্যদিকে ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সম্মেলনে (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন) পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। কাগমারী সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেছিলেন, "পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে, সামরিক, বেসামরিক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সংখ্যাসাম্যনীতি পালিত না হইলে পূর্ব পাকিস্তান 'আসসালামু আলাইকুম' জানাইবে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে।" (জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে '৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা ২২৭)। সেই মওলানা আবার গর্জে ওঠেন '৬৮-তে, '৬৯-এ। শেখ মুজিব বন্দি, মওলানা মুক্ত। ভাসানীর নেতৃতে গড়ে ওঠে তীব্র আন্দোলন। ১১ দফাকে কেন্দ্র করে সর্বদলীয় ছাত্র আন্দোলনও তুঙ্গে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। মুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন নতুন ও চূড়ান্ত লক্ষ্যপথে ধাবিত হতে থাকে অতিদ্রুত। এই নিরাপত্তাহীনতা বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে নতুন চিন্তার উন্মেষকে আরো শাণিত করে। ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানের কেন্দ্রে ক্ষমতার পালাবদল হয়। আইয়ুব খান শাসনক্ষমতা তুলে দেন সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে। এরপর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনী ফলাফল জান্তাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের জন্য বিরাট বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। নানা টালবাহানার পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত, অপ্রস্তুত ও অসংগঠিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর। শুরু হয় প্রতিরোধ। ঘোষিত হয় স্বাধীনতা। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে ইথারে ভেসে আষে এক দৃঢ় সাহসী কণ্ঠ- আমি মেজর জিয়া বলছি...। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার যুদ্ধ।
চার. ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত লড়াইয়ের বিভিন্ন স্তরে এ দেশের অগণিত মানুষের রক্তে সিক্ত হয়েছে বাংলাদেশের মাটি। সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের পক্ষে যে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে, তাতে প্রতিফলিত হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসন ও শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তানের এককেন্দ্রিক বিজাতীয় শাসক-শোষকগোষ্ঠীর সঙ্গে সমগ্র বাঙালি জাতির দ্বন্দ্ব মীমাংসার অযোগ্য স্তরে পেঁৗছে যায়। ফয়সালার একমাত্র পথ খোলা থাকে যুদ্ধ ও স্বাধীনতা। বাংলাদেশের সমগ্র জনতা সেই পথেই গেল নির্ভয়ে, জীবন বাজি রেখে। পাকিস্তানি অবাঙালি শাসক-শোষক ও তাদের স্বার্থের পাহারাদাররাও পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিল এবং ২৩ বছর যা করেছে, ঠিক তেমন অবিবেচকের মতোই আচরণ করল। অস্ত্রশক্তি প্রয়োগ করে একটি দুর্দমনীয় জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করতে চাইল। আলোচনার নামে তারা সময়ক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুল অস্ত্রসম্ভার ও সৈন্যসামন্ত এনে শক্তি বৃদ্ধি করল। তাদের প্রতারণার ফাঁদ অনেকেই বুঝল, কিন্তু তা বুঝতে বা উপলব্ধি করতে নেতৃত্বের বিলম্বের সুযোগটা ষোলআনা কাজে লাগালো পাকিস্তানিরা। তাদের আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে হিংস্র হায়েনার মতো শান্তিপ্রিয়, নিরীহ ও ঘুমন্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দখলদার বাহিনী। গড়ে ওঠে প্রতিরোধের যুদ্ধ, মরণপণ স্বাধীনতার যুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রতিবেশী ভারত ছিল আমাদের নির্ভরযোগ্য মিত্র। তারা শুধু আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়ই দেয়নি, ক্ষুধার অন্ন আর চিকিৎসাসেবারও ব্যবস্থা করেছে। তার চেয়েও বড় বিষয়, আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যৌথ কমান্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার জওয়ান ও অফিসারও প্রাণ দিয়েছেন। দলমত-নির্বিশেষে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ১৬ ডিসেম্বর। পরিপূর্ণ বিজয় অর্জিত হয় ২৬ মার্চ শুরু হওয়া স্বাধীনতাযুদ্ধের। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, অসংখ্য মা-বোনের লুণ্ঠিত সম্ভ্রম এবং লাখো বিরান ভূমির বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা, আমাদের এ বিজয়। এটা কারো দয়ার দান নয়, আমাদের অর্জন। এর সঙ্গে আছে দীর্ঘ ২৩ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনে অগণিত শহীদের রক্ত। সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তধারায় অর্জিত বিজয় ও স্বাধীনতা আমাদের পবিত্র আমানত এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার। মহান বিজয়ের স্মৃতি চির অম্লান।
লেখক : সাংবাদিক
No comments