বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম by আবুল হাসনাত

কোনো কারণ ছাড়াই বেড়েছে খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক সপ্তাহে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১০ থেকে ১৩ টাকা।রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে এক সপ্তাহ আগে খোলা সয়াবিন তেলের লিটারপ্রতি দাম ছিল ১১০ থেকে ১১২ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১২৩ থেকে ১২৬ টাকায়। বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি পাঁচ থেকে আট টাকা।


মহল্লার দোকানে দাম নেওয়া হচ্ছে আরও বেশি। সয়াবিন তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই। পরিবেশক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় এবং মিলগেটে দাম বেশি হওয়ায় দাম বেড়েছে। তবে ট্যারিফ কমিশনের সূত্র জানায়, গত নভেম্বরে যে পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে তাতে সংকট হওয়ার কারণ নেই।
জানা গেছে, এ অবস্থায় বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদের কাল মঙ্গলবার ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
চলতি বছরের ২০ জুলাই সরকার পরিবেশকদের জন্য প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল মিলগেটে ১০৫, খুচরা পর্যায়ে ১০৭ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ১০৯ টাকা দর নির্ধারণ করে। তবে চাহিদা কম থাকায় তখন মিলগেটে এর চেয়ে কম দামে অর্থাৎ ৯৯ টাকায় সয়াবিন তেল বিক্রি করেন মিলমালিকেরা। কিন্তু নভেম্বরের মাঝামাঝি খোলা সয়াবিনের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। দুই দফায় লিটারপ্রতি খোলা সয়াবিন আট টাকা ও বোতলজাত তেল দুই টাকা বৃদ্ধি পায়। তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ খুঁজে বের করার নির্দেশ দিলে দাম কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা কমে। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে আবার দাম বাড়তে থাকে।
দেশের বাজারে বাড়লেও আন্তর্জাতিক বাজারে কমছে সয়াবিন তেলের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে ১৮ জুন টনপ্রতি সয়াবিন তেলের দাম ছিল এক হাজার ২৩২ মার্কিন ডলার। প্রতি টনের দাম ১৮ জুলাই এক হাজার ২৬৪, ১৮ আগস্ট এক হাজার ২২১, ১৮ সেপ্টেম্বর এক হাজার ২৪৬, ১৮ অক্টোবর এক হাজার ১৬১, ১৫ নভেম্বর এক হাজার ১৬৯ ডলার ছিল। বর্তমানে প্রতি টনের দাম এক হাজার ১৬০ ডলার। শিকাগো মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জ (সিএমই) গ্রুপ ও ইনডেক্স মুন্ডির ওয়েবসাইটে এ দর পাওয়া গেছে।
কিন্তু গতকাল রোববার ঢাকার পাইকারি বাজার মৌলভীবাজারে প্রতি মণ খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে পাঁচ হাজার টাকায়। লিটারপ্রতি ১২২ টাকা ৫০ পয়সা। এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে খোলা সয়াবিনের দাম মণপ্রতি ৬০০ টাকা বেড়েছে। মৌলভীবাজারের একজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, বড় মিলগুলো চাহিদার চেয়ে কম সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে। দু-একটি মিল তেলই দিচ্ছে না। এ কারণে দাম বেড়েছে।
পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিলগুলো থেকে চাহিদার মাত্র ৩০ শতাংশ সয়াবিন তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা টাকা নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু তেল পাচ্ছেন না।’ তিনি জানান, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না পেয়ে তিনি সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছেন।
সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম এক মাস ধরে সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন না বলে জানান।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সরকার ডিও (সরবরাহ আদেশ) প্রথা তুলে দেওয়ায় তাঁরা মিলমালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ডিও প্রথা থাকার সময় পাইকারি বাজারে সব সময় কিছু তেল মজুদ থাকত। এখন আর মজুদ থাকে না। এখন মিলমালিকেরা সরবরাহ করলে বাজারে তেল থাকে, না করলে সংকট দেখা দেয়।
বোতলজাত সয়াবিন তেলের দামও বেড়েছে। দোকানভেদে এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১২২ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০, দুই লিটারের বোতল ২৪০ এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৬০০ (রূপচাঁদা ৬১০ টাকা) থেকে বেড়ে ৬২৫-৬৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পলাশী বাজারের একজন দোকানি বলেন, ‘আমাদের এখন প্রতি লিটারে চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। তাই আমরাও দাম বেশি নিচ্ছি।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, তেল পরিশোধনকারী ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে বলছেন, তারল্যসংকটের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সয়াবিন তেল আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে চাইছে না। এ ছাড়া ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় সয়াবিনের আমদানি খরচ বেশি পড়ছে। এটিও মূল্যবৃদ্ধির কারণ।
এর সঙ্গে দ্বিমত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, চিনির লোকসান পুষিয়ে নিতেই ব্যবসায়ীরা সয়াবিনের দাম বাড়াচ্ছেন। তা স্বীকার না করে তাঁরা ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন। এই সয়াবিন যখন আমদানি করা হয়েছিল, সে সময় ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতি ছিল না।
এ বিষয়ে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিল মালিকদের সমিতির সভাপতি আবদুর রউফ চৌধুরীর বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ট্যারিফ কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে সয়াবিন তেলের আমদানি অনেক বেড়েছে। তাই সয়াবিনের সংকট হওয়ার কথা নয়। তাঁর মতে, দুটি কারণে সয়াবিন তেলের দাম বেশি হতে পারে। এক, এখন যে তেল বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর ঋণপত্র খোলা হয়েছিল আগস্টে, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বর্তমানের বেশি ছিল। দুই, শীতকালে সয়াবিন তেলের চাহিদা বাড়ে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আগামী বৈঠকে সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.